বড় মঞ্চে সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছে সুইজারল্যান্ড

প্রায় এক দশক ধরে ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে উপরের দিকে সুইজারল্যান্ডের নিয়মিত অবস্থান দেখে হয়তো অনেকেই অবাক হয়েছে। হ্যাঁ, এটাও ঠিক যে র‌্যাঙ্কিংয়ের অবস্থান দিয়ে সবসময় সব দলের শক্তির পরখ মেলে না। তবে এবারের ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে নজরকাড়া পারফরম্যান্স দিয়ে, নতুন ইতিহাস গড়ে সুইজারল্যান্ড তাদের সামর্থ্যের প্রমাণ দিয়েছে।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 July 2021, 03:54 PM
Updated : 3 July 2021, 03:54 PM

২০১২ সালের পর থেকে সুইসরা কখনোই ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে ১৬তম স্থানের নিচে নামেনি। প্রায়ই তাদের দেখা গেছে অনেক প্রতিষ্ঠিত শক্তিশালী দলের উপরে। বর্তমানে যেমন তাদের অবস্থান ত্রয়োদশ স্থানে; চারবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন জার্মানির মাত্র এক ধাপ নিচে আর নেদারল্যান্ডসের তিন ধাপ উপরে।

গত দেড় যুগের বেশি সময় ধরে ইউরো কিংবা বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব পেরুনো তাদের জন্য তেমন কোনো সমস্যা হয়নি। ২০০৪ সাল থেকে ৯টি মেজর টুর্নামন্টের আটটিতেই মূল পর্বে খেলেছে তারা।

২০১৮-১৯ মৌসুমে উয়েফা নেশন্স লিগের অভিষেক আসরে নিজেদের গ্রুপে বেলজিয়ামকে পেছনে ফেলে চার দলের ফাইনালসেও উঠেছিল সুইজারল্যান্ড।

কিন্তু মেজর টুর্নামেন্টের মূল পর্বে বারবার খেই হারিয়ে ফেলছিল দলটি, পেরুতে পারছিল না শেষ ষোলোর বাধা। অবশেষে সেই গেরো কাটল এবার এবং কী দুর্দান্তভাবে!

দেশের মাটিতে ১৯৫৪ বিশ্বকাপে সেই যে কোয়ার্টার-ফাইনালে উঠেছিল সুইজারল্যান্ড, তারপর ৬৭ বছরের অপেক্ষা শেষে এবার ইউরোয় শেষ আটে খেলল তারা। অবশ্য এবারই প্রথম নকআউট পর্বের প্রথম ধাপ পেরুল দলটি।

ইতোমধ্যে অবশ্য চলমান মহাদেশীয় এই টুর্নামেন্টে তাদের স্বপ্নের পথচলা থেমে গেছে, স্পেনের বিপক্ষে টাইব্রেকারে হেরে।

তবে শেষ ষোলোয় প্রত্যাবর্তনের যে অসাধারণ এক গল্প লিখে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ফ্রান্সকে বিদায় করে দেয় জাকা-সাচিরি-সমেররা, তা ফুটবলপ্রেমীদের মনে থাকবে অনেক দিন।

ওই ম্যাচে দ্বিতীয়ার্ধের শুরুর দিকে দুই মিনিটে দুবার জালে বল পাঠিয়ে ম্যাচের নিয়ন্ত্রণ নেয় ফ্রান্স। মিনিট পনের পর স্কোরলাইন ৩-১ করে সহজ জয়ের পথেই ছিল তারা। এরপরই নাটকীয়ভাবে ঘুরে দাঁড়ায় সুইসরা; ৯ মিনিটে দুই গোল করে ম্যাচ নেয় অতিরিক্ত সময়ে।

অবশ্য শুধু স্কোরলাইনে তাদের ঘুরে দাঁড়ানোর যে মাহাত্ম তা বোঝা যায় না। ৮১তম মিনিটে হারিস সেফেরোভিচের বুলেট হেডে ব্যবধান কমানোর পর যেন তেতে উঠেছিল দলটি। বিশ্বাস করেছিল যে তারা পারবে, তারই ফল ৯০তম মিনিটে মারিও গাভরানোভিচের নিখুঁত শট।

এরপর অতিরিক্ত সময় পেরিয়ে টাইব্রেকারে ব্যবধান গড়ে দেন টুর্নামেন্ট জুড়ে দুর্দান্ত খেলা গোলরক্ষক ইয়ান সমের।

