প্রতি দুই সপ্তাহে একবার পানির ট্যাংকার আসে ভারতের সবথেকে প্রযুক্তি সমৃদ্ধ মহানগরী বেঙ্গালুরুর বন্দেপাল্য শহরতলিতে; সেখানকার শত শত বাসিন্দাকে দিয়ে যায় ১ হাজার লিটার পানি। প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল এই পানি নিতে আসা নারীরা খালি বালতি হাতে শুরু করে দেন চিৎকার-চেঁচামেচি।
পানির জন্য এমন হাহাকারের দৃশ্য এই এলাকায় অস্বাভাবিক কিছু নয় বলে জানাচ্ছেন সেখানকার বাসিন্দা সুশীলা। তাকেও চার সদস্যের পরিবারের জন্য একইভাবে পানি নিতে হয়।
সিএনএনকে এই নারী বলেন, “কখনো শুরু হয় মারামারি, প্রচুর তর্ক হয়। কিন্তু কী করব? আমাদের পানি দরকার। পানির জন্য আমরা মরিয়া।”
সুশীলার মত দক্ষিণের শহর বেঙ্গালুরুর লাখ লাখ মানুষের বাসাবাড়ির ট্যাপে এখন পানি শূন্যতা। গভীর কূপগুলোও গেছে শুকিয়ে। তৈরি হয়েছে পানির মারাত্মক সংকট।
‘ভারতের সিলিকন ভ্যালি’ নামে পরিচিত কর্ণাটকের এই রাজধানী শহরে ইনফোসিস ও উইপ্রোর মতো বহুজাতিক কোম্পানি রয়েছে।
শহরটির এক কোটি ৪০ লাখ মানুষের জন্য দিনে পানির প্রয়োজন প্রায় ২০০ কোটি লিটার। কিন্তু শহরের জল সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন বোর্ডের চেয়ারম্যান ভি রাম প্রসাত মনোহর বলছেন, বেঙ্গালুরুতে চাহিদার তুলনায় পানির সরবরাহ উদ্বেগজনক পর্যায়ে নেমে এসেছে। গত সপ্তাহে সেখানে পানির পরিমাণ কমে ৫০ শতাংশে নেমে আসে।
এই অবস্থায় বাসিন্দাদের খুব সীমিত আকারে পানি ব্যবহার করতে বলা হয়েছে। পানির সংকটের মুহূর্তে গোসল না করে অন্য কোনো দিনে গোসল করতে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। সেইসঙ্গে খাবারের সময় একবার ব্যবহারের উপযোগী (ওয়ান-টাইম) চামচ ব্যবহার এবং বাসনকোসন ও জামাকাপড় ধোয়া সীমিত করার কথা বলা হচ্ছে।
এই সংকটকে ‘ভয়াবহ’ হিসেবে বর্ণনা করছেন বেঙ্গালুরুর বাসিন্দারা। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন, গ্রীষ্ম পর্যন্ত তাপমাত্রার পারদ বেড়ে এই সংকট আরো করুণ হতে চলেছে।
সেন্টার ফর ইকোলজিক্যাল সায়েন্সেসের জলবায়ু বিজ্ঞানী টিভি রামচন্দ্র বলেন, “এক দশকের বেশি সময় ধরেই আমি এই বিষয়ে সতর্ক করে আসছি।
“অপরিকল্পিত নগর বৃদ্ধি, দ্রুত বন উজাড় এবং চলমান জলবায়ু সংকটের চূড়ান্ত পরিণতিতে প্রত্যেকেই এখন মূল্য দিচ্ছে।”
‘গার্ডেন সিটি থেকে শুকনো হ্রদ’
বেঙ্গালুরুতে মানবসৃষ্ট বিস্তৃত হ্রদের কারণে কয়েক দশক ধরে এর সুনাম ছিল। শহরের বাসিন্দাদের পানির যোগান দিত সেই হ্রদ। সেইসঙ্গে সবুজের প্রাচুর্য, বন আর মনোরম জলবায়ু পরিস্থিতির কারণে ভারতের ‘গার্ডেন সিটি’ অ্যাখ্যা পায় বেঙ্গালুরু।
কিন্তু ১৯৯০ এর দশকের গোড়ার দিকে সেখানে দ্রুত ব্যাপক নগরায়ন হয়েছে। ভারতের প্রধান প্রযুক্তি কেন্দ্র বা ‘টেক হাব’ হিসেবে গড়ে ওঠে বেঙ্গালুরু। বন কেটে হ্রদের চারপাশে অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়। নগরায়নের ফলে ৪০ লাখ ঘরবাড়ি গড়ে ওঠে যা, ওই সময়ের তুলনায় তিন গুণ বেশি।
