বিশ্বজয়ী আর্জেন্টিনার উন্নতির ধারায় থাকার বছর

সুসময় ধরে রেখে লিওনেল স্কালোনির দল ছুটে চলেছে দারুণভাবে; ২০২৩ সালে খেলা ১০ ম্যাচের ৯টিতেই জয়ের স্বাদ পেয়েছে তারা।

স্পোর্টস ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 Dec 2023, 11:20 AM
Updated : 31 Dec 2023, 11:20 AM

প্রাপ্তির পাল্লায় আর্জেন্টিনার জন্য নিশ্চয়ই ২০২২ সালটা অতুলনীয়! ওই বছরই বিশ্বজয়ীর মুকুট পরেছিলেন মেসি-মার্তিনেসরা। ২০২৩ সালে তাদের কাঁধে ছিল সাফল্যের রাশ টেনে নেওয়ার মহাভার, তারা তা দুর্দান্তভাবেই করেছেন। সব মিলিয়ে খেলা ১০ ম্যাচের ৯টিতে জয়ের হাসি হেসে, ২০২৬ বিশ্বকাপ বাছাইয়ে টেবিলে শীর্ষে থেকে বছর শেষ করেছে আলবিসেলেস্তারা। 

শুধু কী প্রাপ্তি বা উন্নতির ধারায় থাকা? মাঝে প্রবল এক ঝাঁকুনিতে নড়েও উঠেছিল আর্জেন্টিনা। যখন হুট করে লিওনেল স্কলোনি দিয়ে বসেন কোচের পদ ছাড়ার ইঙ্গিত। পরে অবশ্য সমস্যার সমাধান মিলেছে, ‘মান-অভিমান’ ভুলে স্কালোনি থেকে গেছেন স্বপদে। 

এ বছরে আর্জেন্টিনার দারুণ পথচলা, কাতার বিশ্বকাপ জয়ের পর ক্রমোন্নতির ধারায় থাকা, হঠাৎ তেড়েফুঁড়ে ওঠা ওই টানাপোড়েনসহ আরও অনেক কিছু গভীর দৃষ্টি দিয়ে দেখে প্রতিবেদন ছাপিয়েছে বৈশ্বিক ফুটবলের নিয়ন্তা সংস্থা ফিফা। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের পাঠকদের জন্য তা তুলে ধরা হলো। 

মার্চের প্রীতি ম্যাচে পানামাকে হারিয়ে বছর শুরু আর্জেন্টিনার। বছরের সবচেয়ে বড় ব্যবধানের জয়টিও তারা পেয়েছিল মার্চেরই শেষের দিকে; কুরাসাওকে ৭-০ গোলে উড়িয়ে। ওই ম্যাচে লিওনেল মেসি করেছিলেন হ্যাটট্রিক; ক্যারিয়ারে শততম আন্তর্জাতিক গোলের মাইলফলকে পা রেখেছিলেন এই মহাতারকা। 

কুরাসাওয়ের বিপক্ষে ম্যাচটি বাদে এ বছর দুইয়ের বেশি গোল ব্যবধানে আর্জেন্টিনা জিতেছে আর মাত্র একবার; বিশ্বকাপ বাছাইয়ে বলিভিয়ার বিপক্ষে, ৩-০ ব্যবধানে। তবে, জেতা ম্যাচগুলোর একটা পরিসংখ্যান ঈর্ষণীয় বলতে হবে; ৯ ম্যাচের সবগুলোতেই জাল অক্ষত ছিল তাদের। 

একমাত্র হারের তেতো স্বাদটি তারা পায় নভেম্বরে। বুয়েন্স আইরেসে বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ম্যাচে উরুগুয়ের বিপক্ষে ২-০ গোলে হেরে যায় স্কালোনির দল। এই এক হারের প্রভাব খুব একটা পড়েনি; বিশ্বকাপ বাছাইয়ের লাতিন আমেরিকা অঞ্চলের টেবিলে ছয় ম্যাচে ১৫ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে থেকেই নতুন বছর শুরু করতে যাচ্ছে তিনবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা। 

