দুঃসহ অতীত ভুলে মার্তিনেসের এগিয়ে চলা

আর্জেন্টিনা দলে তারকার ছড়াছড়ি। আছেন ফুটবল ইতিহাসের সেরাদের একজন। তাদের ভিড়ে নিজেকে পাদপ্রদীপের আলোয় আবিষ্কার করাটা একজন খেলোয়াড়ের জন্য স্বপ্নের মতই। গোলরক্ষক এমিলিয়ানো মার্তিনেসের জন্য তো এখন মাঠে প্রতিটি মুহূর্তই স্বপ্নের। বিস্মৃতির অতল গহ্বরে প্রায় হারিয়েই যাচ্ছিলেন। সেখান থেকে ফিরে এসে নিজেকে ছাপিয়ে যাচ্ছেন প্রতিনিয়ত। কোপা আমেরিকার সেমি-ফাইনালে কলম্বিয়ার বিপক্ষে টাইব্রেকারে তিনটি শট ঠেকিয়ে রাতারাতি তারকা বনে যাওয়া মার্তিনেসের জন্য জীবনে প্রতিটি অর্জনই এসেছে অসংখ্য ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 July 2021, 02:00 PM
Updated : 8 July 2021, 02:03 PM

তার ফিরে আসার শুরুটা হয়েছিল গত অগাস্টে। ২০১৯-২০ মৌসুমের এফএ কাপ ফাইনালে চেলসিকে হারিয়ে শিরোপা জিতে উদযাপনে ব্যস্ত আর্সেনালের খেলোয়াড়রা। একজনকে দেখা গেল একটু দূরে। বিজ্ঞাপনের বিলবোর্ডের সামনে কানে হেডফোন দিয়ে কথা বলতে বলতে চোখ ছলছল করছে তার। অশ্রুচোখের সেই খেলোয়াড়টি ছিলেন মার্তিনেস। আট বছর অপেক্ষার পর প্রিয় ক্লাবের হয়ে মাঠে থেকে শিরোপার স্বাদ পাওয়ার আবেগ ধরে রাখাটা তার জন্য কঠিনই ছিল।

২০১০ সালে মার্তিনেসকে আর্সেনালে নিয়ে এসেছিলেন তৎকালীন কোচ আর্সেন ভেঙ্গার। প্রতিভা চিনতে পাকা জহুরির চোখ এই কিংবদন্তির। আর্জেন্টাইন তরুণ গোলরক্ষকের মাঝে দেখেছিলেন বড় তারকা হওয়ার সম্ভাবনা। মার্তিনেসকে তিনি ক্লাবের ভবিষ্যৎ বলেই মনে করতেন এবং ধৈর্য ধরে সুযোগের অপেক্ষায় থাকার জন্য বলতেন।

গুরুর কথা রেখেছিলেন মার্তিনেস। দুই বছর পর মূল দলে অভিষেক হলেও জায়গা পাকা করতে পারেননি। পরের আট বছরে আর্সেনাল তাকে ধারে পাঠিয়েছে ছয়টি ক্লাবে। অবশেষে গত বছর স্থায়ীভাবে যোগ দেন অ্যাস্টন ভিলায়।

অথচ এই আর্সেনালে যোগ দেওয়ার জন্যই মার্তিনেস উপেক্ষা করেছিলেন মায়ের চোখের জল। যদিও সেখানে ভূমিকা রেখেছিল তাদের অর্থনৈতিক অবস্থাও। অভাব অনটনের সংসারে তার বাবাকে হিমশিম খেতে হতো প্রতিদিনের খাবার যোগাতেই। ছেলেকে গ্লাভস কিনে দেওয়ার সামর্থ্যও তার ছিল না। তাই আবেগ ঝেড়ে ফেলে মার্তিনেসকে নিতে হয়েছিল কঠিন সিদ্ধান্ত।

গার্ডিয়ানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে জীবনের সেই সময়ের কথা বলেছিলেন এই গোলরক্ষক।

“আর্থিক দিক থেকে আমার পরিবারকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আর্সেনালের পক্ষ থেকে প্রস্তাব পাওয়ার পর আমার মা আর ভাই কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, ‘আমাদের ছেড়ে যেও না।’ কিন্তু আমি মাঝরাতে বাবাকেও কাঁদতে দেখেছি, তবে সেটা অন্য কারণে। কারণ তিনি বিল পরিশোধ করতে পারছিলেন না। তাই আমাকে সাহসী হতে হয়েছিল, তাদের (আর্সেনাল) প্রস্তাবে সম্মত হতে হয়েছিল।”

শৈশবের কঠিন সময় এবং আর্সেনালে ব্রাত্য হয়ে থাকাটা মার্তিনেসের ভেতর নিজেকে প্রমাণের তাড়না বাড়িয়ে দিয়েছে। তাতে জন্মদিনে ছেলের কাছে না থাকার সিদ্ধান্ত কঠিন হলেও অসম্ভব হয়নি তার কাছে। একই সময়ে কোপা আমেরিকায় দলের সাথে থাকায় তিন বছরের ছেলের জন্মদিন এক সঙ্গে উদযাপন করতে পারেননি। তাই তাকে ধারন করেছেন ভিন্নভাবে, জার্সি নম্বরে! মার্তিনেসের ভাই আলেহান্দ্রো জানালেন বিষয়টি।

“ওর ছেলের জন্মদিন ছিল জুনের ২৩ তারিখ, তাই সে ২৩ নম্বর জার্সি পরে খেলছে। তাকে ১২ নম্বর দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু সে এটা চেয়ে নিয়েছে। সে বাচ্চাকে সব জায়গায় নিয়ে যায়, তিন বছর বয়সেই সে দুর্দান্ত খেলে। সে বাঁহাতি, যা চমৎকার।”

আর্সেনালে যোগ দেওয়ার আগে মার্তিনেস তার বাবাকে কথা দিয়েছিলেন লন্ডনের ক্লাবটির সেরা গোলরক্ষক হবেন তিনি। সেটা যদিও হয়নি, তবে জীবন তাকে সুযোগ করে দিয়েছে অন্যভাবে, দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার।

কদিন আগেও আর্জেন্টিনার দ্বিতীয় পছন্দের গোলরক্ষক ছিলেন মার্তিনেস। ফ্রাঙ্কো আরমানি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ায় মেলে সুযোগ। পোস্টের নিচে উজাড় করে দিয়ে ধীরে ধীরে জায়গাটা করে নিচ্ছেন নিজের। টুর্নামেন্ট জুড়ে দুর্দান্ত পারফরম্যান্সের পর কলম্বিয়ার বিপক্ষে টাইব্রেকারে দেখিয়েছেন ঝলক। তার বীরত্বে লিওনেল স্কালোনির দল ২৮ বছরের শিরোপা খরা কাটানোর পথে এগিয়ে গেছে আরেক ধাপ।

স্বপ্ন পূরণের চূড়ান্ত ধাপ পূরণ হবে যদি ফাইনাল শেষে ট্রফি উঁচিয়ে ধরার সুযোগটা পান। প্রতিপক্ষ চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিল, খেলা মারাকানায়-এমন মঞ্চে ছেলেকে বিজয়ীর বেশে দেখে মার্তিনেসের বাবা নিশ্চয় আবারো কাঁদবেন। তবে এবার আনন্দে, ছেলের অর্জনের গর্বে। মার্তিনেস কি পারবেন? জবাব মিলবে দুদিন পর।