১৮৬২ সালের দিকে প্রতিষ্ঠিত হয় জাহাপুরের জমিদারদের জমিদারি; তাদের পূর্বপুরুষরা প্রায় চারশত বছর আগে ওই গ্রামে বসতি স্থাপন করেন।
Published : 27 Sep 2022, 01:55 PM
হাতি আর ঘোড়া না থাকলেও টিকে আছে হাতিশালা ও আস্তাবল। প্রবেশপথের প্রধান দরজায় থাকা দুই সিংহ মূর্তির একটি ভেঙে গেলেও সেগুলো যেন জাহাপুর জমিদার বাড়ির ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের নিশান হাতে দাঁড়িয়ে আছে।
অনেকটাই সুনশান বাড়িটির ভবনগুলোর ধূসর ইট আজও বহন করে বেড়াচ্ছে জাহাপুরের জমিদারদের প্রায় ৪০০ বছরের ইতিহাস।
কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার জাহাপুর গ্রামের ঐতিহ্যবাহী এই বাড়ি ঘিরে জমিদারদের সুনাম এখনও রয়েছে।
এ অঞ্চলে যারা জমিদারি করে গেছেন, তাদের মধ্যে প্রজাদরদী হিসেবে জাহাপুরের জমিদারদের বেশ নামডাক ছিল বলে মনে করেন ইতিহাসবিদরা।
১৮৬২ সালের দিকে প্রতিষ্ঠিত হয় জাহাপুরের জমিদারদের জমিদারি। তবে তাদের পূর্বপুরুষরা প্রায় চারশত বছর আগেই ওই গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। জমিদার বাড়িতে বর্তমানে চতুর্দশ বংশধররা বসবাস করছেন।
সরেজমিনে জাহাপুর গ্রামে দেখা যায়, বাড়ির সামনে বড় পুকুরে রয়েছে শান বাঁধানো ঘাট। বয়সের ভারে ভগ্নদশা সেটির। বাড়ি ঘিরে রেখেছে অসংখ্য নারিকেল গাছ। গাছের ছায়ায় বাড়িতে বিরাজ করছে শীতল পরিবেশ। বাড়ি লাগোয়া পূর্ব পাশেও রয়েছে পুকুর। সেখানের ঘাটও ভেঙে আছে।
জমিদারদের ইতিহাস থেকে জানা যায়, জমিদার অশ্বিনী কুমার রায় ১৩২৪ বঙ্গাব্দে জগন্নাথ দেবের রথ ও মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। এখনও রথযাত্রার সময় হাজার হাজার ভক্ত সমবেত হন জাহাপুরে।
জমিদারবাড়ির সামনেই বিশাল আকৃতির বট গাছের কাছে একটি ঘরে এখনও উঁচু রথ রাখা আছে। বাড়িতে প্রবেশ করতে হাতের ডানে মন্দিরটি অবস্থিত।
বাড়িতে প্রবেশের প্রথম ফটকে দুইটি সিংহের মূর্তি রয়েছে। এর একটি এরই মধ্যে ভেঙে পড়েছে। জমিদারবাতে প্রবেশের পর প্রথমেই নজর কাড়বে বিশাল দ্বিতল ভবনটি।
বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করতেই একটি মন্দির দেখতে পাওয়া যায়। এটি নাট মন্দির নামে পরিচিত। দুর্গা পূজায় এখানে ভক্তরা সমবেত হন। পাশেই রয়েছে স্থায়ীভাবে নির্মিত দুর্গাদেবীর প্রতিমা।
বাড়িটিতে মোট দশটি ভবনের মধ্যে একটি তিনতলা, বাকি নয়টি দোতলা ভবন ছিল। প্রতিটি ভবনই ইট-সুরকি দিয়ে নির্মিত। ভবনগুলো কোনটা আই টাইপ, কোনটা এল টাইপে নির্মিত।
সবগুলো ভবনেই সুশোভিত নকশা রয়েছে। সবগুলোতে ফুলের নকশা করা হলেও একই ধরনের ফুল ব্যবহার করা হয়নি। এমনকি জানালার গ্রিলগুলোতেও নকশা করা রয়েছে।
এরই মধ্যে নষ্ট হয়ে গেছে দুটি ভবন। টিকে থাকা ভবনগুলো বেশিরভাগই জরাজীর্ণ অবস্থায় রয়েছে। যেন লতাপাতায় ঢেকে যাচ্ছে ৪০০ বছরের পুরনো ইতিহাস।
এরপরও কয়েকটি ভবনে বর্তমান বংশধররা বসবাস করছেন, বয়ে বেড়াচ্ছেন সেই পুরনো স্মৃতি। এখন বাড়িটিতে বসবাস করছেন জমিদারদের চতুর্দশ বংশধর অধ্যাপক অঞ্জন কুমার রায়, তার ভাই অধ্যক্ষ রঞ্জন কুমার রায়, চাচাতো ভাই বিশ্বজিত কুমার রায় ও তাদের পরিবার। তারাই এ বিশাল বাড়িটি দেখাশোনা করছেন।
