সেই সঙ্গে কাতালুনিয়ার আঞ্চলিক সরকার ভেঙে দিয়ে ভোটের তারিখ ঘোষণা করেছেন স্পেনের প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাখয়।
স্পেন সরকারের বিরোধিতা ও আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে কাতালুনিয়ার মানুষ গত ১ অক্টোবর যে গণভোটে অংশ নেয়, সেখানে প্রায় ৯০ শতাংশ ভোট কাতালুনিয়ার স্বাধীনতার পক্ষে পড়ে বলে কাতালান সরকারের ভাষ্য।
তারই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার বার্সেলোনায় কাতালান পার্লামেন্টের স্বাধীনতার প্রশ্নে ভোটাভুটি হয় এবং বিরোধীদের বয়কটের মধ্যে ৭০-১০ ভোটে কাতালুনিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ার প্রস্তাব অনুমোদন পায়।
এর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে মাদ্রিদে স্প্যানিশ পার্লামেন্টের উচ্চ কক্ষ সিনেট কাতালুনিয়াকে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীন নিয়ন্ত্রণে আনার প্রস্তাব পাস করে।
পরে মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক ডেকে প্রধানমন্ত্রী রাখয় কাতালুনিয়ার আঞ্চলিক সরকার ভেঙে দিয়ে নতুন আঞ্চলিক সরকার নির্বাচনে ২১ ডিসেম্বর ভোটের তারিখ ঘোষণা করেন।
বার্তা সংস্থা রয়টার্স লিখেছে, মাদ্রিদ ও বার্সেলোনার এই পাল্টাপাল্টি অবস্থান সার্বিক পরিস্থিতিকে বিপদজনক মাত্রায় নিয়ে গেছে; আর স্পেন গত চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় কঠিন রাজনৈতিক সঙ্কটের মুখোমুখি হয়েছে।
বার্সেলোনায় উল্লাস
গণভোটের পর একমাস ধরে অচলাবস্থার মধ্যে স্বাধীন হওয়ার চেষ্টা থেকে বিরত থাকার জন্য কাতালুনিয়ার ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছিল। আবার স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে বিলম্বের কারণে ভেতরের চাপও সামাল দিতে হচ্ছিল কাতালান সরকারকে।
এ অবস্থায় কাতালান প্রেসিডেন্ট কার্লোস পুজদেমন স্বাধীনতা বা আগাম নির্বাচনের ঘোষণা ঘোষণা না দিয়ে বৃহস্পতিবার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ভার ছেড়ে দেন পার্লামেন্টের ওপর।
শুক্রবার বিকালে বার্সেলোনায় যখন এই ভোটাভুটি চলছে, দুই হাজারের বেশি মানুষ তখন পার্লামেন্টের বাইরে পার্কে জড়ো হয়ে গাইছিলেন কাতালুনিয়ার জাতীয় সংগীত ‘এলস সেগাদোরস’।
রয়টার্স লিখেছে, স্বাধীনতার ঘোষণা প্রশ্নে পার্লামেন্টে আবেগময় বিতর্কের এক পর্যায়ে সোশালিস্ট পার্টি, পিপলস পার্টি ও সিউদাদানোসের সদস্যরা ভোট বয়কট করে অধিবেশন কক্ষ থেকে থেকে বেরিয়ে যান।
এর মধ্যে দিয়ে স্পেনের হাত থেকে কাতালুনিয়ার প্রশাসনিক ও আইনি নিয়ন্ত্রণ স্বাধীন রাষ্ট্রের হাতে ন্যস্ত করার রায় দেয় পার্লামেন্ট। উল্লাসে ফেটে পড়ে বাইরে অপেক্ষমান জনতা।
আনন্দে কাঁদতে কাঁদতে এক নারী বিবিসিকে বলেন, “আমরা বঞ্চিত হয়েছি, স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করেছি। শেষ পর্যন্ত আজ আমরা মুক্ত।”
কাতালান নেতা পুজদেমন ঐতিহাসিক এই মুহূর্ত শান্তিপূর্ণভাবে উদযাপনের জন্য সমর্থকদের প্রতি আহ্বান জানান। কিন্তু এর পরপরই মাদ্রিদ থেকে কাতালুনিয়ায় কেন্দ্রের শাসন জারির খবর আসে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্সসহ আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো স্পেনের পক্ষ নিয়ে জানায়, কাতালুনিয়াকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে তারা স্বীকৃতি দেবে না।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রধান জাঁ-ক্লদ জাঙ্কার বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন আর কোনো ভাঙন চায় না।
