কুমিল্লায় ভোটের আগে ‘টাকা ছড়ানোর’ পাল্টাপাল্টি অভিযোগ

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের প্রচার পর্ব শেষ; ভোটের আগে মেয়র পদের প্রধান প্রার্থীদের কথায় আসছে ‘টাকা ছড়ানোর’ পাল্টাপাল্টি অভিযোগ। 

কুমিল্লা প্রতিনিধিআব্দুর রহমান, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 14 June 2022, 04:51 AM
Updated : 14 June 2022, 04:51 AM

গত ২৭ মে প্রতীক বরাদ্দ পাওয়ার পর এ সিটিতে নির্বাচনী প্রচার শুরু হয়েছিল। বিরামহীনভাবে ১৮ দিন ধরে চলা এই আনুষ্ঠানিক প্রচারের সুযোগ শেষ হয় সোমবার মধ্যরাতে। কুমিল্লা নগরবাসী এখন বুধবার সকালে ভোট শুরুর অপেক্ষায়।

সোমবার শেষ দিনে মাঠের প্রচার ছিল একেবারেই নিরুত্তাপ। গত দুইবারের মেয়র বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা মনিরুল হক সাক্কু প্রচারের শেষ দিন মাঠেই নামেননি।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত এবং বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত আরেক স্বতন্ত্র প্রার্থী ঘোড়া প্রতীকের নিজাম উদ্দিন কায়সার সোমবার বিকেল থেকে সীমিত আকারে প্রচার চালিয়েছেন।

নৌকার প্রার্থী আরফানুল হক রিফাতকে সোমবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত মাঠের প্রচারে দেখা যায়নি। বিকালের পর থেকে রাত পর্যন্ত নগরীর ২, ৯, ১০ ও ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে পথ সভা ও উঠান বৈঠক করেন তিনি।

সাংবাদিকদের তিনি বলেন, “নির্বাচনে কয়েক কোটি কালো টাকা ছড়ানো শুরু করেছেন সাক্কু। তিনি কালো টাকা ছড়িয়ে ভোটের পরিবেশ নষ্ট করছেন। এমনকি সাক্কু আমার কর্মীদেরও কালোটাকা দিয়ে কেনার চেষ্টা করছেন। কুমিল্লার মানুষ এরই মধ্যে সাক্কুকে প্রত্যাখান করেছে। জনসমর্থন হারিয়ে সাক্কু কালো টাকার উপর ভর করেছেন।”

রিফাত বলেন, “সাক্কু সারা শহরে এই কালো টাকা ছড়াচ্ছে। তবে আমি এজন্য কারো কাছে অভিযোগ দেব না। জনগণ এদেরকে প্রতিহত করবে।”

ধানের শীষ ভোটে না থাকায় সাক্কু এবার নির্বাচন করছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে টেবিল ঘড়ি প্রতীক নিয়ে। সোমবার প্রচারের জন্য তাকে ভোটের মাঠে নামতে দেখা যায়নি। নগরীর নানুয়ার দিঘির পাড়ে নিজের বাড়িতে দিনভর নেতাকর্মীদের সঙ্গে ব্যস্ত সময় কেটেছে তার।

সাক্কু বলছেন, নৌকার প্রার্থী রিফাতকে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছেন না। তার ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ স্থানীয় সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার।

“রিফাত তো এমপির নমিনি। সে তো কিছু না। সব করছেন স্থানীয় এমপি। আমি এমপি বাহারকেই প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছি। নৌকার প্রার্থী দিশেহারা হয়ে এখন আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা ও বানোয়াট অভিযোগ করেই চলেছেন। আমি কোথাও কালো টাকা ছড়াইনি। কুমিল্লার মানুষ সব বোঝে, অপপ্রচার চালিয়ে তাদেরকে বোকা বানানো যাবে না। আশা করছি আমার বিগত দিনের কাজের মূল্যায়ন করবে কুমিল্লার মানুষ।”

বাম থেকে মনিরুল হক সাক্কু, আরফানুল হক রিফাত ও নিজাম উদ্দিন কায়সার

কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি বাহার ‘আচরণবিধি ভেঙে’ দলের প্রার্থী রিফাতের পক্ষে প্রচার চালিয়ে আসছেন বলে অভিযোগ সাক্কুর। তার অভিযোগের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন বাহারকে এলাকা ছাড়তে বলেছিল। তবে কুমিল্লা ৬ আসনের এই এমপি হাই কোর্টে গিয়ে ইসির আদেশের বিরুদ্ধে রুল পেয়েছেন।

স্বেচ্ছাসেবক দলের সহ সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ ছেড়ে ভোটে আসা ঘোড়া প্রতীকের প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সার সোমবার বিকাল পর্যন্ত নেতাকর্মীদের সঙ্গে নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত ছিলেন। বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত নগরীর ১৭ ও ২৭ নম্বর ওয়ার্ডে তিনি উঠান বৈঠক ও পথসভা করেছেন।

সেখানে তিনি বলেন, “সংসদ সদস্য (বাহার) আচরণবিধি লঙ্ঘন করে এলাকায় অবস্থান করছেন। এটা নির্বাচন কমিশনের অসহায়ত্বের নজির। সংসদ সদস্য বাহার চাইছেন ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের মত ঠগবাজি করে তার সমর্থিত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী রিফাতকে জয়ী করতে। সে ছকই আঁকছেন তিনি।