এ ছাড়া জমিদারের পরিবারের অনেক সদস্য বর্তমানে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন স্থানে বসবাস করেছেন।
অঞ্জন কুমার রায় যে ভবনটিতে বসবাস করছেন, সেটির দরজার ওপরে ‘আনন্দ ভবন, ৮ই ফাল্গুন ১৩৩৪ বঙ্গাব্দ’ লেখা রয়েছে। এটি নির্মাণ করেছেন অঞ্জন কুমারের দাদা অশ্বিনী কুমার রায়। জমিদারবাড়ির সর্বশেষ নির্মিত এ ভবনটি এখনও যেন কিছুটা হলেও জৌলুশ ধরে রাখতে পেরেছে।
ভবনটির সামনে প্রশস্ত বারান্দা রয়েছে। ফ্লোর থেকে ছাদের উচ্চতা ১৪ ফুট। ছাদের নিচের অংশে কাঠের এবং লোহার তৈরি কারুকার্যময় সিলিং দেখতে পাওয়া যায়।
সরু সিঁড়ি বেয়ে এই বাড়ির ছাদে গেলেই প্রায় তিন একর আয়তনবিশিষ্ট পুরো জমিদার বাড়িটি দেখতে পাওয়া যায়। এ দৃশ্য দেখে যে কারোই মন ভরে যাবে।
অঞ্জন কুমার রায় স্থানীয় জাহাপুর কমলাকান্ত একাডেমির ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে কর্মরত রয়েছেন।
তিনি জানান, জমিদারবাড়ির ভবনগুলোর নকশা তৈরিতে ঢাকার বিক্রমপুরের মিস্ত্রিরা কাজ করেছিল সেসময়। এগুলো মুঘল রীতিতে তৈরি।
তিনি বলেন, “বাড়িটিতে আমাদের বংশের বসবাস প্রায় ৪০০ বছর আগের। বংশের পূর্বপুরুষরা পাট ব্যবসায়ী ছিলেন। তাদের অনেক সম্পত্তি ছিল। ১৮৬২ সালে আমরা ঢাকার নওয়াবদের কাছ থেকে জমিদারি ক্রয় করি।
“জমিদারি বিস্তৃত ছিল তিতাস, মুরাদনগর, দাউদকান্দি, চান্দিনা, দেবিদ্বার ও নবীনগরে। বংশের প্রথম পুরুষ ছিলেন কানাই লাল রায়। জমিদারি শুরু করেন সপ্তম পুরুষ গৌরি মোহন রায়। গৌরব বৃদ্ধি পায় নবম পুরুষ কমলাকান্ত রায় ও তার ছেলে গিরিশ চন্দ্র রায়ের সময়।”
বাড়িটি ঘুরে জমিদারদের ব্যবহৃত শৌখিন খাট, নকশা করা চেয়ার, গা এলিয়ে দেওয়ার ইজি চেয়ার, কারুকার্যখচিত ফুলদানিসহ অনেক কিছুই দেখতে পাওয়া যায়। সেগুন কাঠের তৈরি নকশা করা আসবাবপত্রগুলো শতাধিক বছরের পুরনো। ওই সময় ব্যবহৃত হ্যাজাক লাইট দেখতে পাওয়া যায়।
এছাড়া দুর্লভ অনেক কিছুই চোখে পড়ে। বাড়িতে রয়েছে একটি রুপার দিয়ে তৈরি ছাতা। বিয়েতে বর বরণে ব্যবহার হতো ছাতাটি।
বর্তমানে আমরা পানি বিশুদ্ধ করার জন্য ফিল্টার ব্যবহার করি। আজ থেকে শত বছর আগেও জমিদাররা যে কতটা স্বাস্থ্যসচেতন ছিলেন, তা দরজার পাশে রাখা একটি ফিল্টারের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। শত বছরের পুরনো ফিল্টারটির নিচের অংশে ছোট্ট করে লেখা রয়েছে, ‘মেইড ইন লন্ডন’।
মূল জমিদারবাড়ি থেকে বের হলে পাশেই থাকা শ্মশানে গিয়ে দেখা যায়, জমিদার বাড়ির পূর্বপুরুষ রাম মোহন রায়, কৃষ্ণ মোহন রায়, গৌরি মোহন রায়সহ জমিদারদের সমাধি। তবে হিন্দুরীতি অনুযায়ী আগুনে দাহ না করে মাটি দেওয়া হয় সাধু পুরুষ কমলাকান্ত রায়কে।
বাড়ির আরেক বাসিন্দা বিশ্বজিত কুমার রায় জানান, সাধু পুরুষ কমলাকান্ত রায়ের সমাধিতে এখনও প্রতিদিন সন্ধ্যায় মোমবাতি জালানো হয়। হিন্দু-মুসলমান সবাই তাকে সম্মান করতেন এবং এখনও করেন।
এক সময় বহু ভক্ত এখানে আসত। তাদের জন্য ফ্রি খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। তার সমাধির সামনের পুকুরটির নাম ‘ফেন পুকুর’ ।
