মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পরও এনভিডিয়ার এআই চিপ ঢুকছে চীনে

চীনে এনভিডিয়ার চিপ নিয়ে যে চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে ইঙ্গিত মেলে, হুয়াওয়ের মতো বিভিন্ন চীনা কোম্পানি নতুন এআই চিপ বিকাশ করলেও তা এনভিডিয়ার সত্যিকারের বিকল্প নয়।

প্রযুক্তি ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 Jan 2024, 08:57 AM
Updated : 15 Jan 2024, 08:57 AM

যুক্তরাষ্ট্রের জারি করা রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার পরও গত বছর চীনের বিভিন্ন সামরিক অবকাঠামো, রাষ্ট্রীয় এআই গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয়ে ছোট পরিসরে এনভিডিয়ার এআই চিপ কিনতে দেখা গেছে।

বিষয়টি উঠে এসেছে রয়টার্সের দেখা এক নথিতে। সে নথি অনুযায়ী, মার্কিন চিপ নির্মাতা কোম্পানিটি যেসব চিপ বিক্রি করেছে, তার সিংহভাগই কিনেছে চীনের বিভিন্ন অপরিচিত সরবরাহক কোম্পানি। এর থেকে ইঙ্গিত মেলে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় যুগান্তকারী উদ্ভাবন ও সামরিক বাহিনীর মাধ্যমে ব্যবহার হতে পারে, এমন ঝুঁকিগুলোকে কারণ দেখিয়ে চীনের কাছে উন্নতমানের চিপ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার পরও কতোটা কাঠখড় পোড়াতে হচ্ছে ওয়াশিংটনকে।

ওই নথি অনুসারে, চীনের কাছে যুক্তরাষ্ট্রে তৈরি উন্নতমানের চিপ কেনা বেচার বিষয়টি অবৈধ নয়। এমনকি মার্কিন নিষেধাজ্ঞা জারির পরও চীনের বিভিন্ন অবকাঠামো এনভিডিয়ার সেমিকন্ডাক্টর কিনেছে ও এর রশিদ পেয়েছে।

চীনের কাছে যেসব মার্কিন চিপ বিক্রি নিষিদ্ধ, তার মধ্যে রয়েছে এনভিডিয়ার ‘এ১০০’ ও এর চেয়েও ক্ষমতাধর ‘এইচ১০০’। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বর থেকেই চীন ও হংকংয়ে চিপ দুটি বিক্রির ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। পরবর্তীতে, এ নিষেধাজ্ঞার বিভিন্ন শর্ত মেনে এনভিডিয়া তুলনামূলক ধীর গতির ‘এ৮০০’ ও ‘এইচ৮০০’ চিপ বানালেও গত বছরের অক্টোবরে জারি করা নতুন নিষেধাজ্ঞায় চীনে চিপ দুটি বিক্রি বন্ধ করতে বাধ্য হয় এনভিডিয়া।

এআই সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কাজের জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য চিপ হল এনভিডিয়ার ‘গ্রাফিক্স প্রসেসিং ইউনিট’ বা ‘জিপিইউ’ চিপ। মেশিন লার্নিং ব্যবস্থায় যে বিশাল ডেটা প্রক্রিয়া করতে হয় তাতে বিভিন্ন প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানির চেয়ে ঢের এগিয়ে আছে মার্কিন এ চিপ জায়ান্ট।

এদিকে, চীনে এনভিডিয়ার চিপ নিয়ে যে চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে, তা থেকে ইঙ্গিত মেলে, হুয়াওয়ের মতো বিভিন্ন চীনা কোম্পানি নতুন এআই চিপ বিকাশ করলেও তা এনভিডিয়ার সত্যিকারের বিকল্প নয়। আর মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আগে চীনের এআই চিপ বাজারের ৯০ শতাংশ দখল করে রেখেছিল এনভিডিয়া।

এনভিডিয়ার উন্নত চিপগুলোর ক্রেতাদের মধ্যে রয়েছে চীনের বিভিন্ন অভিজাত ইউনিভার্সিটি ও দুটি এমন অবকাঠামো, যেগুলো মার্কিন রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার আওতায় পড়ে। সেগুলো হল, ‘হার্বিন ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি’ ও  ‘ইউনিভার্সিটি অফ ইলেকট্রনিক সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি অফ চায়না’। প্রতিষ্ঠান দুটির বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা চীনের সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে জড়িত, যা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ পরিপন্থী।

এর মধ্যে গত বছরের মে মাসে এনভিডিয়ার কাছ থেকে ছয়টি এ১০০ চিপ কিনেছে হার্বিন ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি। পরবর্তীতে, একই বছরের ডিসেম্বরে কোম্পানিটির কাছ থেকে একটি এ১০০ চিপ কিনেছে ইউনিভার্সিটি অফ ইলেকট্রনিক সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি অফ চায়নাও। তবে, চিপগুলো কেনার উদ্দেশ্য শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি বলে প্রতিবেদনে লিখেছে রয়টার্স।

এ প্রসঙ্গে রয়টার্স প্রতিবেদনে উল্লেখ করা ক্রেতাদের মন্তব্য জানতে চাইলেও কারও কাছ থেকেই সাড়া মেলেনি।