“এমপি বাহার লোকজন দিয়ে সিটির অসহায়-গরিব মানুষের আইডি কার্ড আটকে রেখেছেন, নৌকায় ভোট দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলে সেসব আইডি কার্ড ফেরত দেওয়া হচ্ছে।”

কায়সারও অভিযোগ করেন, “নির্বাচনে কোটি কোটি কালো টাকা ছড়ানো হচ্ছে। রিফাত ও সাক্কু এসব কালো টাকা ছড়াচ্ছেন। এরই মধ্যে কুমিল্লার মানুষ সব বুঝে গেছে। ভোটাররা এবার পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা পরিবর্তনের প্রতীক ঘোড়াকে বেছে নেবে। কুমিল্লার মানুষ দুর্নীতিবাজ ও মাদক কারবারিদের বয়কট করেছে। চারদিকে ঘোড়ার গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে।”

সাক্কু ও কায়সারের অভিযোগের বিষয়ে সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের বক্তব্য জানা যায়নি। নির্বাচন কমিশন নোটিস দেওয়ার পর থেকে তিনি আর সংবাদমাধ্যমের সাথে কথা বলছেন না।

তবে কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক রিফাত বলছেন, “বাহার ভাইয়ের জন্ম কুমিল্লার মাটিতে। তিনি কুমিল্লাতেই থাকবেন। আপনারা কি দেখেছেন বাহার ভাইকে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নিতে? একজন ব্যক্তি অভিযোগ করেছেন, তা যাচাই বাছাই না করে ইসি একটি নোটিস দিয়ে দিয়েছে। এটা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্য।”

এমপির শক্তিতেই ভোট করছেন কি না- এমন প্রশ্নে রিফাত বলেন, “আমার শক্তি জনগণ। জনগণের শক্তি এমপি বাহার। আশা করি কুমিল্লায় একটি শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

“গত ১৬ বছরে সাক্কু পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনের মেয়র ছিলেন। আমি বলতে চাই তিনি সর্বক্ষেত্রে ব্যর্থ হয়েছেন। নগরবাসী তাদের প্রত্যাশিত সেবা পায়নি। এবার উন্নয়নের স্বার্থে কুমিল্লার মানুষ নৌকাকে বেছে নেবে।”

কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে আরও দুই প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। তারা হলেন- কুমিল্লা নাগরিক ফোরামের সভাপতি স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান বাবুল (হরিণ প্রতীক) এবং ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মো. রাশেদুল ইসলাম (হাতপাখা)। তবে ভোটের আলোচনায় তাদের উপস্থিতি খুব একটা নেই। শেষ দিনে নগরীতে তাদের প্রচার চালাতেও দেখা যায়নি।

এ নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরী বলেন, “কাল মধ্যরাতে প্রচার শেষ হয়েছে। এরই মধ্যে ভোটগ্রহণের জন্য আমাদের সার্বিক প্রস্তুতি শেষ হয়েছে। কেন্দ্রে কেন্দ্রে মঙ্গলবারের মধ্যে পৌঁছে দেওয়া হবে ভোটের সামগ্রী। আশা করছি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। কোথাও কোনো অনিয়ম হলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।”

এদিকে সোমবার মধ্যরাতে প্রার্থীদের গণসংযোগ শেষ হওয়ার পর থেকেই গোটা নগরী নিরাপত্তার চাদরে মুড়ে দিতে শুরু করেছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী।

রাত ১২টা থেকে নগরীতে মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে জেলা পুলিশ। নির্বাচনের পর দিন বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এলাকায় জরুরি সেবায় নিয়োজিত ও কার্ডধারী সাংবাদিক ছাড়া মোটরসাইকেল চলাচল বন্ধ থাকছে।

কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) সোহান সরকার বলেন, “সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।”

কুমিল্লার পুলিশ সুপার মো. ফারুক আহমেদ জানান, সিটি নির্বাচনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তিন হাজার ৬০৮ সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। ৭৫টি চেকপোস্ট, ১০৫টি মোবাইল টিম, ১২ প্লাটুন বিজিবি, র‌্যাবের ৩০টি টিম, অর্ধশতাধিক নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, ৯ জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট ভোটের মাঠে থাকছেন।

কুমিল্লার ডিসি মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, “আইনশৃংখলা কমিটির সভায় আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি কীভাবে নির্বাচন সুষ্ঠু করা যায়। সে মোতাবেক এগিয়ে যাচ্ছি। সিটি নির্বাচনে সম্পৃক্ত সবকিছুই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে দেখছি।”

বুধবার সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ১০৫টি ভোটকেন্দ্রের ৬৪০টি বুথে ইভিএমে ভোট গ্রহণ হবে। এ নগরীর ২৭টি ওয়ার্ডে ভোটার আছেন ২ লাখ ২৯ হাজার ৯২০।

মেয়র পদে পাঁচ প্রার্থী ছাড়াও সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৩৬ জন এবং সাধারণ ওয়ার্ডে কাউন্সিলর পদে মোট ১০৮ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এ নির্বাচনে।