শেয়ার কেনায় গতি বাড়ায় পুঁজিবাজারে লেনদেন একদিন পর আবার হাজার কোটি টাকার ঘরে পৌঁছেছে। তবে সূচক অনেকটা বেড়ে গিয়েও দিন শেষে পতনে বিনিয়োগকারীদের কপালে পড়েছে চিন্তার ভাঁজ।
বুধবার সপ্তাহের চতুর্থ কর্মদিবসের শুরুতে ৪০ মিনিট যেতে না যেতেই সূচক বেড়ে যায় ২৫ পয়েন্ট। কিন্তু দিন শেষে ৬ পয়েন্ট হারিয়ে শেষ হয়েছে বাজার। অর্থাৎ দিনের সর্বোচ্চ অবস্থানের চেয়ে সর্বনিম্ন অবস্থানের পার্থক্য ৩১ পয়েন্ট।
এর ফলে দিনের শুরুতে যারা শেয়ার কিনেছিলেন, তাদের মধ্যে অনেকেই শেষ বেলায় ক্ষতির মুখে পড়েছেন।
গত কয়েক মাসের মতই এদিন পুঁজিবাজারে রাজত্ব করেছে স্বল্প মূলধনী, লোকসানী ও হাতে গোনা কয়েকটি কোম্পানি।
সাধারণ বীমা খাতের শেয়ারে আরও সংশোধন হয়েছে। আর যথারীতি ঘুমিয়ে মৌলভিত্তির কোম্পানি।
বছরের পর বছর ধরে ভালো লভ্যাংশ আর চলমান বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের ভালো ব্যবসাও এসব শেয়ারের প্রতি বিনিয়োগকারীদের আগ্রহী করে তুলতে পারছে না।
গত তিন সপ্তাহ ধরে একেক দিন একেক খাতে আগ্রহ দেখা দিলেও ব্যাংক খাতে এখনও রয়ে গেছে অনাগ্রহ। টেলিযোগাযোগেও একই চিত্র।
আবার খাদ্য খাতে চাঙ্গাভাবেও এই খাতে সবচেয়ে শক্তিশালী কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকো ফ্লোর প্রাইস ছাড়াতে পারছে না। ওষুধ খাতে স্কয়ার ফার্মা, রেনাটার মত শক্তিশালী কোম্পানির ক্ষেত্রেও একই চিত্র।
আর্থিক খাতে এই সময়ে যেসব কোম্পানির শেয়ার দর বেড়েছে বা লেনদেনে গতি এসেছে, তার প্রায় সবই ঋণ কেলেঙ্কারিতে ডুবে গেছে, সহসা উত্তরণের আশা নেই। অন্যদিকে সংকটেও ভালো ব্যবসা করে লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে, এমন কোম্পানির শেয়ারে নেই আগ্রহ।
চাপ কাটিয়ে মুনাফার স্বাভাবিক চিত্রে ফেরা বহুজাতিক কোম্পানি বাটা শু, রেকিট বেনকিজারের মত কোম্পানিও ঘুমিয়েই বলা চলে।
অথচ এসব কোম্পানি যেসব খাতে, সেগুলোর মধ্যে লোকসানি আর স্বল্প মূলধনী কোনো কোনো কোম্পানির দর এই সময়ে বেড়ে দ্বিগুণ, তিন গুণ, এমনকি দুই মাসেরও কম সময়ে চার গুণও হয়েছে এবং দর বাড়ছেই।
চলতি সপ্তাহের প্রথম কর্মদিবসে এক দিনে ৭৭ কোটি টাকা লেনদেন হওয়া কোম্পানির শেয়ারে এখন ক্রেতা নেই। সেদিনের পরে থেকেই আবার ফ্লোর প্রাইসে।
সপ্তাহের দ্বিতীয় দিন হঠাৎ করেই ক্রেতার দেখা পাওয়া মিউচ্যুয়াল ফান্ডে আবার ক্রেতার অভাব।
এসবের মধ্যেও লেনদেন গত সাড়ে ছয় মাসের মধ্যে হয়েছে সর্বোচ্চ। সারা দিনে হাতবদল হয়েছে ১ হাজার ১৯৮ কোটি ৬৫ লাখ ১৮ হাজার টাকার শেয়ার। এর চেয়ে বেশি লেনদেন হয়েছিল ২০২২ সালের ৮ নভেম্বর। সেদিন হাতবদল হয় ১ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকার বেশি।
সূচকের অবস্থান সেই ৮ নভেম্বর ৬ হাজার ৩৮৪ পয়েন্টের কাছাকাছি গিয়েও নেমে এসেছে।
দিনের সর্বোচ্চ অবস্থান ছিল ৬ হাজার ৩৭০ পয়েন্ট। কিন্তু টানা বিক্রয়চাপে তা নেমে এসেছে ৬ হাজার ৩৩৯ পয়েন্টে।
ব্যাংক, টেলিযোগাযোগে কী চিত্র
৩৫টি কোম্পানির ব্যাংক খাতে সারা দিনে হাতবদল হয়েছে কেবল ৭ কোটি ৫১ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৪ কোটি ৪৫ লাখ টাকাই হয়েছে মিডল্যান্ড ব্যাংকের।
