গুড়ের যশোরে খেজুরের বাণিজ্যিক চাষ

‘নকশী কাঁথা, ফুলের মেলা, খেজুর গুড়ের যশোর জেলা’ এমন কথা লোকমুখে চালু থাকলেও নানা কারণে কমে গিয়েছে খেজুর গাছ। তাই দেশে ‘প্রথমবারের মতো’ বাণিজ্যিকভাবে খেজুরের চাষ শুরু হয়েছে।

আসাদুজ্জামান আসাদ, বেনাপোল প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 8 Dec 2020, 07:11 AM
Updated : 8 Dec 2020, 08:20 AM

কৃষি বিভাগ, বনবিভাগ আর স্থানীয়রা বাণিজ্যিকভাবে এখন জেলায় চারা ও বীজ লাগাচ্ছে। তৈরি করা হচ্ছে খেজুর বাগান।

শার্শা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সৌতম কুমার শীল জানিয়েছেন, ‘দেশে এখানেই প্রথম বাণিজ্যিকভাবে’ খেজুর বাগান করা হচ্ছে।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বিভিন্ন এলাকায় রাস্তার পাশে পাঁচ হাজার খেজুর গাছ লাগানো হয়েছে। এছাড়া উপজেলার বিভিন্ন স্থানে ৩৫ হাজার পুরাতন খেজুর গাছ রয়েছে।

“গত বছর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে এক হাজার দেশি জাতের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্য থেকে আনা খেজুরের চারা লাগানো হয়েছে পরীক্ষামূলকভাবে।”

এসব খেজুর গাছ লাগানোর মাধ্যমে বাণিজ্যিক সম্ভাবনা যাছাই ও স্থানীয় কৃষক ও হত দরিদ্রদের স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

বেনাপোল, মাটিপুকুর, কাগজপুকুর, জিরেনগাছা, শাখারীপোতা, বারোপোতা, রঘুনাথপুর ও ডিহি এসব জায়গায় খেজুর চাষের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

খেজুর বাগান কমে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে স্থানীয়রা জানান, অনেকেই বেশ চড়া দামে ইটভাটার মালিকদের কাছে খেজুর গাছ বিক্রি করে দেয়। অথচ এরপর আর নতুন করে কেউ খেজুর গাছ লাগায় না।

এছাড়া গ্রামীণ সড়কের সংস্কার কাজের কবলে পড়েও অনেক স্থানের খেজুর গাছ উজাড় হয়ে গেছে।

খেজুর গাছের রস সংগ্রহের জন্য গাছিদের সংখ্যা কমে যাওয়ায় অনেকে খেজুর বাগান উঠিয়ে দিয়ে অন্য ফলের বাগান তৈরি করেছে। এভাবেই দিন দিন কমে যাচ্ছে খেজুর গাছের সংখ্যা বলছেন স্থানীয়রা।

অন্যান্য ফসলের মতো ব্যাপকভাবে খেজুর চাষ করা হয় না, বসতবাড়ি, মাঠ, জমির আইল, রাস্তার ধারে জন্মে এসব গাছ। তাই ঠিক কতটুকু জমিতে খেজুরের আবাদ হচ্ছে তার হিসাব কষা মুশকিল। আর গাছের সংখ্যা নিয়েও রয়েছে নানা মত।

যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর বলছে, যশোরের আট উপজেলায় সাত লাখ ৯১ হাজার ৫১৪টি খেজুর গাছ আছে। আবার বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়নের হিসাব বলছে, রস ভাণ্ডার যশোরে ৪ লাখ ৬২ হাজার ৫২৫টি খেজুর গাছ রয়েছে। দশ বছর আগে এ সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি ছিল বলে অভিজ্ঞরা মনে করেন।

যশোরের খেজুর গাছ বেশ কমে গেছে উল্লেখ করে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর যশোরের উপ-পরিচালক ইমদাদ হোসেন শেখ বলেন, “সরকারিভাবে খেজুর গাছ রোপনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