ওই জয়েই যেন আসল রূপে ধরা দেয় সুইজারল্যান্ড। কোয়ার্টার-ফাইনালেও তারা পরিষ্কারভাবে ছিল আন্ডারডগ; রাশিয়ার সেন্ত পিতার্সবুর্গে তাদের ছিটকে যাওয়াটাই প্রত্যাশিত ছিল। হয়েছেও তাই। কিন্তু তার আগে তিনবারের ইউরোপ চ্যাম্পিয়নদের কাঁপিয়ে দিয়েছে তারা।

ভ্লাদিমির পেতকোভিচের শিষ্যরা স্পেনের বিপক্ষে নিজেদের গুছিয়ে নিতে একটু সময় নেয়। ম্যাচের শুরুতে দুর্ভাগ্যবশত গোলও খেয়ে বসে তারা। দ্বিতীয়ার্ধে সমতা টানেন জেরদান সাচিরি। এর খানিক পরই বড় ধাক্কাটা খায় সুইজারল্যান্ড; লাল কার্ড পেয়ে মাঠ ছাড়েন ফ্রয়লার। একেতো দলে এক জন কম, তার উপর প্রতিপক্ষ ভীষণ শক্তিশালী র‌্যাঙ্কিংয়ের ৬ নম্বর দল।

তবে এই সুইজারল্যান্ড তো ভিন্ন এক দল, যারা হাল ছাড়তে জানে না। আরও একবার দারুণভাবে নিজেদের মেলে ধরে তারা। ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। মুহুর্মুহু আক্রমণে তাদের রক্ষণকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে স্পেন; কিন্তু রক্ষণাত্মক কৌশলে ঘর সামলে রাখে সুইজারল্যান্ড। অতিরিক্ত সময়ের প্রথম ১৫ মিনিটেই ১০ শট নেয় আলভারো মোরাতা-জেরার্দ মরেনোরা। কিন্তু মাঝেমধ্যে রক্ষণ ভাঙতে পারলেও শেষ বাধা সমেরকে ফাঁকি দেওয়া যায়নি।

টাইব্রেকারে এবার অবশ্য আর নায়ক হয়ে উঠতে পারেননি সমের। তার সতীর্থরাও পারেনি ফ্রান্স ম্যাচের মতো নিখুঁত শট নিতে। তাদের ছিটকে স্পেন উঠেছে পরের ধাপে। তবে, এই সুইজারল্যান্ড জানে তারা সামর্থ্যের সবটুকু নিংড়ে দিয়েছে।

টাইব্রেকার নামক ওই ‘ভাগ্য পরীক্ষায়’ নিজ দেশের হারের পর সুইস ব্রডকাস্টার ‘আরএসআই’ বলে, “যেন স্বপ্ন থেকে জেগে উঠলাম।”

পেতকোভিচ কখনোই তেমন জনপ্রিয় কোচ ছিলেন না, যদিও ২০১৪ সাল থেকে তিনিই আছেন দলটির দায়িত্বে। তার এই মেয়াদকালেই দলটির গুরুত্বপূর্ণ দুই খেলোয়াড় সেফেরোভিচ ও গ্রানিত জাকা দীর্ঘদিন নিজেদের হারিয়ে খুঁজছিলেন, এবারের ইউরোর শুরুর দিকেও তাই ছিল।

ফ্রান্স ম্যাচে পাল্টে যায় সব। সেফেরোভিচের জোড়া গোলেই ম্যাচে ফিরেছিল সুইজারল্যান্ড। আর প্রতিপক্ষে পল পগবা ও এনগোলো কঁতের মতো বিশ্বসেরাদের বিপক্ষে বেশ খানিকটা সময় মাঝমাঠ নিয়ন্ত্রণ করেন জাকা।

তার অনুপস্থিতি স্পেনের বিপক্ষে সুইসদের জন্য ছিল অবশ্যই বড় ধাক্কা; তবে সেই বাধা তাদের মেলে ধরতে আটকাতে পারেনি।

ম্যাচের পর সাচিরি বলেন, “পেনাল্টি শুট আউট সবসময়ই ৫০-৫০ সম্ভাবনা। আমার মনে হয়, আজ আমাদের শুধু একটা সৌভাগ্যের কমতি ছিল। দলকে নিয়ে আমি গর্বিত।” 

দেশের মানুষকেও গর্বিত করেছে এই সুইজারল্যান্ড দল। ইউরোর মঞ্চে তারা যে আত্মবিশ্বাস পেল, তাতে ভর করে এখন বড় প্রতিযোগিতায় নিয়মিত জ্বলে ওঠার পালা দলটির।