বিশ্বজিত বলেন, “পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে শুনেছি ভক্তদের জন্য রান্না করা ভাতের মাড় বা ফেন ফেলতে ফেলতে জায়গাটি গর্ত হয়ে ধীরে পুকুরটির সৃষ্টি হয়েছে বলে তার এমন নাম।”
কুমিল্লা থেকে জমিদার বাড়িতে ঘুরতে আসা দর্শনার্থী প্রকৌশলী মীর ফজলে রাব্বী বলেন, “জমিদার বাড়িটি ঘুরে অবাক হয়েছি; চারশ বছর আগেও বাড়ি তৈরিতে অসাধারণ শিল্পকর্মগুলো দেখে বিস্ময় জেগেছে মনে।”
মুরাদনগরের স্থানীয় ইতিহাস গবেষক মমিনুল ইসলাম মোল্লা বলেন, “গোমতির কলকল ঢেউয়ের তালে তালে এক সময় বয়ে চলত জমিদারদের ‘গয়না’ নৌকা।
“জনশ্রুতি আছে জাহাপুরের জমিদারদের ব্যাপারে বাংলার বার ভূঁইয়ার এক ভূইয়া কেদার রায় বলেছিলেন - ‘মেঘনার পূর্ব পাড়ে কোনো বড় জমিদার নেই। শাকের মধ্যে লবণতুল্য আছে জাহাপুরের জমিদাররা’।”
মমিনুল বলেন, “ইতিহাস থেকে জানতে পারি জাহাপুরের জমিদাররা ছিলেন প্রজাদের জন্য কল্যাণকর শাসক। তারা কখনও প্রজাদের উপর অত্যাচার করেননি।”
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে এই অঞ্চলে দর্শনীয় তেমন কোনো স্থান নেই। জাহাপুর জমিদার বাড়িটি দর্শনীয় স্থান হতে পারে। যোগাযোগ ব্যবস্থাও চমৎকার। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ইলিয়টগঞ্জ হয়ে জাহাপুর ১৫ কিলোমিটার। মুরাদনগর থেকে ১০ কিলোমিটার। এ ব্যাপারে সরকারের উদ্যোগ প্রয়োজন।
তবে জমিদার বাড়ির বংশধর বিশ্বজিত কুমার রায় বলেন, বাড়িটি বর্তমানে তারাই দেখাশোনা করছেন। ভবিষ্যতেও তারাই সে দায়িত্ব পালন করতে চান। এজন্য সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে এই বাড়ির দায়িত্ব দিতে চান না তারা।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক একেএম সাইফুর রহমান জানান, জাহাপুর জমিদার বাড়িটি এখনও পরিদর্শন করেননি তিনি। শিগগিরই বাড়িটি পরিদর্শনের পর সংরক্ষণের উপযুক্ত হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানাবেন তিনি।
কুমিল্লার ইতিহাসবিদ ও গবেষক আহসানুল কবীর বলেন, “জাহাপুরের জমিদারদের পৃষ্ঠপোষকতায় বহু রাস্তা, ব্রিজ-কালভার্ট, মাদ্রাসা, হাইস্কুল, প্রাইমারি স্কুল, পোস্ট অফিস ও দাতব্য চিকিৎসালয় গড়ে উঠেছে ওই অঞ্চলে।
“তিন একর জায়গার উপর স্থাপিত বাড়ির অধিকাংশ ভবনের বয়সই দুইশ বছরের বেশি। বিভিন্ন সময়ে জমিদারদের বংশধররা সেগুলো নির্মাণ করেছিলেন। বাড়িগুলো নির্মাণে চমৎকার চমৎকার নকশা ব্যবহার করা হয়েছিল, যা এখন আর দেখা যায় না।”
তিনি আরও বলেন, কুমিল্লা অঞ্চলের অন্যান্য জমিদার পরিবারের তুলনায় জাহাপুরের জমিদারদের বংশধররা অনেক ভালো আছেন। কারণ তারা সঠিক সময়ে শিক্ষার দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন, এজন্য মানুষ আজও তাদের মূল্যায়ন করে।
জাহাপুরের ঐতিহ্যবাহী জমিদার বাড়ির পুরোটা সম্ভব না হলেও অন্তত কয়েকটি ভবন সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি বলে মনে করেন এই ইতিহাসবিদও।
তিনি বলেন, “এতে নতুন প্রজন্ম শত শত বছর পরেও জমিদারদের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারবে। বর্তমান বংশধররা যদি এতে রাজি না হন, তাহলে সরকারের পক্ষ থেকে কিছু অংশ অধিগ্রহণ করে হলেও এই ঐহিত্য সংরক্ষণের দাবি জানাচ্ছি।”