এই দুরন্ত ছুটে চলায় স্কালোনি বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছিলেন মাঝমাঠে। রদ্রিগো দে পল, এনসো ফের্নান্দেস ও আলেক্সিস মাক আলিস্তের-এই তিনের সন্নিবেশ মাঝমাঠকে করেছিল জমাট, মাঠের নিয়ন্ত্রণ নিতে রেখেছিলে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। 

এই ত্রয়ী প্রথম কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে খেলার সুযোগ পান কাতার বিশ্বকাপে; পোল্যান্ডের বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে। শুরুর দুই ম্যাচে মাঝমাঠে আর্জেন্টিনা এই জায়গায় ভুগছিল; তাদের পেয়ে সেই ভোগান্তি দূর হয়। পোল্যান্ড ম্যাচের আগে তিন জনের একসাথে খেলার অভিজ্ঞতা না থাকলেও তাদের অন্তর্ভুক্তিতে আর্জেন্টিনার মাঝমাঠে পজেশন ধরে রেখে বল ঘোরানোর সামর্থ্যে উন্নতির ছাপও পড়ে। 

লুসাইল স্টেডিয়ামে ফ্রান্সের বিপক্ষে ফাইনাল ছিল দে পল, ফের্নান্দেস ও মাক আলিস্তেরের জন্য মাঝমাঠে ‘একটা ইউনিট’ হয়ে খেলা চতুর্থ ম্যাচ। অবশ্য এর পর এই ত্রয়ী একাধিক ম্যাচে আর্জেন্টিনার মাঝমাঠের জোয়াল টেনেছেন একসাথে। 

ফের্নান্দেসের সাথে পজেশন বদল করে মাক আলিস্তেরের সেন্টারে ওঠা- স্কালোনির এই কৌশল ফলপ্রসু হয় দারুণভাবে। তাতে করে ফের্নান্দেস আক্রমণে ওঠার জন্য উন্মুক্ত থাকতে পারেন এবং আক্রমণের সুর বেঁধে দিতে আরও মনোযোগী হওয়ার সুযোগ মেলে মাক আলিস্তেরের। 

যদিও দুজনেই উভয় কাজই করতে সক্ষম, কিন্তু স্কালোনির কৌশল তাদেরকে আরও সহজাত, স্বাভাবিক ও কার্যকরী হওয়ার পথ করে দিয়েছিল। আক্রমণের শেষ অংশে ফের্নান্দেসের সম্পৃক্ততা আরও বাড়ে আর তুলনামুলকভাবে পাসিং দক্ষতা এবং বল নিয়ন্ত্রণের সামর্থ্য একটু বেশি থাকায় সেন্টার-হাফের আরও কাছাকাছি থাকতে পারেন মাক আলিস্তের। 

বিশ্বকাপেও তারা ঠিক এই কাজটিই করেছিলেন। সেন্টার পজিশনে তিন জন দারুণভাবে মানিয়ে নিয়ে ফুল-ব্যাক ও ফরোয়ার্ডদের মুভের জন্য মাঠের দুই পাশ মুক্ত রাখেন, সেই সঙ্গে মিডফিল্ডার হিসেবে বাড়তি ভার বয়ে নেওয়া এবং আক্রমণভাগে বলের যোগান দেওয়ার দায়িত্ব পালন করেন তারা সুচারুভাবে।

পোস্টের নিচে মার্তিনেসের উপস্থিতি আর্জেন্টিনার সাফল্যের আরেকটি ভিত বৈকি। ২০২১ সালে জাতীয় দলে অভিষেকের বছরেই ২৮ বছরের খরা কাটিয়ে কোপা আমেরিকার শিরোপা জয়ের নায়কের একজন বনে যান তিনি। গত বছর রঙিন করেন দুর্দান্ত পারফরম্যান্স মেলে ধরে বিশ্বকাপ জয়ের সঙ্গে ‘গোল্ডেন গ্লাভস’ জিতে।   

বিশ্বকাপের পারফরম্যান্সের রেশ মার্তিনেস টেনে নেন ২০২৩ সালেও। এ বছর জাল অক্ষত রাখেন ৭৫২ মিনিট; যে পথচলায় ছেদ পড়ে বিশ্বকাপ বাছাইয়ে উরুগুয়ের বিপক্ষে ম্যাচে রোনালদ আরাউহোর কাছে পরাস্ত হয়ে। সেটি ছিল এ বছরে আর্জেন্টিনার খেলা নবম ম্যাচ। 

