এ জীবন ‘মহাতৃপ্তির, মহাপ্রাপ্তির’: ‘গুণীশ্রেষ্ঠ’ সম্মাননায় মুহিত

সাম্প্রদায়িক অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করাই জীবনের বড় উদ্দেশ্য হওয়া উচিত বলে মনে করেন সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত; সেই আদর্শ নিয়ে জীবনের ৮৮ বছর পূর্ণ করা মুহিত বলেছেন, এ জীবন তার ‘মহাতৃপ্তি আর মহাপ্রাপ্তির’।

সিলেট প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 March 2022, 05:24 AM
Updated : 17 March 2022, 05:41 AM

বুধবার রাতে সিলেট সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে 'আজীবন সুকীর্তির স্বীকৃতিস্বরূপ' আবুল মাল আবদুল মুহিতকে ‘গুণীশ্রেষ্ঠ সম্মাননা’ দেওয়া হয়।

সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর সভাপতিত্বে নগরের সুরমা নদীর তীরের চাঁদনীঘাট এলাকায় হয় ওই অনুষ্ঠান।

বার্ধক্যের নানা জটিলতায় সাবেক অর্থমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় উপদেষ্টামণ্ডলীর বর্ষীয়ান এই সদস্য মাঝেমধ্যেই অসুস্থ থাকছেন।

শারীরিক দুর্বলতার কারণে তাকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছিলে মার্চের প্রথম সপ্তাহে। হাসপাতালের চিকিৎসার পর অবস্থা কিছু ভালো হলে কয়েকদিন পর ঢাকার বনানীর বাসায় ফেরেন তিনি।

এর আগেও ২০২১ সালেও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হলে মুহিতকে ঢাকা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসা নিতে হয়েছিল।

এবার হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরার পর সিলেটে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে গত সোমবার নিজের শহরে নিয়ে আসা হয় তাকে।

সম্মাননা অনুষ্ঠানে তার প্রতি জন্মভূমির কৃতজ্ঞতাকেই সবচেয়ে 'বড় প্রাপ্তি' হিসেবে বর্ণনা করে আপ্লুত মুহিত বলেন, "আমি একান্তভাবে সিলেটের মানুষ। আমার জন্মভূমি আমার জন্য কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছে এটার চেয়ে বড় প্রাপ্তি তো আর কিছু হতে পারে না।”

তার ভাষায়, “প্রাপ্তির নিয়মকানুন ঠিক করা এবং সেগুলো প্রতিপালনের দায়িত্ব নেওয়া, এটা জীবনের একটি বড় শিক্ষা। এটা আমাদের প্রত্যেকের জীবনে হয়। সকলকে এটি প্রতিপালনের দায়িত্বের ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।”

মুহিতের স্মৃতিচারণায় উঠে আসে তার শৈশবের কথা। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশিবার বাজেট দেওয়া সাবেক এই অর্থমন্ত্রীর ছেলেবেলা গ্রামেই কেটেছে।

“গ্রামের জীবন খুব উপভোগ্য ছিলে। সেখানে যে স্বাধীনতা পাওয়া যায় তা আর কখনো পাওয়া যায় না। পরে সিলেট শহরে এসে সুরমা নদীর পাড়ে স্কুলে ভর্তি হই। সেই সময়টাও ছিলে আনন্দের।”

সাম্প্রদায়িকতার সঙ্কটের প্রসঙ্গও এসেছে মুহিতের বক্তব্যে। তার ভাষায়, “এটা খুবই দুর্ভাগ্য ভারতীয় উপমহাদেশের, এখানে সাম্প্রদায়িক ইস্যু এসে যায়। এখানে সাম্প্রদায়িক দুর্বলতা খুব বেশি। আগেও ছিল। এখনও রয়েছে। তবে এখন হয়ত অনেক ভদ্র হয়ে যাচ্ছে।”

সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চর্চায় সিলেট শহরের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথাও তুলে ধরেন মুহিত।

তিনি বলেন, “ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে হযরত শাহজালাল (রহ.) এখানে এসেছিলেন। আমরা বেশিরভাগ মানুষই তার মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছি। ধর্মাচার পালন করে আসছি। আমাদের এখানে অন্যান্য ধর্মের আনুষ্ঠানিকতাও সমানভাবে পালিত হয়।

“এখানে যে মহাসমারোহে পূজা হয়, দেশের অনেক স্থানেই তেমনটি হয় না। এখানকার ধর্মীয় সম্প্রীতির ঐতিহ্য বহু পুরানো “

সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে নিজের জীবন নিয়ে মুহিতের মূল্যায়ন: “আমি আমার জীবনকে নিয়ে গর্বিত।… অনেকে হয়ত একে আত্মগরিমা বলবেন। কিন্তু এটা অন্যায় নয়। বরং এরজন্য নিজেকে গড়ে তুলতে হয়।"

সম্মাননা অনুষ্ঠানের সিলেটের নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে স্বাগত বক্তব্য দেন নর্থইস্ট ইউনিভার্সিটির উপাচার্য অধ্যাপক ইলিয়াস উদ্দিন বিশ্বাস। মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বিধায়ক রায় চৌধুরী।

সেখানে বলা হয়, ‘বহুমাত্রিক প্রতিভাধর গুণী’ আবুল মাল আবদুল মুহিতের জীবন ‘সিলেটের দীর্ঘতম নদী সুরমার মত বহমান।’

সংসদে সর্বোচ্চ ১২ বার বাজেট দেওয়া সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ছিলেন সিলেট-১ আসনের সাংসদ। ১৯৩৪ সালের ২৫ জানুয়ারি সিলেটে তার জন্ম।

পঞ্চাশের দশকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর করে যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি নেন মুহিত।

ছাত্রজীবনে সলিমুল্লাহ হল ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন তিনি। সক্রিয় ছিলেন ভাষা আন্দোলনেও।

১৯৫৬ সালে মুহিত যোগ দেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে (সিএসপি)। কূটনীতিকের দায়িত্বে তাকে পাঠানো হয় পাকিস্তানের ওয়াশিংটন দূতাবাসে। একাত্তরের জুন মাসে তিনি পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন।

১৯৭২ সালে পরিকল্পনা সচিবের দায়িত্ব পালনের পর ১৯৭৭ সালে অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বহিঃসম্পদ বিভাগে সচিবের হন মুহিত। ১৯৮১ সালে চাকরি থেকে স্বেচ্ছায় অবসরে গিয়ে ‘অর্থনীতি ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসেবে’ কাজ শুরু করেন ফোর্ড ফাউন্ডেশন ও আইএফএডি-তে।

১৯৮২-৮৩ সালে তখনকার এইচ এম এরশাদ সরকারের সময়ে প্রথমবারের মত অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্বে আসেন মুহিত।

দীর্ঘদিন বিশ্ব ব্যাংক ও জাতিসংঘের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পরামর্শক হিসেবে কাজ করার পর দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হন মুহিত। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি পান অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব। টানা দশ বছর তিনি সেই দায়িত্ব সামলেছেন।