‘অর্থাভাবেই ঝরে যায় ৬০-৭০ ভাগ ফুটবলার’

মাঠ নেই। অর্থ নেই। নেই সময়োপযোগী পরিকল্পনা। সীমাবদ্ধতা অনেক। বরং লেপ্টে আছে ম্যাচ গড়াপেটার কালি। বরাবরই সঙ্গী আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও স্বজনপ্রীতির অভিযোগ। আছে ঘরোয়া ফুটবলের সর্বোচ্চ সংস্থার উদাসীনতাও। পাইওনিয়ার থেকে শুরু করে তৃতীয়, দ্বিতীয়, প্রথম বিভাগ ও বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে শেষ নেই সমস্যার। এই পর্যায়ে কাজ করা কোচ রেজাউল হক জামাল জানালেন অনেক অভিযোগ-অনুযোগ। দিলেন সঙ্কট থেকে উত্তরণের পরামর্শও।

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 12 April 2020, 07:33 AM
Updated : 12 April 2020, 07:33 AM

ঘরোয়া ফুটবলের এই পর্যায়ের নানা সমস্যা ও সমাধানের পথ নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর সঙ্গে কথা বলেছেন একাধিক কোচ। তাদের কথায় উঠে এসেছে ফুটবলার তৈরির এই ধাপগুলোর নানা সাদা-কালো দিক। ধারাবাহিক এই আয়োজনে কোচ জামাল জানিয়েছেন তার ভাবনা।

১৫ বছরের কোচিং ক্যারিয়ারে ২০০৭ সালে ‘ক্যানেরি ওয়ার্ফ ইউকে ফুটবল’ প্রকল্পটি খুলে দিয়েছিল জামালের ভাবনার নতুন দুয়ার। ওই প্রকল্পে তিনি ছিলেন সহকারী কোচ। আদর্শ ফুটবল তৈরির মধ্যবর্তী পর্যায়ে (পাইনিওয়ার থেকে চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ পর্যন্ত) অপরিহার্য করণীয়গুলো খুব কাছ থেকে দেখা ও শেখার সুযোগ মিলেছিল হাতে কলমে। ইংল্যান্ড থেকে আসা ওই প্রকল্পের সঙ্গে ঘরোয়া ফুটবলের মধ্যবর্তী পর্যায়ের খেলোয়াড় তৈরি মানের ব্যবধানটা তাই পরিষ্কার পড়তে পারেন ৫৩ বছর বয়সী এই কোচ।

‘অভাবে ঝরে যায় ৬০ থেকে ৭০ ভাগ’

জাতীয় দলের গোলরক্ষক শহীদুল আলম সোহেল, মিডফিল্ডার সোহেল রানাসহ অনেক ফুটবলার উঠে এসেছেন ওই প্রকল্প থেকে। খেলোয়াড়দের জন্য তখন পর্যাপ্ত অনুশীলন ও পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা ছিল। প্রতিবন্ধকতা যে ওই প্রকল্পেও একেবারে ছিল না, তা নয়। কিন্তু সেই তুলনায় বর্তমানের পাইওনিয়ার লিগ কিংবা তৃতীয়-দ্বিতীয় বিভাগের উঠতি খেলোয়াড়দের জন্য সুযোগ-সুবিধা নেই বললেই চলে।

ক্যানেরি ওয়ার্ফের প্রকল্পে কাজ করার সময়ই উঠতি ফুটবলারদের অনেকের পারিবারিক অবস্থা ও আর্থ-সামাজিক বাস্তবতার একটি ধারণা পেয়েছিলেন কোচ জামাল।

“ওই সময়ে আমরা বিকেএসপিতে ট্রেনিং করাতাম। জাতীয় দল সেখানে গেলে আমরা জায়গা পেতাম না, খেলোয়াড়দের ছুটি দিয়ে দিতাম। এরপর যখন ওরা ফের ক্যাম্পে আসত, দেখতাম ফিটনেস থেকে শুরু করে অনেক কিছুই আর আগের পর্যায়ে নেই।”

“তখনই উপলব্ধি করলাম ওরা কোন পরিবেশ থেকে এসেছে। আবারও নতুন করে অনেক কিছু শুরু করতে হত। তারপরও ভাগ্য ভালো, ওই প্রকল্পের আওতায় অনেক সুবিধা পেয়েছিল খেলোয়াড়রা, যে কারণে উঠতে পারল ওপরে।”

ক্লাবের অর্থ সঙ্কট ও পারিবারিক বাস্তবতা মিলিয়ে সিংহভাগ ফুটবলার ঝরে যায় বলে মনে করেন জামাল।

“পাইওনিয়ারে ছেলেরা আসে ক্লাব, মহল্লার মাধ্যমে। নিম্ন শ্রেণী থেকে আসা এই খেলোয়াড়রা বাড়িতে গেলে কখনও এক গ্লাস দুধ বা একটা ডিম পায় না। অনেক ক্ষেত্রে ক্লাবগুলো বেশি খেলোয়াড় রাখতে চায় না খরচের কারণে।”