মার্তিনেসের পরিসংখ্যানের চেয়ে চিত্তাকর্ষক আরও বিষয় আছে। যেমন, কাতার বিশ্বকাপের পর থেকে রক্ষণভাগের দৃঢ়তাকে অন্য পর্যায়ে নিয়ে গেছে আর্জেন্টিনা। লেয়ান্দ্রো মার্তিনেস চোটে পড়ার পর ক্রিস্তিয়ান রোমেরা ও নিকোলাস ওতামেন্দি সেন্ট্রাল-ডিফেন্সে জমাট জুটি গড়ে সামলেছেন সব। গত নভেম্বরে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিলের বিপক্ষে ১-০ ব্যবধানের জয়ে ওতামেন্দিই ৬৩তম মিনিটে করেছিলেন নির্ণায়ক গোলটি। 

আর্জেন্টিনা দলে এ বছর পুরনোর সঙ্গে নতুনের মিশেলও ছিল লক্ষণীয়। ফিওরেন্তিনার নিকো গনসালেস ও টটেনহ্যাম হটস্পারের জিওভানি লো সেলসো চোটের কারণে খেলতে পারেননি বিশ্বকাপে; চোট কাটিয়ে দুজনে ফেরেন এ বছর। 

ফ্লোরেন্সের ক্লাবটিতে আরেকটি দারুণ মৌসুম কাটাচ্ছেন গনসালেস। বাঁ পায়ের এই রাইট উইঙ্গার ফুল ব্যাকের ভেতরে-বাইরে সমান বিপজ্জনক (প্রতিপক্ষের জন্য)। রক্ষণেও ভীষণ তটস্থ। সঙ্গে আর্জেন্টিনার ২০২১ কোপা আমেরিকা জয়ের নায়কদের একজন লো সেলসোর ফেরা স্বস্তি বাড়িয়েছে স্কালোনির। 

তর্কসাপেক্ষে কাতার বিশ্বকাপের পর আর্জেন্টিনা দলে যোগ দেওয়া নতুন মুখের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত নামটি আলেহান্দ্রো গারনাচো। যদিও বিশ্বকাপ বাছাইয়ে এখনও ছাপ রাখা হয়নি তার, কিন্তু ক্লাব পর্যায়ে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের হয়ে ঠিকই আলো ছড়িয়ে চলেছেন তিনি। ফলে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে বাছাই পুনরায় শুরু হলে স্কালোনিকে ভাবতে হবে গারনাচোকে নিয়ে। 

এ বছর আর্জেন্টিনা মেসিকে ছাড়া চলতে শিখেছে একটু হলেও। এটা সত্যি যে, তার অনুপ্রেরণাদায়ী অধিনায়ত্ব ও পারফরম্যান্স ছাড়া কাতার বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হওয়াটা কল্পনা করা অসম্ভব। কিন্তু ইন্টার মায়ামি তারকা যখন পেশির চোটে ভুগছিলেন, তখন স্কালোনির সামনে নতুন পরীক্ষার দুয়ার খুলে যায়। 

বাছাইয়ে প্যারাগুয়ের বিপক্ষে আক্রমণভাগের দায়িত্ব তিনি তুলে দেন লাউতারো মার্তিনেস ও হুলিয়ান আলভারেস জুটির কাঁধে। পেপ গুয়ার্দিওলার ম্যানচেস্টার সিটিতে যে পজিশনে খেলতে অভ্যস্ত আলভারেস, সেই পজিশনেই তাকে খেলান স্কালোনি; ইন্টার মিলান ফরোয়ার্ড মার্তিনেসের পেছনে এবং প্রতিপক্ষের সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারের কাছাকাছি জায়গায়। 

ওই ম্যাচে আর্জেন্টিনার ১-০ গোলের জয়ে যদিও মার্তিনেস, আলভারেসের কেউ জালের দেখা পাননি, কিন্তু এই জুটির সম্ভাবনাময় আগামীর পরিষ্কার আভাস মিলে যায়। গত কয়েক মাসে আলভারেসের পারফরম্যান্সে নিবেদন এবং দলের প্রয়োজনে অভিজ্ঞ মিডফিল্ডার হিসেবে খেলার পারদর্শীতা দেখাচ্ছেন বেশ। 

