বিদায়বেলায় অনেক প্রশ্ন রেখে গেলেন রোমান সানা

বঞ্চনা, না পাওয়ার হতাশা, অভিযোগ, আর্থিক অনটনের করুণ বাস্তবতা- মনের আগল খুলে বাংলাদেশের আর্চারির সবচেয়ে বড় তারকা বললেন অনেক কথা।

মোহাম্মদ জুবায়েরমোহাম্মদ জুবায়েরবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 3 March 2024, 07:16 PM
Updated : 3 March 2024, 07:16 PM

কখনও ফেললেন দীর্ঘশ্বাস। কখনও তার কণ্ঠে এতদিনের জমে থাকা রাগ-ক্ষোভের প্রবল উদগীরণ। হঠাৎ অবসর নিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া দীর্ঘ সাক্ষাৎকারে ফাঁকে ফাঁকে নিজেই তিরের মতো ছুঁড়তে থাকলেন একের পর এক ঝাঁঝালো প্রশ্ন! বঞ্চনা, না পাওয়ার হতাশা, অভিযোগ, আর্থিক অনটনের করুণ বাস্তবতা- মনের আগল খুলে বলতে শুরু করলেন বাংলাদেশের আর্চারির সবচেয়ে বড় তারকা। 

বাংলাদেশ আর্চারি ফেডারেশনকে জাতীয় দল থেকে অবসর নেওয়ার বিষয়টি গত ৭ ফেব্রুয়ারি চিঠি দিয়ে জানিয়েছেন রোমান। এতদিন পর রোববার তা এসেছে প্রকাশ্যে। খবরটি শুরুতে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতো শোনালেও ২৮ বছর বয়সী এই আর্চারের প্রতিটি কথায় স্পষ্ট তার প্রাপ্যটুকু না পাওয়ার ক্ষোভ এক দিনে জমা নয় মোটেও। শেষ দিকে অবশ্য তীর্যক উত্তরে তিনি দিয়ে রাখলেন মান ভেঙে ফিরে আসার এক চিলতে ইঙ্গিতও। 

হঠাৎ করেই অবসরের সিদ্ধান্ত নিলেন…কেন?

রোমান: (দীর্ঘশ্বাস) হতাশা, ক্ষোভে। আসলে দেখেন আমি ১৪ বছর ধরে আর্চারি খেলছি, একজন প্লেয়ার জাতীয় দলের হয়ে খেলে কী কারণে? একটু ভালো ভবিষ্যতের জন্য, সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কারণে, যাতে তার ভবিষ্যৎটা উজ্জ্বল হয়। তাই না? ক্রিকেট, ফুটবল ছাড়া আর কোনো খেলায় কি সেই সুযোগটা আছে? 

এত কিছু, এত রেজাল্ট, এত কিছু এনে দেওয়ার পর একজন খেলোয়াড়কে যদি তিন হাজার টাকা বেতন দেয়, দিন প্রতি ১০০ টাকা হাত খরচ দেয়, এর দরকার কী? আমার তো দরকার আর্থিক সমর্থন। এখন আমার বিবাহিত জীবন। যতটুকু সঞ্চয় ছিল, সেগুলো বিয়েতে খরচ করে ফেলেছি। এখন সংসার তো চালাইতে হবে। দিয়াকে (সিদ্দিকী) নিয়ে তো এখানে থাকতে হবে, দুজনের তো আলাদা থাকলে চলবে না। তাই না? খুলনায় আমাদের বাড়ি আছে। যদি খুলনায় থাকতে হয়, তাহলে তো আমাদের দুজনকে খেলা ছেড়ে দিয়ে এখানে থাকতে হবে, তাছাড়া তো সম্ভব নয়। 