“মাটির ওপর যত ঢালাইয়ের স্তর পড়েছে, বেঙ্গালুরু তত তার পানি ধরে রাখার ক্ষমতা হারিয়েছে”, বলেন জলবায়ু বিজ্ঞানী রামচন্দ্র।
সিএনএনকে তিনি বলেন, “বেঙ্গালুরুর ৮৩ শতাংশ এখন কংক্রিটে ঢাকা। কোনো গাছপালা নেই। ভূগর্ভস্থপ পানি পাওয়ার কোনো উপায় নেই। এটাই এক বড় সমস্যা।”
এখন শহরের মোট পানির সরবরাহের ৭০ শতাংশ আসে কাবেরী নদী থেকে। প্রধান এই জলের উৎসপথটি কর্ণাটকের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে।
কিন্তু নগরায়ণে শহর সম্প্রসারিত হয়েছে। নতুন বাসিন্দাদের জন্য পানির লাইন সম্প্রসারিত করার পর্যাপ্ত সময় নেই কর্তৃপক্ষের। ফলে সেই এলাকাগুলো কূপ থেকে তোলা ভূগর্ভস্থ জলের উপর নির্ভর করে।
গত বছর বর্ষাও ছিল অল্প সময়, ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নেমে যায়। শহরটির জন্য ব্যাপক পানির সংকট তৈরি হয়। কিন্তু শহরের কিনারে বসবাস করা ৪০ লাখ ঘরবাড়ির যারা কূপের ওপর নির্ভর করে, তাদের জন্য পরিস্থতি আরো ঘোলাটে।
বেঙ্গালুরুর উপ-মুখ্যমন্ত্রী ডি কে শিবকুমার জানান, শহরের কমবেশি ১৬ হাজার কূপের মধ্যে ৭ হাজার কূপ শুকিয়ে গেছে। এসব ভূক্তভোগীদের দিকেই মনোযোগ দেওয়া উচিত বলে জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
বেঙ্গালুরুভিত্তিক পানি গবেষক ও প্রকৌশলী বিশ্বনাথান বলেন, কাবেরী নদীর ওপর নির্ভর করা শহরের ১ কোটি ১০ লাখ মানুষের জন্য পানির স্বল্পতা আছে, কিন্তু সেটা সংকটের পর্যায়ের না। বাকি ৩৫ লাখ মানুষের সবাই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভর করে। ফলে সেই পানি শুকিয়ে যাওয়ায় তাদের সংকট হয়েছে।”
পানি কম ব্যবহারের নির্দেশনা
বেঙ্গালুরুর দক্ষিণে বন্দেপাল্য শহরতলিতে নিম্ন-আয়ের মানুষের বাস। সকাল ৯টা থেকে বালতি হাতে তাদের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। অপেক্ষা করতে হয় পানির ট্যাঙ্কারের জন্য।
নদী ও ভূগর্ভস্থ পানি কমে গেলে ট্যাঙ্কারের মাধ্যমে পানি বিতরণ করে সরকার। এর জন্য বাসিন্দাদের পয়সা গুণতে হয়। আর চাহিদা বেড়ে গেলে পানির দামও বেড়ে যায়।
লাইনে দাঁড়িয়ে পানি নিতে এসে বিশৃঙ্খলা আর বাদানুবাদ তৈরি হয়। নারীদের প্রত্যেকে অন্তত দুটি বালতি পূর্ণ করে বাড়িতে পানি নিয়ে যায়। লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা কেউ আবার ট্যাংকারে বাড়ি দিয়ে পানি কতটুকু আছে, তা পরীক্ষা করে দেখেন। অল্প সময়ের মধ্যেই ট্যাংকার খালি হয়ে যায়।
স্থানীয় বাসিন্দা কুমকুম বলেন, “আমরা ১৫ দিনে একবার পানি পাই। প্রতিদিন পানি কিনতে হয়। সকালে বাচ্চাদের মুখ ধোওয়ার জন্য বোতলজাত পানি ব্যবহার করতে হয়।”