“দেখা যাচ্ছে, ৩০ জনের মধ্যে ২৫ জনকে বেছে নিলাম। কিন্তু ক্লাব বলল, ‘আরও কমাও, এত খরচ দেওয়ার সামর্থ্য নাই।’ তখন দুই জন খেলোয়াড় যাদের মানের ব্যবধান ১৯-২০, বাধ্য হয়ে ১৯টাকে বাদ দিতে হলো। এভাবেও সম্ভাবনাময় অনেকে ঝরে যায়। মূলত অভাবের কারণেই ৬০-৭০% ঝরে যায়।”

মোহাচ্ছন্ন উদ্যোক্তা, অসচেতন খেলোয়াড়

সাফল্যের কোনো ‘শর্টকাট’ রাস্তা নেই। এই পর্যায়ের ফুটবলেও সেটি খুবই সত্যি। কিন্তু অনেক উদ্যোক্তারই চাওয়া থাকে তরিত্ব সাফল্য। মোহ কেটে গেলেই তারা সটকে পড়েন। সত্যিকার অর্থেই নিবেদিত ফুটবল সংগঠকের অভাবকে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা মনে করেন কোচ জামাল।

“অনেকে নামের জন্য ক্লাব গড়তে আসে। বাফুফের মেম্বার হতে চায়, ভোট দেওয়ার অধিকার চায়। কিন্তু যখন দেখে শর্টকাট রাস্তা নাই, ২০টা ছেলে নিয়ে কমপক্ষে দুই বছর কাজ করতে হবে, সেখান থেকে দুই-তিনজন উঠে এলে সাফল্য মিলবে, এরকম দীর্ঘমেয়াদে ভাবনার ব্যাপার এলেই তাদের মোহ কেটে যায়।”

নিবেদনের ঘাটতি দেখা যায় অনেক উঠতি ফুটবলারেরও। নিজেদের মানসিকতা ও সামাজিক বাস্তবতায় অনেক খেলোয়াড় সম্ভাবনার কুঁড়ি নিজ পায়ে দলে বেছে নেন ধ্বংসের পথ। কোচিংয়ের পথচলায় এসব অনেক ঘটনার স্বাক্ষী গত চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে ঢাকা সিটি ফুটবল ক্লাবের দায়িত্বে থাকা জামাল।

“ছেলেদের কমিটমেন্ট এবং সচেতনতার অভাবও আছে। এই তো গতবার সিলেট থেকে একটা ছেলেকে আনলাম। তৃতীয় বিভাগে খেলল। কিন্তু থাকল না। বলল, ‘এর চেয়ে আমি তো খ্যাপ খেললে বেশি টাকা পাব!’ অনেকে আসে একেবারে অপেশাদার মানসিকতা নিয়ে, বোঝেও না কিভাবে নিজেদেরকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।”

সবার চাওয়া একটু নিশ্চয়তা

ফরাশগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাব, ফেনী সকার, চট্টগ্রাম আবাহনীর মতো ক্লাবে কাজ করেছেন কোচ জামাল। ২০১৮ সালে যাত্রাবাড়ি ঝটিকা ক্লাব তৃতীয় বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল তার হাত ধরে। ফরাশগঞ্জ উঠেছিল প্রিমিয়ার লিগে। ফুটবলের সার্বিক উন্নতির জন্য অভিজ্ঞতার ঝুলি থেকে দুটি পরামর্শ দিলেন জামাল।

“ক্লাবগুলোকে একটা আর্থিক নিশ্চয়তার মধ্যে রাখতে হবে। কোচ, খেলোয়াড়, বলবয়কেও নিশ্চয়তা দিতে হবে। ক্লাবকে বলতে হবে-সীমাবদ্ধতার মধ্যে তোমাকে ১০-২০টা খেলোয়াড় দিলাম, সময় নিয়ে এদেরকে গড়ে তোলো। আমরাও ওদের দীর্ঘমেয়াদে ধরে রাখতে পারলাম, যত্ন করতে পারলাম, তাহলে পরিবর্তন আসবে। জাতীয় দলে কখনও ভালো খেলোয়াড়ের অভাব হবে না।”

জামালের কথায় আবারও বড় গুরুত্ব পেল ফুটবলার পুষ্টিকর খাবারের দিকটি।

“৯০ মিনিটের খেলোয়াড় তৈরি জন্য দ্বিতীয়-তৃতীয় বিভাগে ফুড সাপোর্ট দিতে হবে। যদি তারা নিউট্রিশন না পায়, তাহলে কিভাবে পুরো দমে অনুশীলন করবে? সোজা বাংলায়, আমি তাকে পেটে দিব না, পিঠে কিলাব কিভাবে?”

“৯০ মিনিটের খেলোয়াড় তৈরির জন্য একটা প্রকল্প থাকা উচিত। কেননা, সবাই তো মেধাবী হবে না। পরিশ্রমী খেলোয়াড়ও দরকার ভালো ফুটবলের জন্য।”