কোরবানির পশুর লগ্নি নিয়ে শঙ্কায় কুষ্টিয়ার খামারিরা

করোনাভাইরাস মহামারীর মধ্যে কোরবানির পশুতে অর্থ লগ্নিকারী কুষ্টিয়ার খামারি ও কৃষকরা উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় আছেন।

হাসান আলী কুষ্টিয়া প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 July 2020, 02:45 PM
Updated : 10 July 2020, 02:46 PM

এই ঈদে পশুর বাজার ঘিরে কুষ্টিয়ায় খামারিসহ বিভিন্ন পর্যায়ের চাষি প্রতিবছর বিপুল অর্থ লগ্নি করেন। কেউ কেউ ধার-দেনাও করেন কোরবানির বাজারে লাভের আশায়। কিন্তু করোনভাইরাস মহামারীর মধ্যে এবারের বাজার অন্যান্য বছরের তুলনায় ভিন্ন। তাই ঈদের দিন যত এগিয়ে আসছে কৃষকদের মনে উদ্বেগ তত বেড়ে যাচ্ছে।

জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের তথ্যমতে, এ বছর কোরবানির বাজারে বিক্রয়ের জন্য এক লাখ পাঁচ হাজার গরু-মহিষ এবং ৭০ হাজার ছাগল-ভেড়া প্রস্তুত রযেছে; যার বাজার মূল্য প্রায় এক হাজার ছয়শ কোটি টাকা। খামারি বা চাষিদের  মতো এখানে অর্থলগ্নিকারী ব্যাংক কর্তৃপক্ষও উদ্বেগের কথা জানিয়েছে। 

এই কৃষক জানেন না তার এই গরু বিক্রি হবে কি না

খামারিরা যেমন ব্যাংক বা এনজিও থেকে সুদে ঋণ নেন, তেমটি প্রান্তিক চাষিরা নিজ বাড়িতে দুয়েকটা করে গরু পালন করেন নানা সাংসারিক ঝামেলার মধ্যে।

খামারি ও চাষিদের ভাষ্য, একটি গরুর খাওয়া বাবদ প্রতিদিন দুইশ থেকে তিনশ টাকা খচর করতে হয়। নিজে খেতে না পারলেও ধারকর্জ করে হলেও এই খরচ করতে হয়। লক্ষ্য থাকে বছর শেষে কোরবানির বাজারে বিক্রয় করে লাভের মুখ দেখা। সচরাচর ঈদের ১৫-২০ দিন আগে জেলার বাইরে থেকে আগত ক্রেতা বা ব্যাপারিরা বেশিরভাগ গরু কিনে নিয়ে যান। কিন্তু এবছর হিসাবের অর্ধেক দামেও বিক্রয়ের কোনো লক্ষণ দেখছেন না তারা।

কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার সদরপুর গ্রামের কৃষক শহিদুলের স্ত্রী হাফিজা খাতুন বলেন, “প্রতি বছরের মতো এবারও তিনটি দেশি জাতের ষাঁড় বড় করেছি। ঈদের আর মাত্র কিছুদিন বাকি আছে; অন্যান্য বছর এই সময়ের মধ্যে ঢাকা/চিটাগাং থেকে ব্যাপারীরা বাড়ি এসে গরু কিনে নিয়ে যেত। এবার তার কোনো খোঁজই নাই। খাবারের দোকানে অনেক টাকা বাকি, গরু বেচে শোধ করার কথা। কিন্তু এখনও কেউ গরু দেখতেও আসিনি। খুবই দুশ্চিন্তায় আছি।”

এক নারী তার গরুকে খাবার দিচ্ছেন

ভেড়ামারা উপজেলার সলক মন্ডল বলেন, “গত বছর কোরবানির ঈদের পর ছয়ডা গরু কিনিচি সাড়ে চার লাখ টাকায়। প্রতিটা গরুর জন্যি দিনে খাওয়া খরচ হয় আড়াইশ থেকে তিনশ টাকা। বছরে একটা গরু বড় করতি খরচই হয়ে যায় ৮০-৯০ হাজার টাকা। সমিতির ঋণের টাকা সুদসহ দিতি হবি। এখন এই গরুর দাম এক লাখ বা ৯০ হাজার কয়; তালি তো ঘড়বাড়ি বেচি সব টাকা শোধ করা লাগবিনি।” 