“বর্তমান প্রজন্ম খেজুরগাছের গুড় সংগ্রহের প্রতি বেশি উৎসাহী নয়। এজন্য কিছুটা গাছ কমেছে। তবে ঐতিহ্য ধরে রাখতে নতুন করে খেজুর বাগান তৈরির জন্য কৃষি বিভাগ যশোরে কাজ করে যাচ্ছে।”

শার্শা উপজেলা বনবিভাগের রেঞ্জার আব্দুল খালেক জানান, যশোর অঞ্চলের শত বছরের এ ঐতিহ্য ধীরে ধীরে যখন হারিয়ে যেতে বসেছে, ঠিক তখনই বনবিভাগের উদ্যোগে ২০০৯ সাল থেকে বেশকিছু খেজুর গাছ রোপন করা হয়।

“বৃহত্তর যশোরের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় প্রায় সাড়ে তিন লাখ খেজুর গাছের চারা লাগানো হয়েছে।”

পরিচর্যার জন্য খেজুর গাছ যারা কাটেন তাদের গাছি বলে। শার্শা উপজেলার সামটা গ্রামের গাছি সাধন পাড়ের বয়স ৮০ বছর হবে।

তিনি জানান, এই এলাকার রাস্তার পাশ দিয়ে ১০/১২ বছর আগেও অসংখ্য খেজুরের গাছ ছিল। গেরস্থদের খেজুর বাগান ছিল। এখন আর খেজুরের গাছ তেমন দেখা যায় না। অনেকে গাছ বিক্রি করে দিয়েছে। বুড়ো গাছ মরেও গেছে।

“সে সময় প্রতিদিন সকালে হাঁড়ি ভরে রস আনতাম। বাড়িতেই গুড় পাটালি তৈরি করতাম। তারপর বাজারে সেই গুড় পাটালি বিক্রি করতাম। এক সময় শীত আসলিই খেজুর গুড় থেকে আমাদের আয়ের পুরোটাই আসত। এখন সেইটা নেই। পাঁচ বছর হলো কাজ ছেড়ে দিছি।“

শার্শা উপজেলার রুদ্রপুর গ্রামের ইসমাইল হোসেন (৬৫) বলেন, “এখন আর আগের মতোন এ পেশায় কেউ আসতি চাই না। কষ্টোর কাজ। গাছও তেমন একটা নেই। গাছির অভাবে অনেক গাছই এখন আর কাটা হয় না।”

সরেজমিনে জানা যায়, শার্শার জিরেনগাছা ও মাটিপুকুর গ্রামের জয়নাল আবেদীন, আক্তারুজামান, ইয়াকুব আলী, কামাল হোসেন, আইয়ুব হোসেনসহ শতাধিক চাষি খেজুর গাছ লাগিয়েছেন।

জিরেনগাছা গ্রামের আক্তারুজামান বলেন, “আট বছর আগে পরীক্ষামূলকভাবে দেড় বিঘা জমিতে ৭৮টি খেজুর গাছ লাগিয়েলাম। এখন তার সুফল পাচ্ছি। রস, গুড় ও পাটালি বিক্রি করে সংসারে সুদিন ফিরেছে।”

ওই গ্রামের জয়নাল আবেদীন বলেন, শীতের মৌসুম কেবল শুরু হয়েছে। এখন খেজুরের রস বিক্রি হচ্ছে ৬ থেকে ৭ কেজি ওজনের প্রতি ভাড় ২০০ টাকা, আর গুড় ও পাটালি বিক্রি হচ্ছে ২০০ থেকে ২৫০ টাকা কেজি দরে।

মাটিপুকুর গ্রামের চাষি আয়ুব আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কৃষি জমির চার পাশে খেজুর গাছ লাগিয়েছি। এর থেকে রস ও গুড় ছাড়াও পাচ্ছি জ্বালানি।”

এতে একদিকে সংসারে বাড়তি আয় যেমন আসছে, তেমনি জমির ফসলেরও কোনো ক্ষতি হচ্ছে না বলে জানান তিনি।