প্রিয়াঙ্কাকে নামিয়েও বিপর্যয় এড়াতে পারলেন না রাহুল গান্ধী

ভারতের লোকসভা নির্বাচনে বিপুল জনরায় নিয়ে ফের ক্ষমতায় ফিরছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ক্ষমতাসীন দল ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) নেতৃত্বাধীন জোট এনডিএ। অন্যদিকে, বিরোধীদল কংগ্রেসের ভবিষ্যৎ এখন প্রশ্নের মুখে। তুরুপের শেষ তাস প্রিয়াঙ্কাকে নামিয়েও বিপর্যয় এড়াতে পারলেন না রাহুল গান্ধী।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 May 2019, 02:40 PM
Updated : 23 May 2019, 04:42 PM

কংগ্রেস সভাপতি রাহুল সৎ, বুদ্ধিমান এবং নতুন আইডিয়াকে সাদরে গ্রহণ করার মতো একজন ব্যক্তিত্ব বলেই মানেন দলের নেতাকর্মীরা। কিন্তু এবারের নির্বাচনে দলটি এতটাই খারাপ ফল করেছে যে পরিবারের ঐতিহ্যবাহী আসন আমেঠিতেও অপ্রত্যাশিতভাবে হেরেছেন রাহুল গান্ধী।

বৃহস্পতিবারের ভোট গণনায় দেখা যায়, ২০১৪ সালের মতো এবারও একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দিল্লির মসনদে বসতে চলেছেন নরেন্দ্র মোদী। প্রধান বিরোধীদল কংগ্রেস যেখানে তিন সংখ্যাতেও পৌঁছাতে পারেনি। দলের বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তারা এর জন্য দলের নিষ্প্রভ প্রচারাভিযান এবং শীর্ষ পর্যায়ে রদবদল করতে ব্যর্থতার অভিযোগ করেছেন।

রাজস্থানে এক কংগ্রেস কর্মকর্তার কথায়, কোনেকিছু পরিবর্তন করতে হলে নেতৃত্বে পরিবর্তন আনতে হবে। গান্ধীর আশেপাশে প্রবীণদের সরিয়ে সেখানে তরুণদের জায়গা করে দেওয়া প্রয়োজন।”

রাহুল গান্ধীর নেতৃত্ব নিয়ে দলে এখনো কোনো চ্যালেঞ্জ আসেনি। কিন্তু ক্রমাগত কংগ্রেসের খারাপ ফলের কারণে তার ভবিষ্যত এবং তার পরিবারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। রাহুল গান্ধী কেবলমাত্র পরিবারের ঐতিহ্যের কারণেই কংগ্রেসের সভাপতি হয়েছেন এটি তরুণ ভারতীয়রা এখনো মেনে নিতে পারেনা বলেই অভিমত বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ এবং কলামনিস্টদের। এই পরিবারিক পরম্পরা ভেঙে কংগ্রেসকে বেরিয়ে আসতে হবে বলেই মত তাদের।

এবারের লোকসভা নির্বাচনেও সেই ২০১৪ সালের মতই খারাপ ফল করেছে কংগ্রেস। গতবার কংগ্রেসের ঝুলিতে ছিল ৪৪ আসন। এবারে কংগ্রেস পাঁচবছর আগের থেকে কিছু বেশি আসন পেলেও ফলাফলে কিছু পরিবর্তন ঘটছে না।

দলের সভাপতি রাহুল গান্ধী এবারে মোদীকে হারাতে কোমর বেঁধেই নেমেছিলেন। রাফালে কান্ড বা কর্মসংস্থানের ওপর জোর দিয়েছিলেন, ‘ব্রহ্মাস্ত্র’ করে  মাঠে নামিয়েছিলেন বোন প্রিয়াঙ্কাকেও। তারপরও ভোটের শোচনীয় ফলে দলের কর্মী-সমর্থকরা এখন প্রবল হতাশ।

 অথচ  গত ডিসেম্বরেই তিনটি বড় রাজ্য -- রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ এবং ছত্তীসগঢ়ে ক্ষমতায় ফিরেছিল কংগ্রেস। এর আগে কর্ণাটকেও বিজেপি’কে ক্ষমতা থেকে দূরে ঠেকিয়ে রাখতে জোটবদ্ধ হয় কংগ্রেস ও জনতা দল (সেকুলার)।  ফলে ভাবা হচ্ছিল যে কংগ্রেস হয়ত এবার ঘুরে দাঁড়াবে, আর তখনই নেমে এল এ বিপর্যয়। গলদটা কোথায় ছিল তা বিশ্লেষণ করতে গেলে দেখা যায়:

জোট গড়তে পারেননি রাহুল গান্ধী:

