তাদের বিশ্বাস, পদ্মা সেতু তাদের ব্যবসায় বড় কোনো বিরূপ প্রভাব ফেলবে না, বরং ঢাকা-বরিশাল পথের জৌলুস দিন দিন বাড়বে।
এরইমধ্যে সেই প্রস্তুতিও ব্যবসায়ীরা শুরু করেছেন। বাসের তুলনায় কম ভাড়ায় আরামদায়ক ভ্রমণের প্রতিশ্রুতি নিয়ে তারা ‘বিলাসবহুল’ লঞ্চ নির্মাণ অব্যাহত রেখেছেন।
সুন্দরবন ডক ইয়ার্ড ও সুন্দরবন লঞ্চ কোম্পানির চেয়ারম্যান সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, “পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর নৌপথে কিছুটা প্রভাব পড়বে প্রথম দিকে। মানুষ সড়ক যোগাযোগ কেমন তা দেখতে চাইবে।
“কিন্তু নিরাপত্তা, আরামদায়ক ভ্রমণ ও স্বল্প খরচের কারণে লঞ্চ টিকে থাকবে। নদী ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে সচল রাখা হলে ব্যবসা প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক লঞ্চও আসবে।”
বরিশাল সদর উপজেলার চেয়ারম্যান রিন্টু মহানগর আওয়ামী লীগেরও সহ-সভাপতি। বরিশাল শহরের চরআবদানী এলাকায় কীর্তনখোলা নদী তীরে তার সুন্দরবন ডক ইয়ার্ডে নির্মিত হচ্ছে নতুন লঞ্চ এমভি সুন্দরবন-১৬ ও সুন্দরবন-১৪।
ডক ইয়ার্ডের ব্যবস্থাপক সোহাগ মিয়া বলেন, আধুনিক সুযোগ-সুবিধার এ দুটি লঞ্চ চলবে বরিশাল-ঢাকা পথে।
“৩১৫ ফুট দৈর্ঘ্য ও ৬০ ফুট প্রস্থের তিনতলা লঞ্চ দুটিতে রাখা হচ্ছে লিফট সুবিধা। জুনেই এর নির্মাণ শেষ হবে। যাত্রী পরিবহন শুরু হবে জুলাই থেকে।”
ঝালকাঠির নলছিটি উপজেলার তিমিরকাঠিতে সুগন্ধা নদীর তীরে নির্মিত হচ্ছে এমভি এমখান-৭। সেখানে ঈদের পর এমখান-১১ নামে আরেকটি লঞ্চের নির্মাণকাজ শুরু হবে জানান ইয়ার্ডের ব্যবস্থাপক তারেক রহমান।
তার বিশ্বাস লঞ্চের যাত্রীরা লঞ্চেই ভ্রমণ করবেন। কারণ লঞ্চযাত্রায় সুযোগ-সুবিধা সড়কপথে মিলবে না।
“বাসের চেয়ে লঞ্চে ভাড়া কম। তাছাড়া লঞ্চে খাওয়া যায়, ঘোরাফেরা করা যায়, শুয়ে ঘুমানো যায়। বাসে একটানা বসে থাকতে হয়। অনেকের কাছে সেটা বিরক্তিকর।”
তারেক বলেন, বরিশাল-ঢাকা নৌপথে প্রতিদিন অন্তত ১০ হাজার যাত্রী আসা-যাওয়া করেন। সেজন্য ২৫০ থেকে ৩০০ বাস প্রয়োজন। তত বাস দ্রুত নামানো সম্ভব হবে না। বাস ধীরে ধীরে বাড়লেও যাত্রীরা লঞ্চে মালামাল বহনের যে সুবিধা পান, বাসে তা পাবেন না।
বলা হচ্ছে, পদ্মা সেতু চালু হলে ঢাকা থেকে বাসে করে সাড়ে তিন ঘণ্টায় বরিশালে যাওয়া যাবে, যেখানে লঞ্চে যেতে সারা রাত লাগে। সময় বাঁচবে বলে অনেকেই জরুরি কাজে নৌপথের বদলে সড়কপথে যেতে চাইবেন।
তাতে লঞ্চের যাত্রী কিছুটা কমলেও নৌপথে যাত্রায় দুর্ঘটনার হার যে সড়কের চেয়ে অনেক কম, সে কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন লঞ্চ মালিকরা। তাদের বিশ্বাস, নিরাপদ যাত্রার কথা বিবেচনা করেও অনেকে লঞ্চ বেছে নেবেন।
“কারণ লঞ্চে ডেকে একটি চাদর বিছিয়ে পরিবার-পরিজন নিয়ে চার থেকে পাঁচজন সুন্দরভাবে যেতে পারবে। সেটা বাসে সম্ভব না।“
তিনি জানান, সামনের পরিস্থিতি বিবেচনা করে আরও আধুনিক এবং দ্রুতগতির লঞ্চ বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন মালিকরা।
“আগে বরিশাল-ঢাকা লঞ্চে ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা লাগত। এখন লাগে ৬ থেকে ৭ ঘণ্টা। মালিকরা চেষ্টা করছেন আরও দ্রুতগতির আধুনিক নৌযান আনার।”
উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, “মেঘনা-দাউদকান্দি সেতু হওয়ার পর সাময়িকভাবে লঞ্চের যাত্রী কমে গেছিল। বরিশাল থেকে চাঁদপুরে যেতে বাসে সময় লাগে ছয়-সাত ঘণ্টা। সেই জায়গায় লঞ্চে এখন সময় লাগে প্রায় অর্ধেক, তিন ঘণ্টা। আবার লঞ্চ ছাড়ে ১৫ মিনিট অন্তর।”
“তাই সড়কপথ ফেলে যাত্রীরা নৌপথেই চাঁদপুরে যাতায়াত করে বেশি। বরিশাল-ঢাকা রুটেও শেষ পর্যন্ত এরকম হবে “
বরিশাল শহরের বাসিন্দা, একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকুরে শাহরিয়া হ্যাপি বলেন, ঢাকা থেকে অনেক যানজট পেরিয়ে তবেই পদ্মা সেতুতে পৌঁছানো যাবে।
“বরিশালবাসী অনেক বিলাসী। তাদের কাছে লঞ্চ একটা আবেগের বিষয়। লঞ্চের রোমাঞ্চকর যাত্রা সব সময় উপভোগ করতে চাইবেন তারা। বাসের ভাড়াও বেশি, তাতে নিম্ন আয়ের মানুষ রাজি হবে না। তারা কম টাকায় লঞ্চের ডেকেই যেতে চাইবেন।“
বরিশাল নৌবন্দরের নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের পরিদর্শক মো. কবির হোসেনও নৌপথের ভবিষ্যতে কোনো কালো মেঘ দেখছেন না।
রিশাল-ঢাকা নৌপথে এখন ২৪টি লঞ্চের অনুমোদন রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, প্রতিদিন ছয়টি করে লঞ্চ বরিশাল থেকে ছেড়ে যায় ও আসে। সব লঞ্চ সব সময় চলে না। গত ঈদে ১৫টি লঞ্চ যাত্রী পরিবহন করেছে। এর বাইরে অন্য রুটের আরও তিনটি লঞ্চ বরিশাল নৌবন্দরে থামে।
“উৎসব-পার্বণ ছাড়া প্রতিদিন ১০ হাজার যাত্রী বরিশাল-ঢাকা রুটে আসা-যাওয়া করে। পদ্মা সেতু চালুর পর এটা হয়ত কিছু কমবে। তবে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে যাবে।”