আমি চাকরি করি আনসারে, সৈনিক, ২৫ হাজার টাকা বেতন পাই…এখন যে স্ট্যাটাস আল্লাহপাক আমাকে দিয়েছে, আমি তো আর টিনের ঘরে থাকতে পারি না। তাছাড়া টঙ্গীতে তো টিনের ঘরও নাই। ওখানে দুই রুমের বাসা নিয়ে থাকতে হলেও ১০-১৫ হাজার টাকা ভাড়া লাগে। আরও খরচ আছে। মা অসুস্থ, নানা রোগ তার শরীরে। মাসে এখানেও ৮-১০ হাজার টাকা খরচ। বেতনের টাকা তো এদিকেই চলে যায়। তাহলে এই আয় দিয়ে সংসার চালাবো কী করে? বৌয়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কি সবসময় সংসার চালানো যায়? 

একজন জাতীয় দলের খেলোয়াড়, রানিং খেলোয়াড়, দেশের সর্বোচ্চ পদকজয়ী, সে যদি একটা সংসার চালাইতে না পারে, বেতন দেয় ৩ হাজার টাকা, যা দিয়ে বাড়ি ভাড়াও হয় না। তো এই জাতীয় দলে খেলে কী করব? 

এই যে ৩ হাজার টাকা বেতনের কথা বললেন, সেটা কি ফেডারেশন থেকে দেয়?

রোমান: না। ফেডারেশন থেকে কিছুই দেয় না। এই টাকাটা কোথা থেকে দেয়, নিশ্চিত জানি না। যতটুকু জানি, টাকাটা আসে স্পন্সরদের কাছ থেকে। মানে ফেডারেশন থেকে আমাদের কোনো বেতন দেওয়া হয় না। কিছুই দেওয়া হয় না।

এটা নিয়ে কি কখনও ফেডারেশনের সঙ্গে কথা বলেছেন?

রোমান: এটা নিয়ে বলতে বলতে রোমান সানা এখন সবথেকে খারাপ (হয়ে গেছে, সবার কাছে)। আমার পায়ের নিচের মাটি সরিয়ে ফেলেছে। এই কথাগুলো বলার জন্য আমি খারাপ হয়ে গেছি। অথচ, আমি কথাগুলো সবার জন্যই বলেছি। এই তিন হাজার টাকাও দিচ্ছে সম্ভবত গত এক বছর, কথাগুলো বলার পর। এর আগে তো দিত পনের’শ টাকা করে। এখন চিন্তা করেন…। যে গাছ আপনাকে ফল দিবে, তাকে যদি আপনি যত্ন না করেন, সে আপনাকে ফল দিবে কী করে? তারপরও আমরা তো ফল দিয়েই যাচ্ছি। 

তাই আমি চিন্তা করেছি, যারা স্কলারশিপের প্লেয়ার আছে, তাদের জন্য খেলাটা চালিয়ে যাওয়া ঠিক আছে। কেননা, স্কলারশিপ থেকে মাসে ৫০ হাজার টাকা করে পায়। আমাকে তো স্কলারশিপ দেয়নি। এ নিয়ে অনেক কিছু হয়েছে। অনেক ক্ষোভ আছে, ক্ষোভ জমতে জমতে এমন একটা জায়গায় গেছে…আমি প্রতিদিন ৭-৮ ঘণ্টা অনুশীলন করি, এই পরিশ্রম যদি আমি অন্য কোথাও দেই, যদি রিকশাও চালায়, প্রতিদিন তিন-চার’শ আয় করতে পারব না? আপনিই বলেন। তাহলেও তো মাসে আট-দশ হাজার টাকা পাবো। 