অপেক্ষাকৃত দুর্বল স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের ৫৫ লাখ টাকার শেয়ার হাতবদল হয়েছে। বাকি ৩৩টি কোম্পানির বিপুল সংখ্যক শেয়ার বিক্রির জন্য বসিয়ে রেখেও ক্রেতার সন্ধান মেলেনি।
কেবল ১০ পয়সা করে শেয়ারদর বেড়েছে আল আরাফাহ আর প্রাইম ব্যাংকের। লেনদেন ভালো হলেও ৫০ পয়সা দর হারিয়েছে মিডল্যান্ড। লভ্যাংশ সংক্রান্ত রেকর্ড ডেট শেষে দর সমন্বয় হয়ে ফের ফ্লোর প্রাইসে নেমেছে ঢাকা এবং গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক। বাকি সব ব্যাংকের শেয়ারদর ফ্লোর প্রাইসে লেনদেন হচ্ছে।
আর্থিক খাতে ভালো হিসেবে পরিচিত কোম্পানিগুলোরও শেয়ারের ক্রেতা নেই বহু মাস ধরে। ফ্লোর প্রাইসে পড়ে আছে সেগুলো।
টেলিযোগাযোগের তিন কোম্পানি বাংলাদেশ সাবমেরিন, গ্রামীণফোন ও রবির শেয়ারেরও ক্রেতার দেখা মেলেনি সেভাবে।
গত রোববার ৩৩ লাখের বেশি শেয়ার হাতবদলের পর আনোয়ার গ্যালভানাইজিং নিয়ে বিস্ময় তৈরি হলেও সেটি নেমে এসেছে ১৭ হাজার ৩৫৪টিতে।
খাদ্য খাতে আলোচিত এমারেল্ড অয়েলের শেয়ারদর এক পর্যায়ে ১০ শতাংশ কমে গেলেও পরে অনেকটাই পুনরুদ্ধার হয়েছে। এক মাসেরও কম সময়ে ৪৫৬ থেকে ৯০০ টাকার ঘর ছাড়িয়ে যাওয়া জেমিনি সি ফুড সংশোধন কাটিয়ে আবার উত্থানে।
তবে এই খাতে সবচেয়ে বড় মূলধনী ও শক্তিশালী মৌলভিত্তির কোম্পানি ব্রিটিশ আমেরিকান ট্যোবাকোর কেবল এক হাজার ৩০টি শেয়ার হাতবদল হয়েছে। দাম ফ্লোর প্রাইসে।
মিউচ্যুয়াল ফান্ডে কেবল দুটির ২০ লাখের বেশি এবং একটির ১০ লাখের বেশি ইউনিট হাতবদল হয়েছে। অভিহিত মূল্যের প্রায় অর্ধেক বা কাছাকাছি দর থাকা বহু ফান্ডের ক্রেতা নেই, যদিও সেগুলোর সম্পদ মূল্য অভিহিত মূল্য বা তার কাছাকাছি আছে।
বীমার কী চিত্র
লেনদেনের শীর্ষে যথারীতি এই খাত। তবে দুই ধরনের বীমা কোম্পানির মধ্যে লেনদেন বেশি হয়েছে জীবন বীমায়।
এই খাতের ১৪ কোম্পানিতে হাতবদল হয়েছে ১৯০ কোটি টাকার বেশি। দর বেড়েছে তিনটির। কমেছে ১০টির। একটির দর ছিল অপরিবর্তিত।
সাধারণ বীমার ৪৩টি কোম্পানিতে লেনদেন হয়েছে ১৪২ কোটি টাকার কিছু বেশি। এর মধ্যে দর বেড়েছে কেবল দুটির। দুটির দর ছিল অপরিবর্তিত। দুটির লেনদেন ছিল স্থগিত, কমেছে বাকি ৩৭টির।
দর বৃদ্ধির শীর্ষে যারা
সবচেয়ে বেশি বেড়েছে, এমন ১০টি কোম্পানি গলো অগ্নি সিস্টেমস, ট্রাস্ট ইসলামী লাইফ ইন্স্যুরেন্স, এডিএন টেলিকম, প্রগতি লাইফ, নর্দান জুট, ইনফরমেশন সার্ভিসেস লিমিটেড, ইমাম বাটন, জেমিনি সি ফুড, ন্যাশনাল টি কোম্পানি ও মেঘটা পেট ইন্ডাস্ট্রিজ।
এর মধ্যে ছয়টি কোম্পানি দর বৃদ্ধির সার্কিট ব্রেকার ছুঁয়ে লেনদেন শেষ করেছে।
পতনের শীর্ষে বীমার প্রাধান্য
সবচেয়ে বেশি দর হারিয়েছে এমন ১০টি কোম্পানির মধ্যে আটটিই বীমা খাতের।
এগুলো হল ইস্টার্ন ইন্সুরেন্স, ইসলামী কমার্শিয়াল ইন্স্যুরেন্স, প্রাইম লাইফ, সন্ধানী লাইফ, কর্ণফুলী ইন্সুরেন্স, ঢাকা ইন্সুরেন্স, ক্রিস্টাল ইন্সুরেন্স এবং চার্টার্ড লাইফ ইন্স্যুরেন্স।
দর পতনের শীর্ষ তালিকার দ্বিতীয় স্থানে ছিল লোকসানি জুট স্পিনার্স এবং চতুর্থ স্থানে ছিল মেট্রো স্পিনার্স।
এসব কোম্পানির দর ৯.০৩ থেকে ৪.৯৮ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।