রাহুল গান্ধী এবার প্রচুর পরিশ্রম, নিষ্ঠা দিয়ে লড়েও কোথাও জোট তৈরি করতে পারেননি। পশ্চিমবঙ্গে বামেদের সঙ্গেই হোক বা উত্তরপ্রদেশে মহাজোট কিংবা দিল্লির আম আদমি পার্টি -- কোথাও সুবিধা করতে পারেনি কংগ্রেস। এটি ছিল নিঃসন্দেহে শীর্ষ নেতাদের ব্যর্থতা। গত বছর কংগ্রেস তিনটি রাজ্য নির্বাচনে জয়লাভের পরই এবারের লোকসভা নির্বাচনের জন্য জোট তৈরির কাজ করে রাখা উচিত ছিল যা রাহুল গান্ধী করেননি। তিনি হয়ত ভেবেছিলেন রাজ্য নির্বাচনের ওই ফলের পর আপনা আপনিই বিজেপি এবারে হারবে যা আদতে হয়নি।

প্রচারাভিযানে ব্যর্থতা:

দলের প্রবীণ নেতা আনন্দ শর্মার সঙ্গে অন্যান্য ঊর্ধ্বতন নেতাদের মতবিরোধের কারণে এবারের নির্বাচনী প্রচার শুরু করতেই দেরী করেছে কংগ্রেস। এমনটিই জানিয়েছেন দলের দুই কর্মকরর্তা। যদিও এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছেন শর্মা। তবে কংগ্রেসের প্রচার শুরু হয়েছিল ৭ এপ্রিলে। ৭ দফা লোকসভা ভোটের প্রথম দফা ভোটগ্রহণ শুরুর মাত্র চারদিন আগে।

দলের শীর্ষস্থানীয় কিছু নেতা বলছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে লাগাতার প্রচার করে উল্টো তার গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছিলেন রাহুল গান্ধী। এতে মোদীর ব্যক্তিগত ক্যারিশমা না কমে কেবলই বেড়েছে। অর্থাৎ, অভিজ্ঞ মোদীর পাতা ফাঁদে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছেন কংগ্রেস সভাপতি। যার ফলে প্রকারান্তরে লড়াইটি দাঁড়িয়ে গিয়েছিল মোদী বনাম বিরোধীদের, যা ভোটাদের দৃষ্টিতে মোদীর ভাবমূর্তিকেই বড় করে তুলেছে।

রাহুলকে এখনো মোদীর বিকল্প ভাবতে রাজি না মানুষ:

রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বের ওপর মানুষের বিশ্বাস যে এখনো টলমল- তারই পরিচয় পাওয়া গেছে এবারের নির্বাচনেও। হয়ত রাহুল ভাল সাক্ষাৎকার দিচ্ছেন, নির্দিষ্ট বিষয় নিয়ে কথা বলছেন, কিন্তু মোদীর যোগ্য বিকল্প তিনি এখনো হতে পারেননি। তৃণমূলস্তরে দলকে যেভাবে চাঙ্গা করা প্রয়োজন তা তিনি এখনো করতে পারেননি। রাহুল  বিভিন্ন বিষয়ে সরাসরি মোদীকে নিশানা করলেও রাজ্যগুলোতে বিজেপি’র সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো কোনও পাকা নেতা এবং সংগঠনই কংগ্রেসের নেই। নির্বাচনে ধরাশায়ী হওয়ার এটিও একটি কারণ।

শেষ তাস হিসাবে কাজে আসলেন না প্রিয়াঙ্কা:

নির্বাচনে তুরুপের শেষ তাস, অর্থাৎ প্রিয়াঙ্কা গান্ধী ভদ্রকে নির্বাচনের সাংগঠনিক কাজে নামিয়েও কোনো কাজ হল না- এটিই কংগ্রেসের সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ।

এবছর ফেব্রুয়ারিতে রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার পর প্রিয়াঙ্কা ব্যাপক প্রচার চালিয়েছেন মূলত ভারতের উত্তর প্রদেশে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর শাসনামলে বেকারত্বের হার বৃদ্ধি; নোটবন্দী; কৃষকদের ন্যায্য অধিকার বঞ্চিত করার নীতির বিরুদ্ধে তিনি কথা বলেছেন।নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে চষে বেড়িয়েছেন তিনি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত লাভ কিছুই হয়নি।

ভোট গণনায় দেখা যাচ্ছে, রাহুল নিজ কেন্দ্র আমেথিতেও লড়ছেন জয়ের জন্য, পিছিয়ে পড়ছেন স্মৃতি ইরানির বিরুদ্ধে। এ থেকেই ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে যে, গান্ধী পরিবারের গণআবেদন এবার নিম্নমুখী এবং তা কংগ্রেসের অস্তিত্বের জন্যই  সঙ্কট হয়ে দাঁড়াতে পারে সামনের দিনগুলোতে।

তাই মোদীর বিরুদ্ধে সফল হতে গেলে কংগ্রেসকে নতুন ভাবনাচিন্তা করেই সামনে এগুতে হবে বলে আপাতদৃষ্টিতে প্রতীয়মান হচ্ছে।