স্কলারশিপের বিষয়টি যদি আরেকটু পরিষ্কার করতেন…এ নিয়ে অনেক কথা প্রচলিত আছে।

রোমান: স্কলারশিপের ওই পুরোনো কথা তুলে আসলে লাভ নেই। ওটা নিয়ে অনেক কিছু হয়েছে। আমাদের বলা হলো চার জনকে স্কলারশিপ দেওয়া হবে, তোমরা আবেদন করো। আমরা কয়েকজন আবেদন করেছিলাম-আমি, রাম কৃষ্ণ সাহা, রুবেল (হাকিম আহমেদ), আলিফ (আব্দুর রহমান), দিয়া ও নাসরিন (আক্তার), এরকম কয়েকজন করেছিলাম। ছেলেদের মধ্যে রুবেল ও আলিফ পেয়েছে, রুবেলেরটা ঠিক আছে, ও নিয়মিত ভালো রেজাল্ট করছে, দিয়া মেয়েদের ক্যাটাগরিতে পেয়েছে, সেটাও ঠিকাছে…আমার কথা হচ্ছে, আমি যখন অলিম্পিকে (বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন) গেলাম, তখন বিওএ মহাসচিব সাহেব বললেন, এখানে তো আমাদের হাত নেই, ফেডারেশন যাকে মনোনীত করবে, আমরা সেটা এপ্রুভ করে দিব। 

তাহলে বিষয়টা কী দাঁড়াল? ফেডারেশন আমার নাম দেয়নি, আমি পাইনি। গত জাতীয় আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে আমি সোনা জিতেছি, তার আগেরবার পারিনি আর এই দিয়েই আপনারা আমাকে বিচার করলেন? আরও অনেক কিছু আছে। আমি ফাইনালে জিততে না পারলে, আমাকে বকা দেয়, কেন পারলাম না? তদন্ত হবে, আইনের আওতায় আনা হবে-এমন অনেক কিছু বলা হয়। তবু আমি সহ্য করেছি। এখন আর পারছি না। 

ফেডারেশন ডাকলেও আপনি নাকি ট্রায়ালে অংশ নেননি।

রোমান: আমি কোন ট্রায়ালে অংশ নেইনি? তাদেরকে কাগজ দেখাতে বলেন তো। দেখুন, একটা টুর্নামেন্ট শুরুর ২০ দিন থেকে এক মাস আগে এর ভিসা প্রক্রিয়া, জিও নেওয়া-এসব শুরু হয়। ইরাকে যাওয়ার বিষয়গুলো শুরু হয়েছে অনেক দিন আগে। দিয়া, রুবেল সবার পাসপোর্ট আগেই নিয়েছে। আমার রাগ হয়েছে, আর্চারির একটা প্রোগ্রামে (কাজী রাজীব উদ্দিন আহমেদ চপলের ওয়ার্ল্ড আর্চারি ফেডারেশনের ইলেক্টোরাল বোর্ডের সদস্যপদ নির্বাচিত হওয়ার অনুষ্ঠান) দিয়াকে নিয়ে গিয়েছিলাম, যাওয়ার পথে ফেডারেশনে গিয়েছিলাম, আমাকে বলা হলো তোমাকে একটা সিগনেচার দিতে হবে, কিন্তু ওখানে গিয়ে দেখলাম তালিকায় আমার নাম নেই। 

ট্রায়াল তো হয়েছে এর অনেক পরে, বিশ্বকাপের ট্রায়াল হয়েছে। আমাকে দলে নেওয়ার জন্য কোচ (মার্টিন ফ্রেডরিখ) অনেক চেষ্টা করেছেন, কিন্তু পারেননি। আমিও দেখলাম, এত অনুশীলন করে কী হবে? ছুটি কাটাই। আসলে ওই দিন ফেডারেশনে না গেলে আমি জানতামও না ইরাকে যাওয়া দলের তালিকায় আমার নাম নেই। বিশ্বকাপের ট্রায়াল হয়েছে গত মাসে, এতে আমি আর অংশ নেইনি।  

আসল কথা হচ্ছে, ইরাকের আসরের আগে কোচ সিলেকশন করে রেখেছিলেন আমাদের। আমি, রাম, সাগর (ইসলাম), রুবেল, আরেকটা মেয়ে আর দিয়াকে। সেটা বাদ দিয়ে বিকেএসপির আর স্কলারশিপ পাওয়াদের নিয়ে গেল। আমাকে কেন নিয়ে গেল না?

