উত্তরে হঠাৎ বন্যায় ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি

দুই দিনের টানা বর্ষণ ও উজানের ঢলে ডুবে গেছে উত্তরের কয়েকটি জেলায় অনেক ফসলি জমি।

আফতাবুজ্জামান হিরু রংপুর প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Oct 2021, 04:05 PM
Updated : 20 Oct 2021, 05:55 PM

তিস্তা, ঘাঘটসহ বিভিন্ন নদনদীর পানি বেড়ে নিম্নাঞ্চলে হঠাৎ বন্যা দেখা দিয়েছে। এতে আলু, মিষ্টি কুমড়াসহ নানা রবিশস্যের ক্ষেত ডুবে কৃষকরা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়েছে।

হঠাৎ উজানের ঢল নেমে ভাটি অঞ্চলখ্যাত বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে তিস্তা অববাহিকায় পানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তিস্তাবেষ্টিত লালমনিরহাট ও নীলফামারী ছাড়াও রংপুরের গঙ্গাচড়ার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় দেখা দিয়েছে আকস্মিক বন্যা। কাউনিয়া ও পীরগাছা উপজেলার বিস্তীর্ণ ফসলের ক্ষেত প্লাবিত হয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, তিস্তার পানি দোয়ানি পয়েন্টে বিপৎসীমার ৬০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তা ব্যারাজের সড়কের 'ফ্লাড বাইপাস' ভেঙে গেছে। তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয়রা জানিয়েছেন, আকস্মিক বন্যার তোড়ে গঙ্গাচড়া উপজেলার ছালাপাক, চর চল্লিশা, আলমবিদিতর, লক্ষ্মীটারি, কোলকোন্দ, নোহালী ও গজঘণ্টার নিম্নাঞ্চলে পানি ঢুকে পড়েছে। অনেক পরিবার এখন পানিবন্দি হয়ে আছে।

নদীঘেঁষা চরাঞ্চলসহ নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হওয়ায় অনেকেই উঁচু জায়গায় আশ্রয় নেয়। লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের চরইশরকুল, ইছলি, পূর্ব ইছলি, পশ্চিম ইছলি ও শংকর, বাগেরহাট, কেল্লারহাটসহ বেশকিছু নিচু এলাকায় কৃষিজমি পানিতে তলিয়ে আছে।

চর চল্লিশার কৃষক আজমত আলী (৬০) বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পানির নিচে থাকলে আলুগুলো নষ্ট হয়ে যাবে। কিছু দিন আগেই লাগিয়েছিলাম। এখনই তুলতে হচ্ছে। আমাদের অনেক ক্ষতি হয়ে গেল। জানি না কীভাবে মহাজনের ঋণ শোধ করব।”

পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন কৃষক মনসুর মিঞা। তিনি এবার ২ একর জমিতে আগাম আলু রোপন করেছেন।

মনসুর মিঞা বলেন, “গতবার আলুতে অনেক লোকসান হয়েছে। তাই এবার আগাম আলু চাষ করে কিছুটা ক্ষতি পুষিয়ে ওঠার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু সব সপ্ন পনিতেই ডুবে গেল।”

চর ছালাপাকের আলুচাষি হালিম মিয়া বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিবছর অধিক লাভের আশায় এ এলাকার লোকজন আগাম জাতের আলুর বীজ লাগায়। গত বুধবার সকালে ৪০ শতক জমিতে রোমানা জাতের হাইব্রিড আলুর বীজ লাগিয়েছি। কিন্তু টানা বৃষ্টির কারণে আলু নিয়ে বিপাকে পড়েছি। আজ জমি থেকে আলুর বীজগুলো তুলতে না পারলে সব পচে যাবে।”

আরেক চাষি কামাল হোসেন (৫০) বলেন, “এবার আমি ১ বিঘা জমিতে ৫৬ সবজি লাগিয়েছি। সার, শ্রমিক খরচ ও জমি চাষের খরচসহ সব মিলে শুধু বীজ লাগাতেই প্রায় ২০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। দুদিনের টানা বৃষ্টিতে আমার অনেক ক্ষতি হয়ে গেল।”

লক্ষ্মীটারী ইউনিয়নের বাগেরহাট এলাকার কৃষক আব্দুর রহিম মিয়া বলেন, “মহিপুর সেতুর কাছে চরোত একনা আগাম আলু আর মিষ্টিকুমড়া নাগাচু (লাগিয়েছি)। শীতের সময় নয়া আলুর দাম বেশি পাওয়া যায়। কিন্তু কাল আইত থাকি হঠাৎ তিস্তাত পানি বাড়ছে। হু হু করি পানি ঢুকি আবাদসুবাদ সোগে তলে গেইচে। এ্যালা হামাক ঘরবাড়ি ছাড়ি উচা জাগাত যাওয়া নাগবে। চেয়ারম্যান সাইব সকালে মাইকিং করি আশ্রয় কেন্দ্রোত যাবার কইছে। বাহে হামার গরিবের দুক্কো বারো মাস।”

মর্নেয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, কার্তিক মাসে নদীতে চর জেগে ওঠায় নদীতীরবর্তী মানুষ চাষাবাদ শুরু হয়েছে। গেল বন্যার ধকল সামলে না উঠতেই আবার বন্যা দেখা দিয়েছে। এই অসময়ে ভারতের উজান থেকে আসা তিস্তায় পানি বেড়েছে। এতে বাড়িঘর, আবাদি জমি, নিম্নাঞ্চল ডুবে গেছে। ভয়াবহ এ বন্যায় ইউনিয়নের ছালাপাক চর, মর্নেয়ার চরসহ বেশ কিছু গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

তিস্তাপাড়ের মানুষজনকে নিরাপদ স্থানে নিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “রাত থেকে পানি বাড়তে শুরু করেছে। ভোর থেকে নদীতীরবর্তী মানুষজনকে নিরাপদ স্থানসহ আশ্রয় কেন্দ্রে আসার জন্য মাইকিং করেছি। বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে সার্বিক পরিস্থিতি উপজেলা প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানিয়েছি।”

বুধবার সকাল ৯টায় লালমনিরহাটের হাতীবান্ধার দোয়ানী ব্যারাজ পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপৎসীমার ৬০ সেন্টিমিটার এবং নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্টে বিপৎসীমার ৫০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের ডালিয়া বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আসফাউদ্দৌলা প্রিন্স বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “উজানে ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলের কারণে তিস্তার পানি বৃদ্ধি পেয়েছে, যা তিস্তা পয়েন্টে এ মৌসুমের সর্বোচ্চ পানিপ্রবাহ। এ জন্য আমরা তিস্তা ব্যারাজের ৪৪টি গেট খুলে দিয়ে নদীর পানিপ্রবাহ অব্যাহত রেখেছি।”