মাদ্রিদের জবাব
কাতালুনিয়ার আঞ্চলিক পার্লামেন্টে স্বাধীনতার ঘোষণা আসার পরপরই মাদ্রিদে স্পেনের পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ সিনেট কেন্দ্রের শাসন জারির নজিরবিহীন পদক্ষেপ নেয়।
প্রধানমন্ত্রী মারিয়ানো রাখয় সিনেটরদের বলেন, কাতালুনিয়ায় আইনের শাসন, গণতন্ত্র আর স্থিতিশীলতা ফেরাতে কেন্দ্রের শাসন চালুর বিকল্প নেই।
বিবিসি জানিয়েছে, সিনেটের ভোটে কেন্দ্রের শাসন জারির পক্ষে ২১৪ ভোট পড়ে; আর ৪৭ জন এর বিরোধিতা করেন। এর মধ্য দিয়ে কেন্দ্র সরকারের প্রধানমন্ত্রীকে কাতালুনিয়ার নিয়ন্ত্রণ গ্রহণের অনুমতি দেওয়া হয়।
ভোটের সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী রাখয় বলেন, ‘কিছু লোকের সংবিধান লঙ্ঘনের চেষ্টাকে’ স্পেন সরকার প্রশ্রয় দিতে পারে না।
সিনেটের ভোটাভুটি শেষে মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করতে বসেন রাখয়। সেখানে কাতালুনিয়ার আঞ্চলিক সরকার ভেঙে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় এবং ভোটের তারিখ চূড়ান্ত করা হয়।
সম্পদশালী কাতালুনিয়া স্পেনের স্বায়ত্তশাসিত একটি অঞ্চল, যার রাজধানী বার্সেলোনা। প্রায় ৭৫ লাখ বাসিন্দার এই অঞ্চলের ভাষা ও সংস্কৃতিও আলাদা।
স্পেনের মোট জনসংখ্যার ১৬ শতাংশের বসবাস কাতালুনিয়ায়। দেশের মোট রপ্তানি আয়ের ২৫.৬ শতাংশ এ অঞ্চল থেকেই আসে। মোট বিদেশি বিনিয়োগের ২০.৭ শতাংশ পাওয়া কাতালুনিয়াই স্পেনের জিডিপির ১৯ শতাংশের যোগান দেয়।
গৃহযুদ্ধের আগে কাতালুনিয়া আরও বেশি স্বায়ত্তশাসন পেলেও ১৯৩৯ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত জেনারেল ফ্রান্সিসকো ফ্রাঙ্কোর স্বৈরশাসনের সময় তা নানাভাবে খর্ব করা হয়। ফ্রাঙ্কোর মৃত্যুর পর কাতালান জাতীয়তাবাদ ফের শক্তিশালী হতে শুরু করে, আন্দোলনের মুখে ১৯৭৮ সালে তাদের স্বায়ত্তশাসন ফিরিয়ে দেওয়া হয়।
স্পেনের পার্লামেন্ট ২০০৬ সালে নতুন আইন করে কাতালুনিয়ার আঞ্চলিক সরকারের হাতে আরও কিছু ক্ষমতা দেয়। কাতালানদের দেওয়া হয় জাতির মর্যাদা। কিন্তু পরে স্পেনের সাংবিধানিক আদালতে সেসব বাতিল হয়ে যায়।
২০১৫ সালে কাতালান পার্লামেন্ট নির্বাচনে স্বাধীনতাপন্থিরা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে নতুন রাষ্ট্র গঠনের পথে এগিয়ে যায় কাতালুনিয়া।
স্পেনের কেন্দ্রীয় পুলিশের বলপ্রয়োগের মধ্যেই ১ অক্টোবর স্বাধীনতার প্রশ্নে কাতালুনিয়ার গণভোট হয়। স্বাধীনতাবিরোধীরা নির্বাচন বয়কট করায় তাতে ভোট পড়ে মাত্র ৪৩ শতাংশ।
ভোটের ওই ফলাফলকে অবৈধ ঘোষণা করে মাদ্রিদ। স্পেনের সাংবিধানিক আদালত এর ফল স্থগিত ঘোষণা করে। কিন্তু তাতে স্বাধীনতাকামীদের দমানো যায়নি। গণভোটের ‘রায়’ মেনে গত ১০ অক্টোবর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সই করেন কাতালুনিয়ার অঞ্চলিক নেতারা।
সেখানে বলা হয়, “কাতালান প্রজাতন্ত্রকে একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে আমরা সকল রাষ্ট্র ও সংস্থার প্রতি আহ্বান জানাই।”
কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে তা কার্যকর না করে আলোচনার প্রস্তাব দেন কাতালান প্রেসিডেন্ট কার্লোস পুজদেমন।
অন্যদিকে মাদ্রিদ ওই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে কাতালান সরকারকে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী সরকার’ আখ্যায়িত করে। সেই সঙ্গে কাতালুনিয়ায় কেন্দ্রের শাসন জারির হুমকি দেওয়া হলে শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ বন্ধ হয়ে যায়।