গত এক দেড় বছর পারফরম্যান্স খুব একটা ভালো ছিল না আপনার। এজন্য নাকি কোচও আপনার উপর নাখোশ ছিলেন?

রোমান: কেউ বলতে পারবে না, আজ পর্যন্ত ট্রায়াল ছাড়া কোচের অটো চয়েজে আমি চান্স পেয়েছি। এ পর্যন্ত কোনো ট্রায়ালে আমি এক, দুই, তিনের বাইরে থাকিনি। কখনও চতুর্থ হয়নি। মার্টিন আমাকে নিজের ছেলের মতো ভালোবাসে, ও আমাকে ফেরানোর জন্য কী যে চেষ্টা করেছে, প্রকাশ্যে, আড়ালে, তা  আমি বলে বোঝাতে পারব না। এজন্য আমি মার্টিনের কাছে সারাজীবন কৃতজ্ঞ থাকব। সেখানে আমি কেন ওর বিবেচনায় থাকব না?  

কিন্তু মার্টিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছেন, কোনো শুন্যতাই অপূর্ণ থাকবে না…।

রোমান: দেখুন, আমি কিন্তু একটা বড় ভুল করেছি, যে অবসরের সিদ্ধান্তটা আমি মার্টিনকে জানাইনি। এটা আমার জন্য লজ্জার বিষয়। ও আসলে আমাকে এত বেশি ভালোবাসে…আসলে সিদ্ধান্তটা রাগ, ক্ষোভের মাথায় নিয়েছি তো…কিন্তু সত্যি কথা হচ্ছে, আমাদের এই আর্থিক বিষয়গুলো সে অতটা বুঝবে না। কোচ বেতন পান অনেক টাকা…সে নিজের তরফ থেকে চেষ্টা করে যায়, কিন্তু হয় না। বেতন নিয়ে কোচ অনেক কথা বলেন, কিন্তু সেটা তার নিজের বা দেশের প্রেক্ষাপটে, আমাদের ক্ষেত্রে যেটা যায় না। যেমন মনে করেন, সে বেতন পায় ডলার বা ইউরোতে, আমরা পাই টাকায়। ওর ছয়-সাত হাজার ডলার আর টাকা তো এক নয়। 

কোচ আসলে এই কথাগুলো কষ্ট নিয়ে বলেছেন। তার জায়গায় আমি হলে হয়ত আরও অনেক কথা বলতাম। সে আসলেই অল্প বলেছে। তবে এটাও সত্য, কারো শুন্যতাই অপূর্ণ থাকে না। নতুনরা আসবে। ইরাকে কি নতুন দল যায়নি? 

ক্রিকেট ও ফুটবলের বাইরে আর্চারি কোটি টাকা স্পন্সর পেয়েছে, তবু আপনাদের আর্থিক বিষয়গুলোর সুরাহা হয় না কেন?

রোমান: ২০১৭ সালে ‘তীর’ এলো আর্চারির সাথে। ২০১৯ সাল থেকে আমাদের জন্য শুরু হলো র‌্যাঙ্কিং পদ্ধতি। এক নম্বরে থাকলে সাত হাজার, দুই নম্বরে থাকলে পাঁচ হাজার টাকা করে পাবে। বছরে চারটা র‌্যাঙ্কিং (টুর্নামেন্ট) হবে, পজিশন ধরে রাখা অনুযায়ী টাকা পাবে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের পদকগুলোর জন্য নানা ক্যাটাগরিতে আর্থিক পুরস্কারও নির্ধারণ করা হলো। যেমন ধরুন, এশিয়া কাপে সোনা জিতলাম, তিনশ ডলার পাবো, বিশ্বকাপে সোনা পেলে এক হাজার ডলার পাবো। এরপর করোনা মাহমারী শুরু হলো, সব গায়েব হয়ে গেল। 

এখন তো আর কোভিড মহামারী নেই…

রোমান: ওটা আর ঠিক হয়নি। আমরা খেলোয়াড়রা এটা নিয়ে বলেছি, বারবার বলার পর পনেরশ টাকা থেকে তিন হাজারে নিয়েছে। 

