ময়লা-আবর্জনা, তরকারির অবশিষ্টাংশ, খাবারের উচ্ছিষ্ট, পচা ফলমূলের মতো ময়লার ভাগাড় 'ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই'য়ের জন্য উপযুক্ত আবাস। দেশে এ ধরনের পরিবেশ খুবই সহজলভ্য বিধায় 'ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই' পোল্ট্রিশিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে পারে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. শাখাওয়াত হোসেন বলেন, "এটি থেকে মাছ পাবে পুষ্টিকর খাবার, এতে মাছের উৎপাদন বাড়বে। এ ছাড়া বাড়বে মাছ, মাংস ও ডিমের উৎপাদনও।
“অন্যদিকে এর মল থেকে উৎপাদিত জৈবসার কৃষিজপণ্যের দ্বিগুণ উৎপাদনে সহায়ক ভূমিকা রাখবে,” যোগ করেন অধ্যাপক।
সম্প্রতি আলাপচারিতায় খামারি সুমন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ছয় মাস আগে তিনি হুট করেই এই খামার তৈরির পরিকল্পনা নেন। মোবাইল ফোনে ইউটিউব চ্যানেল ব্রাউজ করার সময় হঠাৎ করে তার চোখ আটকে যায় 'ব্ল্যাক সৌলজার ফ্লাই' এর একটি ভিডিওতে। এরপর থেকে তিনি এটি নিয়ে গবেষণা শুরু করেন।
প্রথমে শ্রীমঙ্গল কলেজ রোডের ময়লার ভাগাড় দুই কেজি কালো মাছির লার্ভা বা পিউপা দিয়ে খামার শুরু করেন সুমন। বর্তমানে তার পিউপার পরিমাণ প্রায় ৩০০ কেজি।
কালো রঙের এই মাছি অনেকের কাছে ‘পোকা’ হিসেবেও পরিচিত। এটি আকারে মাছির তুলনায় কিছুটা লম্বা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, 'ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই' এর 'জীবনচক্র বা লাইফ সার্কেল' পুরোটাই পৃথিবীর জন্য উপকারী। একটি স্ত্রী মাছি প্রতি মাসে পাঁচ থেকে আটশ ডিম দেয়। তবে ডিম দিতে 'ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই'র প্রয়োজন ময়লার ভাগাড় বা উচ্ছিষ্ট খাবার।
উচ্ছিষ্ট খাবার খেয়ে কয়েকদিনেই ‘ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই’ লার্ভায় পরিণত হয়। ২১ দিন পর মরে যাওয়া লার্ভা হাঁস-মুরগি ও মাছের খাবারের উপযুক্ত হয়।
আর যেসব লার্ভা বেঁচে থাকে সেগুলো যে মল ত্যাগ করে সেটি আবার জৈব সার হিসেবে শাক-সবজি ও ফসলের মাঠে ব্যবহার করা হয়। এই লার্ভিই পরিণত হয় পিউপায়, আর্থাৎ মাতৃপোকায়।
পিউপা তার জীবনকালের এক সময়ে খাবার বন্ধ করে দেয় এবং ধীরে ধীরে এদের চামড়া শক্ত হয়। পরে খোলস ছাড়িয়ে পরিপূর্ণ ‘ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই’য়ে পরিণত হয়।
একদিকে বর্জ্য এই কালো ‘মাছি’র খাবারে ব্যবহৃত হচ্ছে। অন্যদিকে এরাও পোল্ট্রি খাবার এবং জৈবসার হিসেবে কাজে আসছে।
সুমন আহমদ বলেন, “বিদেশ থেকে ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই পোল্ট্রি খাদ্য হিসেবে আনা হচ্ছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশেও হাতেগুনা কয়েকটি এলাকায় এর উৎপাদন শুরু হলেও চাহিদার তুলনায় এখনও তা অনেক কম।"
নিজের খামার ছাড়াও ফেঞ্চুগঞ্জে ‘ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই’ এর আরেকটি খামার আছে বলে জানান সুমন।
মাতৃপোকার কেজি আড়াই হাজার টাকা
খামারিদের মধ্যে 'ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই' চাষাবাদে আগ্রহ তৈরিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোকে সমন্বিতভাবে কাজ করার তাগিদ দিয়েছেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. শাখাওয়াত হোসেন।
“বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ‘ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই’ এর চাষাবাদ বৃদ্ধি করার পাশাপাশি খামারিদের মধ্যে আগ্রহ সৃষ্টি করতে সরকারের মৎস্য, কৃষি ও প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও পরিবেশ মন্ত্রণালয় যৌথভাবে কাজ করা দরকার।"
এই চা-বিজ্ঞানী বলেন, "এটি (ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই) চাষের জন্য আমাদের ময়লা ব্যবস্থাপনা আপডেট করতে হবে। বিশেষ করে পলিথিন ও শক্ত ময়লা আলাদা করে ও পচনশীল পণ্যের জন্য আলাদা ময়লার ডাম্পিং স্টেশন করা উচিৎ।"
খামারি সুমন আহমদ আরও জানান, তার খামার থেকে প্রতি কেজি লার্ভা বিক্রি হয় ৫০ টাকায়, মাতৃপোকা পিউপা বিক্রি করছেন দুই থেকে আড়াই হাজার টাকায় এবং পোকা থেকে উৎপাদিত জৈব সার বিক্রি হচ্ছে ২৫ থেকে ৩০ টাকা কেজি দরে।
পোল্টি খামারিরা নিজেরাই 'ব্ল্যাক সোলজার ফ্লাই' চাষ করলে কম খরচে খাবার তৈরি করতে পারবে বলে মনে করেন এই খামারি।