শেকলে বাঁধা জালালের এক যুগ, নেই চিকিৎসা

দুই পায়ে ঝালাই করে এঁটে দেওয়া লোহার চাকতি আর হাতে তালা দেওয়া শেকল নিয়ে এক যুগ কাটিয়ে দিয়েছেন ফেনীর মো. শাহ জালাল।

নাজমুল হক শামীম ফেনী প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 Sept 2020, 09:39 AM
Updated : 7 Sept 2020, 09:53 AM

পরিবার বলছে, ‘মানসিক ভারসাম্যহী ‘ জালালকে নিয়ন্ত্রণ করতে না পারায় শেকল ছাড়া ‘উপায় ছিল না’ তাদের। অর্থভাবে তার চিকিৎসাও তারা করাতে পারেননি।

জালাল ফেনীর দাগনভূঁইয়া উপজেলার মাতুভূঁইয়া ইউনিয়নের মোমারিজপুর গ্রামের উজির আলী ব্যপারিবাড়ির আবদুল হকের ছেলে। বয়স চল্লিশের বেশি। ছোট একটা ছাপড়া ঘরে কাঠের চৌকিতে কাটে তার দিন-রাত।

তার মা আনোয়ারা বেগম বলেন, তার পাঁচ ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে জালাল সবার ছোট। ১৮ বছর আগে চট্টগ্রামে আবুল খায়ের কোম্পানির তেল কারখানায় কাজ করতেন তিনি।

“সে সময় জ্বরে হয়ে কিছুটা মানসিক ভারসাম্য হারায়। স্থানীয় কবিরাজ দিয়ে চিকিৎসা করলেও সুস্থ হয়নি। ধীরে ধীরে অবস্থার অবনতি হয়। অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। হামলা করতে থাকে স্বজনদের।

“বিশেষ করে মা, বোন, ভাবিদের দেখলে তেড়ে যেত শাহজালাল। বাড়ি থেকে বেরিয়ে অন্য বাড়ির নারীদের ওপরও হামলা করত। বাধ্য হয়ে স্বজনা তার হাতে-পায়ে শেকল পরিয়ে ঘরে আটকে রেখেছে।”

সরেজমিন দেখা যায়, ভাঙাচোরা বাঁশের বেড়া ও টিন দিয়ে তৈরি ছাপড়া ঘরটি স্যাঁতসেঁতে। ঘরে আছে একটি চৌকি আর একটি চেয়ার। খাটের ওপর ছেঁড়া-ভেজা কাঁথায় জড়সড় হয়ে বসে আছেন জালাল।

পরনে ময়লা-ছেঁড়া শার্ট আর লুঙ্গি। ঘরে দুর্গন্ধ। প্রস্রাব পেলে খাটের পাশেই করেন। খাটের পাশে চেয়ারে রাখা কয়েকটি ছেঁড়া কাঁথা। কেউ খাইয়ে দিলে তার খিদে মেটে। না হলে থাকতে হয় ক্ষুধার্ত।

পায়খানা পেলে খাট থেকে নেমে ঘরের পাশে খোলা জায়গায় সেরে নেন। খাট আর টয়লেটের মধ্যে সীমাবদ্ধ তার চলাচল।

জালালের স্কুলপড়ুয়া ভাতিজা জানান, তা চাচা কারও সঙ্গে কথা বলেন না। মানুষ দেখলেই এটা-সেটা ছুড়ে মারেন।

জালালের চাচাত ভাই শাহাদাত হোসেন টিপু বলেন, চট্টগ্রামে তিনি ও জালাল এক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন।

“এখন আমি তার দেখভাল করছি। আমি না খাইয়ে দিলে অন্য কারও হাতে ভাত খায় না জালাল। সময় করে দুই-তিন দিন পর গোসল করিয়ে দিই।”

জালালের প্রতিবেশী স্থানীয় সিদ্দিক নগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক আমিন উল্লাহ।

আমিন জানান, জালালের পরিবার হতদরিদ্র। বাড়িতে তাদের টিনের ঘর থাকলেও মেঝে মাটির। অনেকটা দিনে এনে দিনে খাওয়া পরিবার। শাহজালালের অন্য ভাইয়েরা কেউ তার খবর নেন না। অর্থভাবে তার চিকিৎসা কারানো হয়নি।

চিকিৎসা করালে জালাল সুস্থ হয়ে উঠতে পারে বলে তার ধারণা।

মাতুভূঁইয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মোমারিজপুর গ্রামের বাসিন্দা ফারুকুল ইসলাম বলেন, জালালের পরিবারের অক্ষমতার বিষয়টি জানার পর তিনি কয়েক বছর আগে তার জন্য প্রতিবন্ধী ভাতার কার্ড তৈরি করে দেন।

ওই কার্ডে প্রতি মাসে ৭০০ টাকা ভাতা পান জালাল। সেই টাকা দিয়ে তার খাবার জোগাড় করে পরিবার। তাছাড়া করোনাভাইরাস মহামারীতে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জালালকে কিছু সহায়তা করা হয়েছে।

উপজেলা প্রশাসন এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে বলে জানিয়েছে।

দাগনভূঁইয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রবিউল হাসান বলেন, সম্প্রতি স্থানীয়দের কাছে তিনি খবর পেয়েছেন। দুই-এক দিনের মধ্যে তিনি জালালের বাড়ি যাবেন। চিকিৎসা নিশ্চিত করার চেষ্টা করবেন। প্রয়োজনে আর্থিক সহায়তা করা হবে।