কোনও প্রাণী দেখতে এর কয়েক কোটি বছর পুরোনো পূর্বসূরির মতো হলে কী পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে? বাস্তবেই এমনটি ঘটলে মনে হবে, প্রাণীটি আগের সময়েই ‘বরফের মতো হিমায়িত অবস্থায়’ থমকে দাঁড়িয়ে আছে, যার আশপাশের সবকিছুই বিবর্তিত হয়েছে।
এ ধরনের প্রাণী মূলত ‘জীবন্ত জীবাশ্ম’ বা ‘লিভিং ফসিলস’ নামে পরিচিত, যা দীর্ঘদিন ধরেই বিজ্ঞানীদেরকে বিভ্রান্তির মধ্যে রেখেছে।
সম্প্রতি এক গবেষণায় বিজ্ঞানীরা বোঝার চেষ্টা করেছেন, কেন যুগ যুগ আগের এ প্রাচীন প্রাণীগুলো খুব একটা পরিবর্তিত হয়নি।
লিভিং ফসিলস সম্পর্কে ১৮৫৯ সালে প্রথম ধারণা দিয়েছিলেন চার্লস ডারউইন।
এ ধরনের প্রাণীর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, এরা দেখতে এদের পূর্বসূরীদের মতোই। বর্তমানে গবেষকরা আরও পথ পাড়ি দিয়ে ‘জীবন্ত জীবাশ্মের’ নতুন এক চমকপ্রদ উদাহরণ খুঁজে পেয়েছেন, তা হল ‘গার’ মাছ।
গার মাছ মূলত প্রাচীন প্রজাতির মাছ, যারা ডাইনোসরের আমল থেকে খুব কমই পরিবর্তিত হয়েছে। প্রায় ১৫ কোটি বছর আগে জুরাসিক যুগে নিজস্ব জীবাশ্ম আত্মীয়দের মতো একই রকম আছে মাছগুলো। কিন্তু কেন?
সম্প্রতি ‘এভুলিউশন’ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় এর জবাব খোঁজার চেষ্টা করেছেন বিজ্ঞানীরা।
গবেষণাটির নেতৃত্বে ছিলেন ‘ইয়েল ইউনিভার্সিটি’র অধ্যাপক টমাস জে. নিয়ার। তিনি বলছেন, অন্যান্য প্রজাতির মেরুদণ্ডী প্রাণীর চেয়ে গার মাছের ‘জেনেটিক’ পরিবর্তনের হার সবচেয়ে কম। এই ধীর গতির পরিবর্তনের সম্ভাব্য মানে, এদের ‘ডিএনএ’ অন্যান্য প্রাণীর মতো দ্রুত বিবর্তিত হয় না।
গবেষকরা একে ‘হাইব্রিডাইজেশন’ নামে পরিচিত এক পদ্ধতির সঙ্গে সমন্বিত করেছেন, যেখানে দুটি ভিন্ন প্রজাতির গার মাছ নিজেদের মধ্যে প্রজনন ঘটিয়ে বংশ বিস্তার করতে পারে। তবে, মাছগুলোর সর্বশেষ বংশবৃদ্ধির নজির মিলেছে ডাইনোসর আমলে। আর এই ধীর বিবর্তনে গার মাছে বৈচিত্র্যও কম দেখা যায়।
গবেষকদের দাবি, গার মাছের সম্ভবত ব্যতিক্রমধর্মী এক ধরনের উন্নত ‘ডিএনএ রিপেয়ার সিস্টেম’ আছে, যার ফলে অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় এর ডিএনএ-তে নানা পরিবর্তন আরও কার্যকরভাবে কাজ করে। বিষয়টি সত্য হলে, তা মানুষের স্বাস্থ্য চিকিৎসার ক্ষেত্রেও বড় এক খবর।
মানুষের বিভিন্ন রোগের মধ্যে বিশেষ করে ক্যান্সার মূলত দেহের ডিএনএ’র পরিবর্তনের কারণেই হয়ে থাকে, যা আমাদের দেহকে সারিয়ে তুলতে পারে না। গার মাছেরা তাদের ডিএনএ’কে কীভাবে সারিয়ে তোলে সে সম্পর্কে জানা গেলে, এটা সম্ভবত চিকিৎসাবিজ্ঞানে নতুন সম্ভাবনার দরজা খুলে দেবে।
মানবদেহে ক্যান্সারসহ বেশ কিছু রোগের উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে এমন ডিএনএ পরিবর্তনের ঘটনা, যা আমাদের দেহ সারিয়ে তুলতে পারে না। তবে, গার মাছ কীভাবে নিজের ডিএনএ মেরামত করে, তা মানুষের স্বাস্থ্যগত উন্নতির ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা রাখতে পারে।
এ গবেষণায় ৪৭১ প্রজাতির মেরুদণ্ডী প্রাণীর ডিএনএ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গার মাছ অন্যান্য মেরুদণ্ডী প্রাণীর তুলনায় এক হাজার ভাগের একভাগ গতিতে বিবর্তিত হয়। এ ধীর বিবর্তনের ঘটনা কেবল গার মাছেই নয়, বরং ‘স্টার্জন’ ও ‘প্যাডেলফিশ’ প্রজাতির মাছেও দেখা গেছে। তবে, এদের মধ্যে সবচেয়ে জোরালো প্রমাণ দিয়েছে গার মাছ।
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাস অঙ্গরাজ্যে, দুই প্রজাতির গার মাছ অর্থাৎ ‘অ্যালিগেটর গার’ ও ‘লংনৌজ গার’-এর ওপর পরীক্ষা চালানো হয়, যেগুলো ১০ কোটি বছর ধরে একে অপর থেকে আলাদা ছিল। পরীক্ষায় দেখা যায়, এরা এখনও একে অপরের সঙ্গে প্রজনন ঘটিয়ে বংশবৃদ্ধি করতে পারে। এ ধরনের অনুরূপ আত্মীয়তার প্রাচীনতম নজির খুঁজে পাওয়া যায় প্রাণী, গাছপালা ও ছত্রাকসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে।
মাছের এমন সক্ষমতা থেকে ইঙ্গিত মেলে, গার মাছে এমন ধীরগতির জেনেটিক পরিবর্তন এদের একটি স্বতন্ত্র প্রজাতিতে পরিণত হওয়া ও নতুন কোনও শারীরিক বৈশিষ্ট্যের বিকাশে বাধার কারণ হতে পারে।