গত বুধবার মধ্যরাতে নূরুদ্দিন মাদবরেরকান্দি গ্রামের এই বিদ্যালয় ভবন মাঝ বরাবর দ্বিখণ্ডিত হয়ে হেলে পড়ে। বৃহস্পতিবার বিকালে পুরোপুরি পদ্মার গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
একই দিন চাঁদপুরের ‘রাজরাজেশ্বর ওমর আলী উচ্চবিদ্যালয়ের’ তিনতলা ভবনটিও মেঘনার করাল গ্রাসে বিলীন হয়ে যায়।
সরকারের নানা পদক্ষেপে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছিল শিবচরের এই চর ইউনিয়নের মানুষের জীবনে। এই চরে বিদ্যুৎ, চিকিৎসা, পাকা সড়কসহ সব ধরনের অবকাঠামো গড়ে উঠেছিল। ছড়াচ্ছিল শিক্ষার আলোও। কিন্তু গত কয়েক বছরে পদ্মা নদীর ভাঙন সব কেড়ে নিচ্ছে বন্দরখোলাবাসীর। এবার পদ্মার গ্রাসে হারিয়ে গেল ‘চরের বাতিঘর’ খ্যাত বন্দরখোলা ইউনিয়নের নুরুউদ্দিন মাদবরেরকান্দি এস ই এস ডি পি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়।
‘নুরুউদ্দিন মাদবরের কান্দি এস ই এস ডি পি মডেল উচ্চ বিদ্যালয়’ নামের প্রিয় এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি চরের ‘বাতিঘর’ হিসেবে সবার কাছে পরিচিত ছিল। ভবনটি ভেঙে নদীতে পড়ার সময় এলাকার শত শত মানুষ প্রত্যক্ষ করেন। এ সময় অনেকেই কান্নায় ভেঙে পড়েন।
এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আফজাল হোসেন জানান, ২০০৯ সালে স্থাপিত প্রতিষ্ঠানটিতে শিবচরের বন্দরখোলার মমিন উদ্দিন হাওলাদার কান্দি, জব্বার আলী মুন্সী কান্দি, বজলু মোড়লের কান্দি, মিয়া আজম বেপারীর কান্দি, রহমত হাজীর কান্দি, জয়েন উদ্দিন শেখ কান্দি, মসত খাঁর কান্দিসহ প্রায় ১০টি গ্রাম এবং ফরিদপুরের সদরপুর উপজেলার চর নাসিরপুরসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের ছেলে-মেয়েরা পড়ালেখা করছিল।
“বিদ্যালয়টি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ায় আমাদের চারশ শিক্ষার্থীর শিক্ষা জীবন এখন অনিশ্চিত হয়ে গেল। করোনাভাইরাস মহামারী শেষ হওয়ার পরও আমরা আর পড়াশোনা চালু করতে পারব কিনা জানি না।”
মাদারীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী পার্থপ্রতিম সাহা বলেন, পদ্মার নিকটবর্তী হওয়ায় প্রতি বছরই বন্যার পানিতে ডুবে যেত বিদ্যালয়সহ আশপাশের এলাকা। গত বছর পদ্মা ভাঙতে ভাঙতে পেছন দিক দিয়ে বিদ্যালয়টির কাছে চলে আসে।
“এরপর গত বছরই ওই এলাকায় আমরা পানি উন্নয়ন বোর্ড জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙন ঠেকাই। চলতি বর্ষা মৌসুমেও ভাঙন ঠেকাতে জিও ব্যাগ ডাম্পিং চলতে থাকে ওই এলাকায়। তবে পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রচণ্ড স্রোতের কারণে জিও ব্যাগ ফেলে তেমন সুবিধা হচ্ছে না। ভবনটি রক্ষা করতে আমরা চেষ্টা করেছিলাম।”
এই বিদ্যালয়ের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফয়সাল বলে, বিদ্যালয়টি নদীতে তলিয়ে গেলে এলাকায় হয়ত আরও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হবে। কিন্তু এটির মতো আধুনিক সুযোগ-সুবিধা পাওয়া যাবে কিনা বলা যায় না।
এই বিদ্যালয়টির পাশাপাশি কাজির সুরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়টিও নদীগর্ভে বিলীন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়েছে জানিয়ে ফয়সাল বলে, “এই দুটি স্কুল ভবনই পাকা। এ দুটিই আমাদের এলাকার ছেলে-মেয়েদের প্রিয় স্কুল। কিন্তু পদ্মা আমাদের আলোর স্কুল কেড়ে নিল। এখন আমাদের পড়াশোনা কোথায় হবে জানি না।”
বন্দরখোলা ইউনিয়ন পরিষদের ৩ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. ইসমাইল বলেন, বুধবার রাত সাড়ে ১১টার দিকে হঠাৎ করে বিকট শব্দ হতে থাকে স্কুল ভবনে। খবর পেয়ে অসংখ্য মানুষ ট্রলারে করে বিদ্যালয়টি দেখতে আসে।
“আমাদের সামনেই বিদ্যালয়টির মাঝখানে ফাটল ধরে এবং এটি পেছন দিকে হেলে পড়ে। বিদ্যালয়টিতে ভাঙন ধরলে এলাকাবাসী কান্নায় ভেঙে পড়ে। চোখের সামনে এভাবে বিদ্যালয়টি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে দেখে স্থানীয়রা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়ে। কিন্তু আমাদের করোরই কিছু করার নেই। পদ্মা চরের বাতিঘরটিকে নিভিয়ে দিল তার গর্ভে।”
শিবচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর এবং করোনাভাইরাস মুক্ত হলে চরে অস্থায়ীভাবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া চালিয়ে নেওয়া হবে।