জিকোর তুষ্টি, আক্ষেপ ও প্রতিশ্রুতি

অপেক্ষা ছিল একটি সুযোগের। প্রত্যয় ছিল নিজেকে মেলে ধরার। শক্তিশালী কাতারের বিপক্ষে মিলল সুযোগ। শুরুর মঞ্চে স্নায়ুচাপের কাছে হার মানেননি, সাহস হারাননি আনিসুর রহমান জিকো। পাঁচবার পরাস্ত হয়েছেন বটে, কিন্তু বাংলাদেশের পোস্টের নিচে ম্যাচজুড়ে আক্রমণের ঝড় সামলে কুড়িয়ে নিয়েছেন সবার প্রশংসা। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সঙ্গে আলাপচারিতায় তরুণ এই গোলরক্ষক অপেক্ষা, সুযোগ, প্রাপ্তি, কাতার ম্যাচের আক্ষেপ নিয়ে বললেন অনেক কথা।

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Dec 2020, 09:55 AM
Updated : 5 Dec 2020, 10:07 AM

দোহার আব্দুল্লাহ আল খলিফা স্টেডিয়ামে শুক্রবার ২০২২ বিশ্বকাপ ও ২০২৩ এশিয়ান কাপের বাছাইয়ের ‘ই’ গ্রুপের প্রিলিমিনারি রাউন্ডের দ্বিতীয় ধাপের ম্যাচে ৫-০ গোলে হারে বাংলাদেশ। এ ম্যাচেই বাছাইয়ে প্রথম দলের পোস্টের নিচে দাঁড়িয়েছিলেন জিকো, প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচে প্রথম।

দেশে থাকতে গত নভেম্বরের মাঝামাঝি নেপালের বিপক্ষে প্রথম প্রীতি ম্যাচে জাতীয় দলের হয়ে জিকোর অভিষেক। এরপরই কাতারের বিপক্ষে কঠিন পরীক্ষায় বসলেন ২৩ বছর বয়সী এই গোলরক্ষক। কোচ জেমি ডে থেকে শুরু করে ফুটবলপ্রেমীদের কাছ থেকে পেলেন ‘পাস মার্কস’।

বিশ্বাসই হয়নি কাতারের বিপক্ষে খেলব

ক্যাম্পের দলে গোলরক্ষক ছিল চারজন। আশরাফুল ইসলাম রানা, শহীদুল আলম সোহেল, জিকো ও পাপ্পু হোসেন। চোটে আগেই ছিটকে যান সোহেল। বাকি তিন জনের মধ্যে অভিজ্ঞতায় এগিয়ে ছিলেন রানা। কিন্তু ডে বেছে নেন বসুন্ধরা কিংসের গোলরক্ষক জিকোকে।

“জাতীয় দলে আমি অনেক দিন ধরে আছি, কিন্তু সুযোগ পাচ্ছিলাম না ম্যাচ খেলার। নেপালের বিপক্ষে অভিষেকের পর কাতারের বিপক্ষে যে খেলব, সত্যি বলতে আমি বিশ্বাসই করতে পারছিলাম না। কারণ আমার আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতা ছিল না তেমন একটা। হয়ত লিগে এবং এএফসি কাপে আমার পারফরম্যান্স দেখে খুশি হয়েছিলেন কোচ।”

“কিন্তু কোচ যখন আমাকে সুযোগ দিলেন, তখন ভাবলাম সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে। অনেক দিন ধরে বন্ধু-বান্ধবসহ অনেকে জিজ্ঞেস করত-কবে দেশের হয়ে খেলবে? আমি কিছু বলতে পারতাম না। তাই ভেতরে ভেতরে এই তাগিদটা ছিল, সুযোগ পেলে যেন আস্থার প্রতিদান দিতে পারি। কাতার ম্যাচে সে চেষ্টাই করেছি।”

ভেবেছিলাম, ম্যাচ শেষ করে আসতেই হবে

দোহায় শুরু থেকে পোস্টের নিচে বিরামহীন ছোটাছুটি করতে হয়েছে। কাতারের করা ১৫টি আক্রমণ ছিল পোস্টে। ১০টি সামলেছেন জিকো। এরমধ্যে কয়েকটি সেভ এককথায় দারুণ। ৩১তম মিনিটে দ্বিতীয় গোল হজমের আগ মুহূর্তে আকরাম হাসান আফিফের শট শেষ মুহূর্তে পা বাড়িয়ে আটকেছিলেন।

৫৫ তম মিনিটে রক্ষণের ভুলে বল পাওয়া আলাদিনের প্রচেষ্টা ফেরান কর্নারের বিনিময়ে। ৬৪তম মিনিটে দূরপাল্লার একটি শট অনেকটা লাফিয়ে ফিস্ট করে নিশ্চিত গোল বাঁচিয়েছেন। আল মোয়েজ আলির স্পট কিকের সময়ও ছিলেন বলের লাইনে। কিন্তু ঝাঁপিয়ে পড়ে হাত বাড়িয়েও শেষ রক্ষা হয়নি; হাত ছুঁয়ে বল জালে জড়ায়। ৬৪তম মিনিটের ওই সেভ করতে গিয়ে পেশিতে ব্যথা পেয়ে মাঠে কিছুটা সময় পড়ে ছিলেন জিকো। কিন্তু পণ ছিল ম্যাচ শেষ করে আসার।

