কী হয়েছে আসলে?
সমস্যার শুরু হোয়াটসঅ্যাপের ছোট এক ঘোষণায়। সেবাটি তাদের সেবার নীতিমালা 'আপডেট' করেছে। অনেক প্রতিষ্ঠানই করে থাকে। আমরা যারা বিভিন্ন সেবা ব্যবহার করে থাকি তারা এই নীতিমালা বেশিরভাগ সময়ে পড়েও দেখি না। স্রেফ "আই এগ্রি" বা আমি সম্মত আছি এমন একটি বাটন চেপেই অ্যাপ বা সফটওয়্যার ইনস্টল করে ফেলি। হোয়াটসঅ্যাপ ওই "আই এগ্রি" বাটনের ওপরে যে কথাবার্তা লেখা থাকে সেই লেখাগুলোয় কিছু পরিবর্তন এনেছে।
নতুন নীতিমালায় হোয়াটসঅ্যাপ বলছে- এখন থেকে প্রতিষ্ঠানটি তাদের কাছে থাকা গ্রহক ডেটা তারা ফেইসবুকের সঙ্গে শেয়ার করবে। সেবাটি ব্যবহার করতে হলে এই বিষয়টি মেনে নিতে হবে। আর আপনি যদি মেনে নিতে রাজী না থাকেন তাহলে আপনি হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করতে পারবেন না।
সোজা কথায় এই হচ্ছে বিষয়।
আমি দুটো সেবাই ব্যবহার করি, তাহলে সমস্যা কী?
খুব সহজসরল পথে চিন্তা করলে অনেকেই হয়তো বলবেন- আমি ফেইসবুক ব্যবহার করি, আবার হোয়াটসঅ্যাপও ব্যবহার করি। তো এই দুই প্রতিষ্ঠান যদি তথ্য শেয়ার করে তাতে সমস্যা কী? আমার নতুন কোনো তথ্য তো আর যাচ্ছে না।
আইনগত সমস্যা হচ্ছে, ফেইসবুক যখন ২০১৪ সালে হোয়াটস্যাপকে কিনে নেয় তখন ফেইসবুক এবং এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা মার্ক জাকারবার্গ দুই তরফ থেকেই প্রতিশ্রুতি এসেছিলো যে হোয়াটসঅ্যাপ স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান হিসেবে চলবে, ফেইসবুক সেখানে নাক গলাবে না। ফেইসবুককে ওই সময় প্রতিশ্রুতিটি দিতে হয়েছিল কারণ ওই প্রতিশ্রুতি ছাড়া ফেইসবুকের পক্ষে হোয়াটসঅ্যাপ কিনে নেওয়া সম্ভব ছিলো না।
কেন ফেইসবুককে ওই প্রতিশ্রুতি দিতে হয়েছিল?
বাজারে একচেটিয়া পরিস্থিতি যেন তৈরি না হয় সেজন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এ বিষয়ে আইন তৈরি করেছে। পশ্চিমা দেশগুলোতে একে বলে অ্যান্টিট্রাস্ট আইন। বাংলাদেশে এ বিষয়ে যে আইন আছে তার নাম 'প্রতিযোগিতা আইন'।
অনলাইনে আলাপচারিতার জন্য ফেইসবুকের সেবাটির নাম মেসেঞ্জার। আর, হোয়াটসঅ্যাপ নিজেই একটি অ্যাপ যা অনলাইনে আলাপচারিতার সেবা দেয়। ফলে, এই দুই সেবা একত্র হয়ে যাওয়া মনোপলি বা একচেটিয়া প্রভাবের সুযোগ তৈরি করে। এই কারণেই ২০১৪ সালে হোয়াটসঅ্যাপ কেনার আগে ফেইসবুক পই পই করে বলেছে - মালিকানা এক হলেও দুটি প্রতিষ্ঠান আলাদাই থাকবে।
এখন কি তবে ফেইসবুক আর হোয়াটসঅ্যাপ এক হয়ে যাচ্ছে?
এক কথায় এর উত্তর ‘না, আইনত হচ্ছে না’। কাগজে কলমে দুটি আলাদা প্রতিষ্ঠানই থাকছে কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে হোয়াটসঅ্যাপ নীতিমালায় যে পরিবর্তন এনেছে সেটি আসলে ফেইসবুককে ডেটার বেলায় একত্রীকরণের ফলে পাওয়া সুবিধাই দিচ্ছে। আর সেখানেই সমস্যা।
হোয়াটসঅ্যাপের নীতিমালায় এই পরিবর্তন কি তাহলে গ্রহনযোগ্য?
