লন্ডনের ওয়েম্বলি স্টেডিয়ামে বুধবার রাতে ফিনালিস্সিমা নামের আলোচিত ম্যাচটি ৩-০ গোলে জিতে এক বছরের মধ্যে দ্বিতীয় শিরোপা জিতল আর্জেন্টিনা। দুটি গোল হয় প্রথমার্ধে। লাউতারো মার্তিনেস দলকে এগিয়ে নেওয়ার পর ব্যবধান দ্বিগুণ করেন আনহেল দি মারিয়া। শেষ দিকে তৃতীয় গোলটি করেন পাওলো দিবালা।
সেদিনের সেই উৎসবের পর রবের্তো মানচিনির দল যেন হাঁটা ধরেছে পেছন পানে। আচমকা পথ হারিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মতো বিশ্বকাপে উঠতে ব্যর্থ হয় ইতালি। সেই ব্যর্থতা পেছনে ফেলে ম্যাচের আগের দিন নতুন শুরুর ঘোষণা দেন ইতালি অধিনায়ক লিওনার্দো বোনুচ্চি। আর্জেন্টিনাকে হারিয়েই শক্ত ভিত গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন; কিন্তু মাঠে তার প্রমাণ রাখতে পারলেন না মানচিনির শিষ্যরা।
জর্জো কিয়েল্লিনির শেষটা হলো তাই হতাশায়। এই ম্যাচ দিয়েই ইতালির হয়ে সুদীর্ঘ ক্যারিয়ারের ইতি টানলেন ১১৮ ম্যাচ খেলা এই ডিফেন্ডার।
আর আর্জেন্টিনা, তারা তো ছুটে চলেছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। এই জয়ই তার আরেক প্রমাণ। হতে পারে নামে-ভারে এই শিরোপার ওজন তেমন নয়। তবে বছরখানেক আগেও যেখানে চলছিল একটা শিরোপার জন্য হাহাকার, সেই দলটিই গত বছর কোপা আমেরিকা জিতে কাটায় ২৮ বছরের শিরোপা খরা। আর এবার জিতল বিশেষ এই ট্রফি।
হাইভোল্টেজ ম্যাচটির শুরুটা হয় একটু ঢিমেতালে। তবে খানিক বাদেই মেলে গতি, আক্রমণ-পাল্টা আক্রমণে জমে ওঠে ম্যাচ। প্রথম ২০ মিনিটে দুই দল একটি করে হাফ-চান্স পায়, যদিও তার কোনোটিই প্রতিপক্ষ গোলরক্ষকের পরীক্ষা নেওয়ার মতো ছিল না।
২৫তম মিনিটে লিওনেল মেসির শট প্রতিহত হয়। তিন মিনিট পর ডি-বক্সে দারুণ পজিশনে বল পেয়েও গোলরক্ষক বরাবর দুর্বল শট নিয়ে হতাশ করেন পিএসজি তারকা।
দুই মিনিট পর পাল্টা জবাব দেওয়ার সুযোগ পায় ইতালি। কিন্তু নিকোলো বারেল্লা বক্সের বাইরে থেকে শট লক্ষ্যে রাখতে পারেননি। প্রথমার্ধের যোগ করা সময়ে দ্বিতীয় গোল করে চালকের আসনে উঠে বসে আর্জেন্টিনা।
মাঝমাঠে বোনুচ্চির বাধা এড়িয়ে বল পায়ে এগিয়ে কোনাকুনি থ্রু বল বাড়ান লাউতারো মার্তিনেস। সেদিকে ছুটে যান আরেক ডিফেন্ডার কিয়েল্লিনি। কিন্তু তাকে কোনো সুযোগই দেননি দি মারিয়া, চোখের পলকে বক্সে ঢুকে প্রথম ছোঁয়ায় চিপ শটে আগুয়ান গোলরক্ষকের ওপর দিয়ে ঠিকানা খুঁজে নেন পিএসজিকে বিদায় জানানো এই মিডফিল্ডার।