“ওই মুহূর্তে পায়ে বেশ সমস্যা হচ্ছিল। বেশ ব্যথা টের পাচ্ছিলাম। তখন মনে হচ্ছিল খেলতে পারব না। কিন্তু ট্রেনার বললেন এ মুহূর্তে নতুন গোলরক্ষক এলে তার মানিয়ে নিতে সময় লাগবে। তখন আমিও চাইনি দলের সমস্যা হোক। যেভাবেই হোক ম্যাচটা ভালোভাবে শেষ করে আসতে হবে। বাঁ পায়ের ঊরুর পেশিতে এখনও ব্যথা আছে।”

বেশি গোল হজমের আক্ষেপ

কাতারের আধিপত্য বোঝাতে কিছু পরিসংখ্যানই যথেষ্ট। তাদের বলের নিয়ন্ত্রণ ছিল ৭৬ শতাংশ। বাংলাদেশের পায়ে বল ছিল ২৪ শতাংশ, তা আক্রমণ ফেরানোর সময়ই বেশি। কাতারের ১৪টি কর্নারের বিপরীতে বাংলাদেশ পায় মাত্র ১টি। খেলাও হয়েছে মূলত বাংলাদেশের অর্ধে।

প্রথমার্ধে দুই গোলে পিছিয়ে পড়া বাংলাদেশ দ্বিতীয়ার্ধে হজম করে তিনটি। এশিয়ার চ্যাম্পিয়নদের মাঠে এই ফল অনুমিতই। তবে জিকো ঠিক মানতে পারছেন না। চারদিক থেকে সবার প্রশংসা পেলেও ভরছে না মন।

“কাতার আমাদের চেয়ে অনেক শক্তিশালী দল। তারা অনেক এগিয়ে, তারা জিতবে, কিন্তু গোল আরেকটু কম হলে ভালো লাগত। বাছাইয়ে প্রথম ম্যাচ খেললাম, যতটুকু খেলেছি, সবার প্রশংসা পাচ্ছি। ভালো লাগছে। কিন্তু স্কোরলাইন দেখে খুশি হতে পারছি না, গোল আরেকটু কম হলে খুশি হতাম।”

আস্থার প্রতিদান দিয়ে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়

২০১৭-১৮ মৌসুমের লিগে সাইফ স্পোর্টিংয়ে খেলার পর বসুন্ধরা কিংসে নোঙর ফেলেন জিকো। সেই থেকে দলটির প্রথম পছন্দের গোলরক্ষক। পোস্টের নিচে আস্থার প্রতিদান দিয়ে ফেডারেশন কাপ, স্বাধীনতা কাপ ও প্রিমিয়ার লিগের স্বাদ পেয়েছেন। এএফসি কাপেও সপ্তাহের সেরার স্বীকৃতিও মিলেছে এরই মধ্যে। ক্লাবের গন্ডি পেরিয়ে জাতীয় দলের জার্সিতে আলো ছড়াতে শুরু করেছেন জিকো।

বাছাইয়ে এখনও তিনটি ম্যাচ বাকি বাংলাদেশের। তিনটিই নিজেদের মাঠে। কক্সবাজার থেকে উঠে আসা এই গোলরক্ষক শিখতে চান সামনের দিনগুলোতে। জর্ডান পিকফোর্ড, মানুয়েল নয়ার, মার্ক আন্ড্রে-টের স্টেগেনের মতো হয়ে উঠতে চান নির্ভরতার প্রতীক।

“বাছাইয়ের বাকি ম্যাচগুলোর দেরি আছে। ওই ম্যাচগুলোতে কোচ আমাকে খেলাবেন কিনা, তা তো জানি না। কিন্তু আমি চেষ্টা চালিয়ে যাব। শেখার মধ্যে থাকব। যাতে যখনই সুযোগ আসবে, যেন নিজের সেরাটা দিতে পারি।”

“জাতীয় দলের নতুন গোলরক্ষক কোচ (লেস ক্লিভেলি) এসেছেন। তার কাছ থেকে পজিশন, সেন্স, ক্রসবল, ভুল করলে তা থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসার উপায়-এমন আরও অনেক কিছু, নতুন কিছু শিখছি। কিংসেও আমরা নিয়মিত অনুশীলনের মধ্যে থাকি। এগুলো ভবিষ্যতে কাজে লাগবে। পিকফোর্ড আমার আইডল। নয়ার-টের স্টেগেনকেও খুব অনুসরণ করি। তাদের মতোই হতে চাই, ভবিষ্যতে দেশকে ভালো কিছু দিতে চাই।”