কুড়িগ্রামের পাঁচটি গ্রাম যেন ‘অভ্যন্তরীণ ছিটমহল’

কুড়িগ্রাম সদরের ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামের অবস্থান পাশের নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নের ভেতর। ফলে সরকারি সুবিধা বঞ্চিত হওয়ার ছাড়াও নানা ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে এর গ্রামবাসীদের।

আহসান হাবীব নীলু কুড়িগ্রাম প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Nov 2020, 08:51 AM
Updated : 10 Nov 2020, 08:51 AM

জাতীয় পরিচয়পত্র অনুযায়ী এসব গ্রামের কয়েক হাজার মানুষের ঠিকানা ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রাম-কৈকুড়ি, বড়ভিটা, মরাদিগদারী, টেংনার ভিটা ও দিগদারী।

নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নের কেন্দ্রের কাছাকাছি বাস করলেও এসব গ্রামের মানুষদের ইউনিয়ন কিংবা উপজেলার কোনো কাজের জন্য যেতে হয় সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নে।

বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের দীর্ঘদিনের ছিটমহল সমস্যার সমাধান হলেও যুগ যুগ ধরে সমাধান হয়নি দেশের ভেতরের এসব ‘ছিটমহলের’। 

এ গ্রামগুলোকে নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করা হলে বাসিন্দাদের অনেক ভোগান্তির অবসান হয় বলে মনে করেন বর্তমান কুড়িগ্রাম-২ আসনের সংসদ সদস্য পনির উদ্দিন আহমেদ।

তিনি বলেন, এসব গ্রামের মানুষ খুবই দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছে। এই জটিলতা স্থানীয় জনগণ ও জনপ্রতিনিধিদের সদিচ্ছার মাধ্যমে সমাধান করা উচিত।

“আমি দুদফা সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ছিলাম। তখনই সমস্যাটি আমার নজরে আসে। কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও সমাধান করতে পারিনি। এর পেছনে প্রধান কারণ আমলাতান্ত্রিক জটিলতা।”

তবে বর্তমান কুড়িগ্রামের ডিসি বিষয়টি তার জানা ছিল না বলে জানান।

ডিসি মোহাম্মদ রেজাউল করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিষয়টি আপনাদের মাধ্যমে প্রথম জানতে পারি। দুই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের খোঁজখবর নিয়ে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।”

এলাকায় গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা হয় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিনিধির।

স্থানীয়দের মতে, ব্রিটিশ আমলে উলিপুরের জমিদার শিরিষ চন্দ্র এবং নাগেশ্বরীর জমিদার সতীশ চন্দ্রের অধীন ছিল ভিতরবন্দ এলাকা। এ এলাকার সীমানায় বসবাসকারীদের একটি অংশের লোক শিরিষ চন্দ্রকে এবং আরেকটি অংশের লোক শতীশ চন্দ্রকে খাজনা দিত।

ব্রিটিশরা চলে গেলেও জোতদারদের রেখে যাওয়া সীমানা জটিলতা নিরসন করা হয়নি।

ভিতরবন্দ ইউনিয়ন পরবর্তীতে নাগেশ্বরী উপজেলার সীমানার ভিতরে পড়ে যায়। কিন্তু ভিতরবন্দ ইউনিয়নের অভ্যন্তরে বসবাসরত এ পাঁচ গ্রামের মানুষ উলিপুরের জমিদারের অধীনে থাকায় তারা পরবর্তীতে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের অন্তরভুক্ত হয়।  

এ কারণে ভিতরবন্দ ইউনিয়নের অভ্যন্তরে বসবাস করলেও তারা ভোটার হন ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের।

কৈকুড়ি গ্রামের প্রয়াত কচের খানের ছেলে বৃদ্ধ আহম্মেদ হোসেন (৮৫) বলেন, তারা সদর উপজেলার ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নের পাঁচ গ্রামের মানুষ বসবাস করছেন পার্শ্ববর্তী নাগেশ্বরী উপজেলার ভিতরবন্দ ইউনিয়নের ভিতরে।

“আমরা কৈকুড়ি, বড়ভিটা, মরাদিগদারী, টেংনার ভিটা ও দিগদারী গ্রামে প্রায় সোয়া তিন হাজার মানুষ বসবাস করছি। ভোটার সংখ্যা এক হাজার আটশ।”

তিনি বলেন, “বন্যা হলে তাদের ভিতরবন্দে আশ্রয় নিতে হয়। সাহায্য সহযোগিতা এই ইউনিয়নের মানুষই করেন। কিন্তু আমরা বাসিন্দা আরেক ইউনিয়নের। এসব এলাকার মানুষের লেখাপাড়া, বিয়ে-শাদী, ব্যবসা-বাণিজ্য, বিচার-সালিশ, বন্যায় আশ্রয় গ্রহণ সবকিছুই করতে হয় ভিতরবন্দে।”

কিন্তু জাতীয় পরিচয়পত্রে তাদের ঠিকানা ভোগডাঙ্গা ইউনিয়ন হওয়ায় সামাজিক নিরাপত্তাসহ রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন তারা।  

এই এলাকার কাশেম, ছামসুল ও ছামিনা বেগম জানান, চারদিকে ভিতরবন্দ আর তারা তার ভিতরে বসবাস করছেন। এখান থেকে ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নে যেতে হলে ভিতরবন্দ পার হয়ে যেতে হয়।

কাশেম বলেন, “আমাদের অবস্থা ছিটমহলের মানুষের মতো। আমরা যেহেতু ভিতরবন্দের ভিতরে আছি, এখন আমরা এখানেই থাকতে চাই। এজন্য আপনারা আমাদেরকে সহযোগিতা করেন।”

এ ব্যাপারে ভোগডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান সাইদুর ইসলাম বলেন, “আপনাদের কে কী বলেছে জানি না। তবে ওই এলাকার অনেক জ্ঞানী গুণী মানুষ আছেন, যারা আমার ইউনিয়নে থাকতে চান। এখনও অনেকে মোবাইল করে আমাকে জানায় ভিতরবন্দ ইউনিয়নে তারা থাকবে না। তারা ভোগডাঙ্গা ইউনিয়নে দেশ স্বাধীনের আগে থেকে আছেন এখনও এই ইউনিয়নে থাকতে চান।”

অপরদিকে ভিতরবন্দ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আমিনুল হক খন্দকার বাচ্চু বলেন, বংশ পরম্পরায় এই পাঁচ গ্রামের মানুষ সীমাহীন দুঃখ ও কষ্টে জীবনযাপন করে আসছে। এসব গ্রাম ভিতরবন্দ ইউপি ভবনের নিকটবর্তী।

“ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগসহ বিভিন্ন সমস্যায় পড়লে মানবিক কারণে আমরা তাদের পাশে দাঁড়াই। কিন্তু ভিন্ন ইউনিয়ন ও ভিন্ন উপজেলা হওয়ায় তাদের জন্য অতিরিক্ত কোনো বরাদ্দ পাওয়া সম্ভব হয় না। তাদের জীবনমান উন্নয়ন বাঁধাগ্রস্ত হচ্ছে।”

কুড়িগ্রামের পাবলিক প্রসিকিউটর এসএম আব্রাহাম লিংকন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ভৌগলিক অবকাঠামো জনগণের কল্যাণ্যের জন্য। এটা স্বাধীন দেশের মধ্যে ছিটমহলের মতো অবস্থা। স্থানীয় কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বিষয়টি দ্রুত নিষ্পত্তি করা উচিত।