পাহাড়ে পানি রাখতে ‘লাউয়ের খোল’

প্লাস্টিক ও অ্যালুমিনিয়াম পাত্রের পরিবর্তে লাউয়ের খোলকে ‘বিশেষ প্রক্রিয়ায়’ পানি সংরক্ষণের পাত্র বানিয়ে ব্যবহার করছে বান্দরবানের ম্রো ও খুমীসহ কয়েকটি জনগোষ্ঠী।

উসিথোয়াই মারমা বান্দরবান প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 Dec 2021, 07:01 AM
Updated : 4 Dec 2021, 07:34 AM

লাউয়ের খোলের এ পাত্রকে ম্রো ভাষায় ‘তুইয়া’ বলা হয়। সাধারণত পাহাড়ি দুর্গম এলাকার ঝর্ণা-ঝিরি থেকে পানি সংগ্রহ করে রাখা হয় এতে। এই পাত্র একদিকে যেমন পরিবেশবন্ধব, অন্যদিকে গরমের সময় পানিকে ঠাণ্ডা রেখে প্রশান্তি আনে শরীর-মনে।

ম্রো ও খুমীরা বলছেন, লাউয়ের খোলে অন্তত এক সপ্তাহ পানি রাখা যায়; গরমকালে এতে পানি বেশ ঠাণ্ডাই থাকে। ঝিরি-ঝরণার পানি অপরিষ্কার থাকলে পাত্রের একটা নরম অংশ আপনা-আপনিই তা ‘পরিশুদ্ধ’ করে।

গরমকালে জুমক্ষেতে কাজ করার সময় পানিভর্তি লাউয়ের খোল অনেকে কলা গাছের গোড়ায় গর্ত করে পুঁতে রাখেন। ঘণ্টা দুয়েক পরে এর পানি ফ্রিজে রাখা পানির মত ঠাণ্ডা হয়ে যায়। অভ্যস্ততা না থাকলে শিশুরা হঠাৎ খেলে অনেক সময় সর্দি-কাশিও লেগে যায়।

ম্রো ও খুমীদের গ্রামে গেলে প্রত্যেকের ঘরে অন্তত ত্রিশ থেকে চল্লিশটা ‘তুইয়া’ বা লাউয়ের খোলের দেখা মিলবে। ত্রিপুরা এবং বম জনগোষ্ঠীর মধ্যে লাউয়ের খোল ব্যবহার থাকলেও তা শুধুমাত্র দুর্গম এলাকায় দেখা যায়।

লাউয়ের খোল কিভাবে তৈরি হয় ‘পানির পাত্র’

সাধারণরত জুমক্ষেতে কিংবা ঘরের চালে ফলন হয়ে থাকে এই লাউ। তবে এই জাতের লাউ খাওয়া যায় না। প্রথমে সুন্দর ও ভাল আকারের পরিপক্ক লাউ দেখে সংগ্রহ করা হয়। এরপর ছিদ্র করে ভেতরে পানি জমিয়ে রেখে পঁচানো হয় ভেতরের অংশ। পনের-বিশ দিন পর পঁচা অংশ ফেলে দিয়ে পরিষ্কার করে নিতে হয়। তারপর ভাল করে শুকানো হয় রোদে।

শুকনো লাউকে ঘরে চুলার উপর ঝুলিয়ে রাখা হয় কয়েক মাসের মত। এক সময় লাউয়ের বাইরে অংশ কালো হয়ে ওঠে। তারপর ভাল করে ধুয়ে ব্যবহার করা হয় পানির পাত্র হিসেবে।

তবে যেগুলো পানির পাত্র হিসেবে ব্যবহারযোগ্য নয় সেগুলোতে জুমের বিভিন্ন বীজ রেখে দেওয়া হয়। জুমবীজ ছাড়াও ঘরে হলুদ এবং লবনের পাত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে এ লাউয়ের খোল। ফেটে না গেলে কিংবা না ভাঙলে এই খোল অনেক বছর পর্যন্ত ব্যবহার করা যায়।

ম্রো জনগোষ্ঠীর ব্যবহার

বান্দরবান সদর থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে চিম্বুক পাহাড়ে গিয়ে দেখা যায়, রামরি পাড়ায় জুমিয়ারা জুমক্ষেতে কাজ করার সময় সঙ্গে লাউয়ের খোলের পানির পাত্র রাখেন। ক্লান্ত হয়ে পিপাসা লাগলে লাউয়ের খোলের পানি পান করেন তারা।

কথা সেই দলের ষাটোর্ধ্ব বয়সী চিংতুই ম্রো  ও রুইতন ম্রোর সঙ্গে। তিনি বলেন, “লাউয়ের খোলকে আমরা ঘরে এবং ঘরের বাইরে পানির পাত্র হিসেবে ব্যবহার করে থাকি। ঘরে অনেকগুলো লাউয়ের খোলে পানি জমা করে রাখা হয়। আবার ক্ষেতখামারে গেলে খোলে পানি ভরে নিয়ে যাই খাওয়ার জন্য।

