ভারতীয়দের ‘ওপেন চ্যালেঞ্জ’ দিয়ে সোনা জিতেছিলেন মিজান!

“এসএ গেমসের মজার ঘটনা শুনতে চাই”, বলতেই কারার মিজান হাসতে থাকেন। সে হাসিতে প্রতিপক্ষের মুখের গ্রাস কেড়ে নেওয়া আনন্দের লুকোচুরি খেলা। এক লহমায় সোনা জয়ী এই সাঁতারু ফিরে যান ২৫ বছর পেছনে; মাদ্রাজের সুইমিংপুলে। বুকভরা গর্ব নিয়ে বলতে থাকেন ‘ওপেন চ্যালেঞ্জ’ দিয়ে ভারত থেকে সোনা জিতে দেশে ফেরার গল্প।

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 May 2020, 10:21 AM
Updated : 6 May 2020, 10:21 AM

করোনাভাইরাস প্রকোপের এই মন খারাপ করা সময়ে দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে (এসএ গেমস) বাংলাদেশের সোনা জয়ী অ্যাথলেটরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম’কে শোনাচ্ছেন তাদের স্মৃতিময় দিনগুলোর গল্প। কারার মিজান ফিরে তাকালেন দুই যুগেরও বেশি সময় পেছনে। শোনালেন স্মৃতির মণিকোঠায় জমে থাকা অজানা কাহিনী।

দক্ষিণ এশিয়ার সর্বোচ্চ ক্রীড়া আসরে শুটিংয়ের পর সাঁতার বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে সফল ডিসিপ্লিন। ১৩টি আসর মিলিয়ে এ ডিসিপ্লিন থেকে প্রাপ্তি ১৭টি সোনা। কিন্তু মিজান-মোখলেসদের জন্য ১৯৯৫ সালের মাদ্রাজ গেমস স্বস্তির ছিল না মোটেও।

আঞ্চলিক সাঁতারে ভারতের দাপট সবসময়ই বেশি। মাদ্রাজেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। সেবার ২৬টি ইভেন্টের ১৫টিরই সোনা জিতেছিল তারা। তবে শুরু থেকে ভারতের সাঁতারুদের শ্যেনদৃষ্টি ছিল ২০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকের দিকে। ১৯৯৩ সালে কলম্বোতে এই ইভেন্টে সেরা হওয়ায় ‘ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়নের’ মুকুট ছিল যে মিজানের মাথায়।

মাদ্রাজে ভারতের সাঁতারুদের একের পর এক সাফল্যে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীরাও রীতিমতো উড়ছিলেন। কানাঘুষা নয়, প্রকাশ্যেই শুনিয়ে দিচ্ছিলেন, ২০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোকের সোনা পেলেই এবার পূরণ হবে একশতে একশর কোটা। মিজান ভারতীয়দের আশার গুঁড়ে ঢেলে দিলেন বালি। তাও সুইমিংপুলে নামার আগে রীতিমতো ঘোষণা দিয়ে!

“সাঁতারের সব সোনা নিয়ে যাচ্ছিল ভারত। যতদূর মনে পড়ে, আমার ২০০ মিটার ব্রেস্টস্ট্রোক ইভেন্টের আগে ৮/৯টা জেতা হয়ে গেছে ওদের। ওদের সাংবাদিকরা তো বলাবলি শুরু করে দিল, আমারটা জিতলেই সাঁতারের সবগুলো ওদের হয়ে যাবে। তখন আমি ওপেন চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলাম-এই ইভেন্টের সোনা আমিই জিতব।”

“কলম্বো এসএ গেমসে জিতেছিলাম বলে এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলাম যে ওদের বলে দিয়েছিলাম-আমার কাছ থেকে কেউ এটা কেড়ে নিতে পারবে না। যদি তোমরা চাও, এখনই তোমাদের সাঁতারুদের সঙ্গে লড়াইয়ে নামতে পারি।”

ঘোষণা দিয়ে নীল জলে নেমে পরে ঠিকই ঝড় তুললেন মিজান। ২ মিনিট ৩২ দশমিক ০৫ সেকেন্ড সময় নিয়ে বাজিমাত করলেন। ছাপিয়ে গেলেন কলম্বোর টাইমিং (২ মিনিট ৩৪ দশমিক ৭২ সেকেন্ড)। দেশের প্রথম সাঁতারু হিসেবে এ ইভেন্টে টানা দুই আসরে সেরা হওয়ার কীর্তিও গড়লেন কিশোরগঞ্জের নিকলী থেকে উঠে আসা এই সাঁতারু। নীল হয়ে গেল ভারতের একশতে একশ’র স্বপ্ন।

১৯৯৩ এসএ গেমস নিয়েও স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দিলেন উন্নত জীবনের আশায় বাংলাদেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে থিতু হওয়া মিজান। প্রথম সোনা জয়ের আগের রাত নিয়ে বলতে গিয়ে হয়ে পড়লেন স্মৃতিকাতর। জানালেন, ওই বছর কলকাতায় সাফ সুইমিং চ্যাম্পিয়নশিপে সেরা হওয়ার পর প্রথম ‘আয়’ করার গল্পও।

“তখন মেট্রিকে পড়ি। চিন্তা-টিন্তা অতটা করতাম না। এমন রিল্যাক্স মুডে ছিলাম যে ১৯৯৩ সালের সাফ গেমসে নিজের ইভেন্টের কথাই আগের রাতে ভুলে গিয়েছিলাম! সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর মনে পড়ল…আরে আমার তো ইভেন্ট আছে আজ! কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে আমি চুপচাপ ওয়ার্মআপে নেমে গেলাম! (হাসি)”

“ওই বছরই কলকাতায় সাফ সুইমিং চ্যাম্পিয়নশিপে খেলতে গিয়ে সেরা হয়েছিলাম। জাপানি কোচ তাকাহিরো তাকুচি ২০ ডলার উপহার দিয়েছিল। সেটাই ছিল জীবনের প্রথম ডলার কামাই। নিউইয়র্কে থাকি, আয়-রোজগার, লেনদেন এখন সবই ডলারে, কিন্তু সেই প্রথম ডলার আয়ের কথা আজও মনে আছে।”

পরবাস জীবনে মিজানের আরও মনে পড়ে কিশোরগঞ্জের নিকলী গ্রাম। ছায়াঘেরা যে গ্রামটির আলো-বাতাসে বাংলাদেশের অনেক তারকা সাঁতারুর জন্ম; বেড়ে ওঠা। মনে পড়ে বাংলাদেশ নৌবাহিনী; বাংলাদেশ ক্রীড়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিকেএসপির সবুজ আঙিনা, প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশকে।

স্ত্রী ও দুই ছেলে নিয়ে নিজের মত করে জীবনটাকে গুছিয়ে নিয়েছেন মিজান। দুই ছেলের কেউ সাঁতারে পা রাখেনি। ভালোবাসে বাস্কেটবল। এ নিয়ে কোনো আক্ষেপ নেই মিজানের। ব্যস্ত জীবনের প্রয়োজন মেটাতে প্রতিদিন ছুটতে হয় বলে আক্ষেপের সময়ই বা কই! স্মৃতিচারণ শেষে একটু দীর্ঘশ্বাস নিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে মিজান বললেন-যেগুলো এখনও মনে পড়ে, বল্লাম। এখন ছুটতে হবে। ভালো থাকবেন।