উত্তর হচ্ছে যেসব দেশে অ্যান্টিট্রাস্ট আইন কড়াকড়িভাবে মেনে চলা হয় সেখানে এই পরিবর্তন গ্রহনযোগ্য হবে না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, হোয়াটসঅ্যাপ কিন্তু ইউরোপিয়ান ইউনিয়নভূক্ত দেশগুলোয় ডেটা শেয়ার করার এই নিয়ম চালু করেনি। একে প্রাইভেসি বিষয়ে ইইউয়ের কঠোর নীতিমালার বিজয় হিসেবেই দেখা হচ্ছে। সম্প্রতি ভারতের প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ও জানিয়ে দিয়েছে তারা এই নিয়মটির বিপক্ষে অবস্থান নিচ্ছে।
কী কী সমস্যা হতে পারে এই ডেটা শেয়ারের ফলে?
গোটা বিশ্বে ফেইসবুক ব্যবহারকারী প্রায় ২২০ কোটি আর হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহারকারী প্রায় ২০০ কোটি। এদের মধ্যে অনেকেই দুটি সেবাই ব্যবহার করেন।
নতুন নীতিমালায় হোয়াটসঅ্যাপ বলে দিয়েছে কোন কোন তথ্য এই অ্যাপটি ফেইসবুকের সঙ্গে শেয়ার করবে। এর মধ্যে রয়েছে মোবাইল ফোনের তথ্য, আইপি অ্যাড্রেস এবং ব্যবসায়ের প্রয়োজনে গ্রাহকরা যে যোগাযোগ করেন সেই তথ্য -- এর মধ্যে আর্থিক লেনদেনের তথ্যও থাকবে। এগুলোই প্রধান, তবে আরও তথ্য আছে যেগুলোয় চোখ বুলাতে পারবে ফেইসবুক।
শি'রোজ নামের নারী সহায়ক প্রতিষ্ঠানের সিইও এবং প্রতিষ্ঠাতা সাইরি চাহাল। তিনি বলছেন, ফেইসবুকের মতো একটি প্রতিষ্ঠান যার কি না ডেটা ব্যবহার এবং যার তার কাছে ডেটা বিক্রি করার জঘন্য ইতিহাস রয়েছে (কেমব্রিজ অ্যানালিটিকার নাম কি মনে আছে আপনাদের?) তার কাছে আমাদের তথ্য চলে যাচ্ছে এই চিন্তাটাই মেরুদণ্ডে ভয়ের শীতল স্রোত তৈরির জন্য যথেষ্ট।
ভুল বলেননি সাইরি। নতুন নীতিমালায় স্পষ্ট করে বলা আছে গ্রাহকের এই ডেটা তৃতীয় পক্ষের কাছেও বিক্রি করা হতে পারে।
আমাদের মেসেজ আর গোপন থাকবে না?
বড় একটি দুশ্চিন্তা থেকে অবশ্য আপনি মুক্ত থাকতে পারেন। হোয়াটসঅ্যাপের মাধ্যমে আপনার মেসেজ, আলাপচারিতা এনক্রিপটেড বা গোপনই থাকছে। তবে হ্যা, আপনার ফোনবুকে থাকা ফোন নাম্বারগুলো চলে যাবে ফেইসবুকের কাছে, ফেইসবুক জানবে আপনি কোন কোন নম্বরে কল করেন বা মেসেজ পাঠান, কোন ডাক্তারের কাছে আপনি যান বা কোন কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আপনার সখ্যতা রয়েছে।
প্রতিবেদনে ব্রিটিশ দৈনিক ইনডিপেনটেন্ট মন্তব্য করেছে, এই পরিবর্তনের ফলে ফেইসবুক লাভবান হলেও শেষ পর্যন্ত প্রাইভেসি নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপের যে সুনাম ছিলো সেটি ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
তা' হলে কি দলে দলে লোকজনের হোয়াটসঅ্যাপ ছেড়ে টেলিগ্রাম বা সিগনালের দিকে চলে যাওয়া উচিৎ হবে? বিজনেস ইনসাইডারের প্রতিবেদন বলছে, লোকজন আসলে সবরকম অ্যাপই ব্যবহার করতে থাকবে, এককভাবে হয়তো কোনো বিশেষ অ্যাপ ব্যবহার করবে না।