এই সংকটের কারণে তার ছোট শিশুটি প্রচণ্ড জ্বরে পড়েছে জানিয়ে কুমকুম পানির খালি ড্রামগুলো দেখান। তার ভাষ্য, “কয়েকদিন ধরে ড্রামগুলোতে পানি নেই। জামাকাপড়, বাসনকোসন ধুতে পারি না। বর্ষকালে বৃষ্টি এলে পানি ধরে রাখব।”
এদিকে সরকারের তরফ থেকে যেসব ট্যাংকারে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে, সেগুলোর প্রতিটির জন্য ১২০০ রুপি গুণতে হচ্ছে বাসিন্দাদের। কিন্তু তারা বলছেন, আর্থিকভাবেও এখন ধুঁকছেন।
বন্দেপাল্যর বাসিন্দা সুশীলা বলেন, তাদের এলাকায় বসবাসকারীরা মাসে আয় করে ৬ থেকে ৮ হাজার রুপি। ফলে অনেকে যাদের উপায় নেই, তাদের মাসিক আয়ের অর্ধেকই এখন ট্যাংকারের পানি কিনতে খরচ হচ্ছে।
“আমরা খুব কম গোসল করি, খুব কম পানি ব্যবহার করি। আমরা সকলেই কষ্ট করছি,” বলেন তিনি।
বেঙ্গালুরুর স্বল্প আয়ের মানুষের এই এলাকার সমাজকর্মী গীতা মেনন বলছেন, “সংকটে কারণে রোগবালাই ও অসুস্থতা তৈরি হতে পারে, যেহেতু স্বাস্থ্যবিধির মাত্রা পড়ে গেছে।
“বাড়িতে পানি না থাকায় শিশুরা রাস্তায় মলত্যাগ করছে। তারা তৃষ্ণার্ত, মানুষ রান্না করতে পারছে না। এটি কোনো সাময়িক সমস্যা নয়। আর এটি চলতে থাকলে দীর্ঘমেয়াদী সমস্যায় পড়তে হবে।”
বেঙ্গালুরুর পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন বোর্ডের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করে কোনো বক্তব্য জানতে পারেনি সিএনএন।
সংকটে ধাক্কা সবারই
বেঙ্গালুরুতে দরিদ্ররা পানির সংকটে ধাক্কা সামলালেও বাদ যাচ্ছে না উচ্চ মধ্যবিত্তরাও।
বিভিন্ন হাউজিং সোসাইটি তাদের ভাড়াটিয়া বা বাসিন্দাদের পানির ব্যাপারে প্রতিদিন আপডেট তথ্য পাঠাচ্ছে। পানির ঘাটতির বিষয়টি তাদের অবহিত করে এবং পানি ব্যবহারে সতর্ক হওয়ারও তাগাদা দিচ্ছে।
সিএনএন লিখেছে, বেঙ্গালুরুর একটি আবাসিক ভবনের বাসিন্দাদের নোটিশ দিয়ে পানির ব্যবহার অর্ধেকে নামিয়ে আনতে বলেছে।
নোটিশে বলা হয়েছে, “পানির অবস্থা গুরুতর। কাবেরী পানি সরবরাহ লাইন থেকে আমরা খুব কম পানি পাচ্ছি। আমরা পুরোপুরি কূপ নির্ভর। ১১টি কূপের মধ্যে মাত্র পাঁচটি কুপ চালু আছে। সেগুলোও কখন শুকিয়ে যাবে, তা জানার উপায় নেই। আর সেটি ঘটলে নোটিশে কোনো সময়সীমাও থাকবে না।”
রয়টার্স লিখেছে, পানির ঘাটতির কারণে পোশাক কারখানাগুলোতে উৎপাদন কমে গেছে। রেস্তোরাঁয় পানির বিল দ্বিগুণ হয়েছে। কিছু কোম্পানি কর্মচারীদের মিটিং বাদ দিয়ে ট্যাংকার থেকে পানি আনার জন্য পাঠাচ্ছে।
এই সংকট রাজনৈতিক দোষারোপের খেলায়ও পরিণত হয়েছে। এর জন্য ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপি কর্ণাটকের কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন সরকারের অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করছেন। প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেসের দাবি, কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে বিজেপি আর্থিকভাবে পর্যাপ্ত সহযোগিতা করছে না।