গত অক্টোবরে প্যারাগুয়ের বিপক্ষের ওই ম্যাচে আলভারেস মেলে ধরেন শৃঙ্খলাবদ্ধ গোছালো ফুটবল। যখন সতর্ক হওয়া প্রয়োজন তখন নিজের গতিরোধ করেছেন, যখন জায়গা পেয়েছেন তখন আবার আক্রমণ শাণিয়েছেন এবং আর্জেন্টিনাকে সোজাসুজি আক্রমণে উঠতে সাহায্য করেছেন। বিখ্যাত নাম্বার-১০ এর অনুপস্থিতিতে আর্জেন্টিনার খেলায় তীব্রতার যে কমতিটুকু দেখা যাচ্ছিল, তা দূর করতে সাহায্য করেছেন আলভারেস। 

তবে বছর জুড়ে যিনি ছক কষে আর্জেন্টিনাকে পথ দেখিয়েছেন, সামনের পথচলার জন্য গুছিয়েছেন সবকিছু, সেই স্কালোনির এক ঘোষণাতে সবকিছু নড়ে ওঠে গত নভেম্বরে। ব্রাজিলের বিপক্ষে জয়ের পরই তিনি ইঙ্গিত দেন সরে দাঁড়ানোর।

“একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চেয়েছিলাম, আমার এখন বলটা থামিয়ে ভাবতে হবে। এই সময়ে আমার অনেক কিছু ভাবার আছে। এই খেলোয়াড়রা আমাকে অনেক কিছু দিয়েছে, পুরো কোচিং স্টাফকে তারা অনেক কিছু দিয়েছে। এখন আমি কী করব, সেটা নিয়ে ভাবা প্রয়োজন।” 

“এটা বিদায় বা অন্য কিছু না। তবে আমাকে ভাবতে হবে, কারণ প্রত্যাশার মাত্রাটা অনেক উঁচুতে, আর এভাবে চালিয়ে যাওয়া এবং জয়ের পথে থাকাও বেশ কঠিন কাজ…তাই আমাকে ভাবতে হবে। পরে আমি বোর্ড সভাপতি এবং খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা বলব। কারণ এই আর্জেন্টিনা দলের এমন একজন কোচ প্রয়োজন, যার সম্ভাব্য সবরকম প্রাণশক্তিতে ভরপুর।

আর্জেন্টিনা সমর্থকদের জন্য স্বস্তির হচ্ছে, টানাপোড়েনের আপাতত অবসান হয়েছে। স্কালোনি রয়ে গেছেন দায়িত্বে। বছর জুড়েই নিজের ফুটবল দর্শন এবং পরিকল্পনা পরিষ্কার করেছেন ৪৫ বছর বয়সী এই কোচ। প্রীতি ম্যাচগুলোতেও আর্জেন্টিনা কখনও হাল ছাড়েনি; গোলের জন্য ছুটেছে। 

বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ম্যাচে এগিয়ে গেলেও প্রতিপক্ষের ঘুরে দাঁড়ানোর পর রুদ্ধ করে দিতে কঠোর পরিশ্রম করে গেছে। এখন স্কালোনির দলে সবাই লড়াই করতে চায়, দলে জায়গা করে নিতে চায়; যার অর্থ হচ্ছে এখন পর্যন্ত দলটি যা অর্জন করেছে, তাতে আত্মতুষ্টিতে ভোগার কোনো ইচ্ছেই নেই তাদের। 

ফিফা র‌্যাঙ্কিংয়ে শীর্ষে থেকে বছর শেষ করা আর্জেন্টিনা তাই ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে আরও সাফল্যের ক্ষুধা নিয়ে। ২০২৪ সালে কোপা আমেরিকার আসর আছে; বিশ্বকাপ বাছাইয়ের ম্যাচও আছে। তাদের দৃষ্টিসীমায় যেমন আছে মহাদেশ সেরার ট্রফি ধরে রাখার স্বপ্ন, তেমনি এই সুসময় আরও অনেক দিন টেনে নেওয়ার তাড়নাও।