সাম্প্রতিক সময়ে আপনার পারফরম্যান্সে ভাটার টান দেখছেন অনেকে…

রোমান: দেখুন, এশিয়ান গেমস আমরা খেলতে গিয়েছিলাম চার জন। টিমে আমি কোয়ালিফাই করেছি, আমি ওই টিমে সর্বোচ্চ স্কোর করেছি, ব্যক্তিগত বিভাগে ভালো করতে পারিনি, কিন্তু দলগত বিভাগে দলকে সেমি-ফাইনালে নিয়ে গেছি। পরে ব্রোঞ্জের লড়াইয়ে হেরেছি। এর আগে আমরা কখনই এশিয়ান গেমসের সেমি-ফাইনালে উঠিনি, তাহলে আমার রেজাল্ট খারাপ হলো? 

কেউ কেউ বলেন গত বছরে এক নারী সতীর্থের সঙ্গে খারাপ আচরণের পর থেকে আপনার মাঠের পারফরম্যান্স পতনের শুরু…

রোমান: আসলে পতন বলে কিছু নেই। এখানে ক্যারিয়ার হচ্ছে না, অন্য জায়গায় হবে। জীবন কখনও থেমে থাকবে না। আমার পারফরম্যান্স থাকতে থাকতে আমি চলে যাচ্ছি। আর যে প্রসঙ্গে বললেন...ওটা নিয়ে কিছু বলতে চাই না। শুধু বলছি ২০২৩ সালেও জাতীয় আর্চারি চ্যাম্পিয়নশিপে আমি সোনা জিতেছি, তাহলে কোন দিক থেকে তারা বিবেচনা করে আমি খারাপ পারফম্যান্স করেছি।

রোমান কি কখনও নিজের উপর হতাশ হয়নি। বিশেষ করে ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জ জয়ের পর সাফল্যের ধারায় থাকতে না পারার কারণে?

রোমান: আমি আমার জায়গা থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। হ্যাঁ, যখন সবাই আমার কাছ থেকে অনেক বেশি আশা করে, তখন সেটা পূরণ করতে না পারলে খারাপ তো লাগেই। তখন অবশ্যই নিজের ওপর হতাশ হয়েছি। কিন্তু দেখুন, অলিম্পিকস খেলে আসার পর চোটে পড়েছিলাম, যে কারণে ধারাবাহিকভাবে পারফরম করতে পারছিলাম না। দলগত ও মিশ্র দলগত বিভাগে মোটামুটি ভালো করছিলাম, কিন্তু ব্যক্তিগত ইভেন্টে ভালো করতে পারছিলাম না। ইরাকে যখন দুই বছর পর (২০২২ সালের এশিয়ান কাপ লেগ-২) ফাইনালে উঠলাম, হেরে গেলাম ভারতীয় প্রতিযোগীর বিপক্ষে হেরে। কোচ আমাকে অনুপ্রাণিত করলেন। তখন একজন এসে সবার সামনে আমাকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করে বসলেন, নানা কথা শোনাতে লাগলেন! 

আপনি এত যে অভিযোগ করছেন…আপনার কি কখনও মনে হয়, নিজেরও ভুল আছে?

রোমান: আমি বলব না, আমি একদমই নিখুঁত। আমি ছোট মানুষ। আমারও ভুল আছে। অনেক ভুল আছে। অনেক ক্ষেত্রেই আমি নিজে ভালোভাবে উপস্থাপন করতে পারিনি। আরও মার্জিত হওয়া উচিত ছিল, হতে পারিনি। কিন্তু এটাও তো ঠিক, আপনারা (ফেডারেশনের কর্মকর্তারা) যখন বলেন, তোমরা আমাদের ছেলের মতো…তো ছেলে যদি ভুল করে বসে, তখন কেন ভুল শুধরে বুকে টেনে নেন না। বরং আরও শেষ করে দিতে চান। এতে করে তো দূরত্ব বাড়বে, কমবে না। 