খানিক পর দুই মিনিটে দুবার গোলের সুযোগ তৈরি করেন দি মারিয়া। ৬০তম মিনিটে তার জোরাল শট প্রতিপক্ষের একজনের পায়ে লেগে ক্রসবার ঘেঁষে ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিল, কোনোমতে এক হাত দিয়ে ক্রসবারের ওপর দিয়ে পাঠান গোলরক্ষক। মেসির নেওয়া ওই কর্নারেই বক্সের অনেকটা বাইরে থেকে বুলেট গতির ভলি মারেন দি মারিয়া। তবে গোলরক্ষক বরাবর ছিল বলে ইতালির রক্ষা।
প্রবল চাপ ধরে রেখে পরের কয়েক মিনিটে একের পর এক আক্রমণ করতে থাকে আর্জেন্টিনা। সুযোগও আসতে থাকে অনেক। তিন মিনিটের মধ্যে দুই পাশ থেকে নিচু শটে চেষ্টা করেন মেসি, কিন্তু ঠেকিয়ে দেন দোন্নারুম্মা। মাঝে একবার তার বাড়ানো পাস ছয় গজ বক্সে ফাঁকায় পেয়েও পাশের জালে মারেন লাউতারো মার্তিনেস।
৬৯তম মিনিটে আরও একবার মেসিকে হতাশ করেন দোন্নারুম্মা। সাতবারের ব্যালন ডি’অর জয়ীর জোরাল শট ডানদিকে ঝাঁপিয়ে ঠেকান গোলরক্ষক। পরের ১০ মিনিটে আরও দুটি শট নেন মেসি, কিন্তু মেলেনি তার গোলের দেখা।
পুরো ম্যাচে বল দখলে খুব একটা পিছিয়ে ছিল না ইতালি। তবে আক্রমণে বলা যায় কোনো নিয়ন্ত্রণই ছিল না তাদের। গোলের উদ্দেশ্যে সাতটি শট নিলেও তার অধিকাংশই ছিল এলোপাথাড়ি। বিপরীতে, আর্জেন্টিনা সবসময়ই ছিল বেশ গোছালো। দ্বিতীয়ার্ধে তো তাদের প্রতিটি আক্রমণেই জাগে গোলের সম্ভাবনা।
পুরো ম্যাচেই প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করে রাখা আর্জেন্টিনা গোলের উদ্দেশ্যে মোট ১৯টি শট নেয়, যার মধ্যে আটটি ছিল লক্ষ্যে। নিশ্চিত অনেক সুযোগ নষ্ট না হলে ব্যবধান হতে পারত আরও বড়।
২০১৯ সালের জুলাই থেকে কোনো ম্যাচ না হারা দলটি এই নিয়ে টানা ৩২ ম্যাচ অপরাজিত রইল। নিজেদের ইতিহাসে তাদের আগের রেকর্ড ছিল ৩১ ম্যাচের, ১৯৯১ থেকে ১৯৯৩ সালের মধ্যে করেছিল তারা।
ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়ন ও কোপা আমেরিকা জয়ীর মধ্যে এমন ম্যাচের আয়োজন আগেও দুবার হয়েছে; ১৯৮৫ সালের প্রথম ম্যাচে উরুগুয়ের বিপক্ষে ফ্রান্স জিতেছিল ২-০ গোলে আর ১৯৯৩ সালে ডেনমার্কের বিপক্ষে ১-১ ড্রয়ের পর টাইব্রেকারে জয়োল্লাস করেছিল আর্জেন্টিনা।
সব মিলিয়ে এই নিয়ে ১৬ বার মুখোমুখি হলো ইতালি ও আর্জেন্টিনা। দুই দলেরই জয় ৬ বার করে, বাকি ৪ ম্যাচ ড্র। আর প্রতিযোগিতামূলক ফুটবলে তাদের সবশেষ দেখা হয়েছিল ১৯৯০ বিশ্বকাপ সেমি-ফাইনালে। সেবার ১-১ ড্রয়ের পর টাইব্রেকারে জিতেছিল আর্জেন্টিনা।