এ ছাড়া, এনভিডিয়া বা কোম্পানির অনুমোদিত খুচরা বিক্রেতারা চীনের কাছে এ চিপগুলো সরবরাহ করেছে কি না, সেটি শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি বলে উঠে এসেছে রয়টার্সের পর্যালোচনায়। আর সরবরাহকরা কীভাবে এনভিডিয়ার চিপ সংগ্রহ করেছে, সেটিও পরিষ্কার নয়।

মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পরপরই এ ধরনের উন্নতমানের চিপ কেনার জন্য চীনে একটি ‘আন্ডারগ্রাউন্ড বাজার’ গড়ে উঠেছে। এর আগে চীনের সরবরাহকরা বলেছেন, চীনে এনভিডিয়া রপ্তানি করা পণ্যের যে অতিরিক্ত স্টক মজুদ হয় অথবা ভারতের মতো দেশগুলোতে যেসব কোম্পানি এনভিডিয়ার চিপ রপ্তানি করে থাকে, সেখান থেকেই এ বাজারে চিপগুলো চলে আসে।

এ নথিতে তালিকাভুক্ত ১০টি সরবরাহক কোম্পানির মন্তব্য জানতে চেয়েছিল রয়টার্স, তবে কারও কাছ থেকেই সাড়া পাওয়া যায়নি।

সামরিক খাত, এআই ক্রেতা

রয়টার্সের পর্যালোচনা করা ওই নথিতে উল্লেখ রয়েছে একশটির বেশি এমন টেন্ডারের কথা, যেখান থেকে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো অক্টোবরে জারি করা নিষেধাজ্ঞার পরও এনভিডিয়ার এ১০০ ও এ৮০০ চিপ সংগ্রহ করেছে।

গত মাসে প্রকাশিত বিভিন্ন টেন্ডারে দেখা গেছে, চীনের সিংসুয়া ইউনিভার্সিটি এনভিডিয়ার দুটি ‘এইচ১০০’ চিপ কেনার পাশাপাশি দেশটির শিল্প ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় চালিত এক গবেষণাগারও একই মডেলের একটি চিপ সংগ্রহ করেছে।

চীনের সামরিক বাহিনীর ডেটাবেজ অনুযায়ী, জিয়াংজু প্রদেশের উয়ুক্সি শহর থেকেও ‘পিপল’স লিবারেশন আর্মি’র একটি অবকাঠামো এনভিডিয়ার চিপ কিনেছে, যেখানে অক্টোবরে তিনটি এ১০০ চিপ কেনার পাশাপাশি এ মাসেও কেনা হয়েছে একটি এইচ১০০ চিপ।

চীনে সামরিক টেন্ডারগুলো প্রায়শই ভারী সংশোধন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যায়। ফলে, সেইসব টেন্ডার কারা জিতেছে বা সেগুলো কেনার পেছনে কী কারণ ছিল, তা জানতে পারেনি রয়টার্স।

তবে, বেশিরভাগ টেন্ডারেই দেখা গেছে, চিপগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসংশ্লিষ্ট কাজে ব্যবহৃত হবে। তবে, এআই প্রযুক্তির লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেল তৈরির জন্য যে পরিমাণ চিপ প্রয়োজন, সে তুলনায় কম চিপই কিনেছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

গবেষণা কোম্পানি ট্রেন্ডফোর্সের তথ্য অনুসারে, ওপেনএআইয়ের জিপিটি’র মতো মডেল তৈরির জন্য এনভিডিয়ার ৩০ হাজারের বেশি এ১০০ চিপ ব্যবহার করতে হয়।

তবে, প্রচলিত এআই মডেলের সক্ষমতা বাড়ানো ও এর মেশিন লার্নিংয়ের জটিল কার্যক্রম হাতে গোনা কয়েকটি চিপের মাধ্যমেই করা সম্ভব।

উদাহরণ হিসেবে ধরা যায়, গত মাসে চীনের শ্যানডং প্রদেশভিত্তিক প্রযুক্তি কোম্পানি ‘শ্যানডং শেংজিয়াং ইলেকট্রনিক টেকনোলজি’র কাছে এনভিডিয়ার পাঁচটি এ১০০ চিপ বিক্রির চুক্তি করেছে ‘শ্যানডং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইনস্টিটিউট’।

এর মধ্যে অনেক টেন্ডারেই এমন শর্ত রয়েছে যে, পণ্য সরবরাহ ও ইনস্টলের আগেই সরবরাহকদের অর্থ পরিশোধ করতে হবে। আর এ আর্থিক লেনদেন দেখানোর জন্য নোটিশ প্রকাশের শর্ত দেওয়া হয় বেশিরভাগ ইউনিভার্সিটিকে।

২০২২ সালের মার্কিন নিষেধাজ্ঞার পর এনভিডিয়ার প্রায় ৮০টি চিপ কিনেছে ‘চীনের এমআইটি’ হিসেবে পরিচিত সিংসুয়া ইউনিভার্সিটি।

ডিসেম্বরে এ১০০ চিপ কেনার টেন্ডার প্রকাশ করেছিল চংকিং ইউনিভার্সিটি, যেখানে স্পষ্টভাবে উল্লেখ ছিল, তাদের ‘সেকেন্ড-হ্যান্ড’ বা আগেই ব্যবহার করা চিপ নয়, বরং ‘ব্র্যান্ড নিউ’ বা একেবারে নতুন চিপ লাগবে। ওই নোটিশে আরও উল্লেখ রয়েছে, এ মাসেই প্রতিষ্ঠানটিকে নতুন চিপ সরবরাহ করা হয়েছে।