আমি ভুল করেছি। রাগ বেশি আমার। ১০টা বছর সহ্য করতে করতে এখন আর সহ্য করতে পারি না। মিথ্যা প্রতিশ্রুতি মানতে পারি না। কিন্তু আমি সবসময় কারো কাছে ভুল করলে আমি সরি (দুঃখিত) বলেছি, সে আমার ছোট হোক, বড় হোক। 

রাগ, ক্ষোভ, হতাশা কি শুধুই ফেডারেশনের ওপর?

রোমান: বাংলাদেশের অনেক খেলোয়াড়ই তো সরকারের কাছ থেকে অনেক কিছু পেয়েছেন। আপনারাই বলেন…আমি তো অনেক পদক জিতেছি, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে। অহঙ্কার করে কথাগুলো বলছি না, দুঃখ নিয়েই বলছি, আমি কি কিছু পেতে পারতাম না। আমি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে পদক পেয়েছি, বিশ্বকাপে পেয়েছি, যেগুলো বাংলাদেশের আর্চারির ইতিহাসে প্রথম, অলিম্পিকে সরাসরি কোয়ালিফাই করেছি, সাউথ এশিয়ান গেমসে (এসএ গেমস) তিন ইভেন্টে সোনা জিতেছি-এগুলোও ইতিহাস, এশিয়া কাপে একাধিকবার সাফল্য পেয়েছি...যারা (সরকারের কাছ থেকে) ফ্ল্যাট বা আরও অনেক কিছু পেয়েছে, তাদের কেউ কি আমার মতো সাফল্য এনে দিতে পেরেছে?

আপনার সমসাময়িক বা একটু সিনিয়রদের অনেকে তো কোচ হয়ে রয়ে গেছেন, কেউ বিদেশে কোচিং করাচ্ছেন...

রোমান: আমার ইচ্ছা ছিল জাতীয় দলের কোচ হওয়ার, কিন্তু এই জায়গাতে যারা বসেছে, তারা কি কখনও ছাড়বে? দিয়ার সঙ্গে আমি সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছি। সে তো চাইবেই আমি আর্চারি চালিয়ে যায়। কিন্তু বিষয়গুলো সেও বুঝে আমিও বুঝি। আমরা আসলে পরিস্থিতির শিকার। রিকশা চালানোর উদাহরণ তো দিলামই…। 

প্রতিবেশি দেশ ভারতের দিকেই তাকান। ওদের একজন আর্চারি খেলোয়াড় এক-দুই বছর খেলে কিছু সাফল্য পেলে বাড়ি-গাড়ি কোনো কিছুরই অভাব থাকে না। ভারতে যারা আমার বন্ধু, ছোট ভাই আছে, আমাদের কাহিনী শুনলে ওদের চোখে পানি আসে।

এ দেশের ক্রীড়াপ্রেমীরা আর্চারি চিনেছে রোমান সানাকে দেখে। সেখানে আপনি হঠাৎ অবসরের সিদ্ধান্ত নিলেন। যদি আর্চারির জনপ্রিয়তা কমে, তাহলে আপনার দায় কি থাকবে না?

রোমান: সবার কথা চিন্তা করে তো রোমান সানার সংসারই চলছে না। এখন যেটা বলব, তার জন্য আগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি- আপনারা আমার সংসার চালিয়ে দেন, আমি আরও ১০ বছর খেলে দিচ্ছি। অনেক পদক এনে দিব ইনশাল্লাহ। এখনও সে আত্মবিশ্বাস আমার আছে।

তাহলে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?

রোমান: দেখি কী করা যায়। পারিবারিক ঘেরের ব্যবসা আছে, সেটা করতে পারি। তা যদি না পারি, দেশের বাইরে কোথাও চলে যাবো। হারিয়ে যাবো। কেউ জানবে না, বুঝবে না, উধাও হয়ে যাবো।