মিরপুর উপজেলা পশুসম্পদ কর্মকর্তা সোহাগ রানা বলেন, করোনামহামারীতে এ বছর ‘বিক্রয়ের সুযোগ সীমিত’ হওয়ার কারণে প্রান্তিক চাষিরা তাদের সব পশু বিক্রয় করতে পারবে কিনা সেই সংশয় প্রাণিসম্পদ বিভাগেরও। অনেক খামারি ব্যাংক বা এনজিও থেকে ঋণও নিয়েছেন। এছাড়া প্রান্তিক চাষিরা নিজ বাড়িতে ১/২/৩টা করে গরু পালন করেছেন নিজের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করে।

উপজেলায় এ বছর সাড়ে ২১ হাজার গরু-মহিষ এবং প্রায় সাড়ে চার হাজার ছাগল-ভেড়া বিক্রয়যোগ্য আছে বলে তিনি জানান। 

কুষ্টিয়ার মিরপুরের সদরপুর গ্রামের কৃষক শহিদুলের স্ত্রী হাফিজা খাতুন

কুষ্টিয়া জেলা পশুসম্পদ কর্মকর্তা সিদ্দিকুর রহমান বলেন, “এ বছর কুষ্টিয়া জেলার ছয়টি উপজেলায় এক লাখ পাঁচ হাজার গরু-মহিষ এবং ৭০ হাজার ছাগল-ভেড়া কোরবানির বাজারে বিক্রয়ের জন্য মোটা-তাজা করে প্রস্তত করেছেন খামারি ও প্রান্তিক চাষিরা, যার বাজার মূল্য প্রায় ১৬শ কোটি টাকা।”

তিনি বলেন, স্বাভাবিক সময়ের হিসাব মতে এখানে পালন করা মোট পশুর ৩০ শতাংশ দরকার হয় এই জেলায়। বাকি ৭০ শতাংশ পশুই জেলার বাইরে বিশেষ করে ঢাকা ও চট্টগ্রামে যায়। কিন্তু করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধির বাধ্যবাধকতার কারণে এসব পশু বিক্রয় নিয়ে চাষিরা শঙ্কায় আছেন।

“তবে সরকারি উদ্যেগে অনলাইন পশু বিক্রয়ে সহযোগিতার ব্যবস্থা থাকলেও প্রযুক্তিগত অজ্ঞতার কারণে খুব কম সংখ্যক খামারি বা চাষি এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারছেন। ফলে তারা অনিশ্চয়তা ও শঙ্কার মধ্যেই থেকে যাচ্ছেন।”

কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা উপজেলার কৃষক সলক মন্ডল

বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের কুষ্টিয়ার মুখ্য আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক মুনসুরুর রহমান বলেন, “পশু মোটা-তাজাকরণে কুষ্টিয়ার খ্যাতি থাকায় লাভজনক এখাতে বিভিন্ন ব্যাংক স্বল্প মেয়াদি ঋণ দিয়ে থাকে। আমরাও দিয়েছি। এখাতে প্রায় ৬০ কোটি টাকা খামারীদের ঋণ দেওয়া আছে। এছাড়া অন্যান্য ব্যাংক, এনজিও এবং অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানও ঋণ দিয়েছে।”

তিনি জানান, প্রতি বছর ঈদের পরদিন এসব অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠান প্রান্তিক পর্যায়ে কালেকশন বুথ স্থাপন করে ঋণের টাকা সংগ্রহ করে। ঋণ গ্রহীতা খামারি ও চাষিরা ঋণের টাকা পরিশোধ করে থাকেন।

“কিন্তু এবছর অনেক ঋণ গ্রহীতা জানিয়েছেন তাদের ঋণ পরিশোধের অনিশ্চয়তার কথা। তবে তারা ইচ্ছা করলে সরকার ঘোষিত স্বল্প সুদে ৪ শতাংশ হারে সহায়তা নিয়ে তাদের ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করতে পারবেন।”

প্রতিবছর ঈদুল আজহাকে ঘিরে এই খামারি-চাষিরা সারা বছরের একটি আর্থিক লাভের স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু এবারের করোনাভাইরাস মহামারীতে তারা সেই স্বপ্ন মলিন হওয়ার শঙ্কায় রয়েছেন। এমন সংকটময় পরিস্থিতিতে হয়তো সরকারের স্বল্প সুদের ঋণ তাদের আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সহায়তা করবে।