“এক সময় দুর্গম পাহাড়ি এলাকায় জগ পর্যন্ত ছিল না। পানি রাখার জন্য তখনকার সময় প্লাস্টিকের কোন কিছুই বের হয়নি। জগের বিকল্প হিসেবে লাউয়ের খোল ব্যবহার করে আসছি। বলা যায় এটি এক ধরণের পাহাড়ি জগ।”

তাইলেং নামে এক ম্রো নারী জানান, প্লাস্টিক বোতলে পানি রাখলে খাওয়ার সময় গন্ধ আসে। বরং লাউ খোলের পানি খেতে ভাল লাগে। দীর্ঘদিন ব্যবহার করে তারা অভ্যস্ত হয়ে গেছেন। গরমকালে এই পাত্রের পানি ঠান্ডা হয়ে থাকে। তার ঘরে কমপক্ষে ৪০টি লাউয়ের খোল রয়েছে।

মেলকন ম্রো নামে আরেক নারী বলেন, ঝিরি থেকে প্রতিদিন লাউয়ের খোলে পানি সংগ্রহ করতে হয়। এক থুরুংয়ে (ঝুড়িতে) কমপক্ষে ১০-১২টি লাউয়ের খোল বহন করা যায়। ঘরে ফিরে খোলগুলোর মুখ কলাপাতা মুরিয়ে আটকে রাখা হয়, যাতে ময়লা না পড়ে।

এ বিষয়ে ম্রো ভাষার লেখক ও গবেষক ইয়াংঙান ম্রো বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, পানি সংরক্ষণের পাত্র লাউয়ের খোলকে ম্রো ভাষায় ‘তুইয়া’ বলা হয়। প্রত্যেক ম্রোর ঘরে কমবেশি এই লাউয়ের খোল রয়েছে। জুমক্ষেতে এবং বাগানে যারা কাজ করেন তারা পানি ভরে সঙ্গে করে নিয়ে যায় খাওয়ার জন্য।

কখন থেকে এই লাউয়ের খোলকে পানির পাত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে এমন প্রশ্নে-এই গবেষক বলেন, “নয়শ খ্রিষ্টাব্দে আরাকানে ম্রো এবং খুমিদের মধ্যে একবার যুদ্ধ হয়েছিল। এই যুদ্ধে ম্রোরা হেরে যায়। তখন আরাকান থেকে পালিয়ে বনজঙ্গলে আশ্রয় নেন তারা। বেঁচে থাকার জন্য খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি নানা পদ্ধতি বের করেন ম্রোরা। তখন কোনো এক সময় লাউয়ের খোলকে পানির পাত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয় বলে জানা যায়।”

খুমীদের ব্যবহার

বান্দরবান জেলা পরিষদের সদস্য ও খুমী সোস্যাল কাউন্সিলের সহ-সভাপতি সিঅং খুমী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, খুমীদের এখনও দুর্গম এলাকার বেশির ভাগ বাসিন্দা ঝিরি-ঝরণা এবং খালের পানির উপর নির্ভরশীল। তারা এসব পানি লাউয়ের খোলে সংরক্ষণ করে রাখে। আর লাউয়ের খোলের পানিই খায়।’’

এক সময় দুর্গম অঞ্চলে ঘরে পানি সংরক্ষণ করে রাখার কোন উপায় ছিল না। ব্যবহারের জন্য এক সময় কোন কলস ও প্লাস্টিকের জিনিসপত্র পর্যন্ত ছিল না। ফলে তাদের আগের প্রজন্মের বয়োজ্যেষ্ঠরা লাউয়ের খোলকে বিশেষ কায়দায় করে পানি সংরক্ষণ করে রাখত বলে জানান তিনি।

অন্যান্য জনগোষ্ঠীর ব্যবহার

পাহাড়ে অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে ত্রিপুরা ও বম সম্প্রদায়রা লাউয়ের খোল ব্যবহার করে থাকে। তবে তাদের মধ্যেও দুর্গম এলাকার জুমচাষি ছাড়া আর ব্যবহার করতে দেখা যায় না।

এ প্রসঙ্গে রুমা উপজেলার ইডেন পাড়ার বাসিন্দা ভাননুন সিয়াম বম বলেন, ৮০ দশক পর্যন্ত বমদের ঘরে ঘরে লাউয়ের খোল ব্যবহার প্রচলন ছিল। কিন্তু বমরা জুম চাষাবাদ থেকে বিভিন্ন ফলদ বাগান চাষে পরিবর্তিত হওয়ার পর এর ব্যবহার দিন দিন কমতে থাকে।

‘‘এখন বম পাড়ার কোথাও কারও ঘরে লাউয়ের খোল ব্যবহার চোখে পড়বে না। তবে কেওক্রাডং পাহাড়ে পাদদেশে কয়েকটি পাড়া এবং আরও কিছু দুর্গম এলাকার পাড়ায় গেলে হয়তো কিছু জুমচাষিরা ব্যবহার করে থাকবে।’’

তবে বান্দরবান জেলার দুর্গম পাড়া ত্রিপুরাদের মধ্যে এখনও লাউয়ের খোল ব্যবহার রয়েছে জানান রুমা উপজেলার রেমাক্রিপ্রাংসা ইউনিয়নের জনেরাং পাড়ার বাসিন্দা রামবাদু ত্রিপুরা স্টিভ।