কলকাতার জেলে নিহত বাংলাদেশির লাশ চায় পরিবার

নভেল করোনাভাইরাস আতঙ্কে পশ্চিম বাংলার দমদম কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দিদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে নিহত বাংলাদেশির লাশ ফেরত চেয়ে আহাজারি করছে তার পরিবার।

শরীফুল্লাহ কায়সার সুমন সাতক্ষীরা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 March 2020, 05:16 PM
Updated : 28 March 2020, 06:02 PM

সেখানে নিহত মামুন হোসেন (২৯) ওরফে মামুন গাজী সাতক্ষীরার দেবহাটা উপজেলার সন্ন্যাসখোলা গ্রামের কাশেম গাজীর ছেলে। ১৯৯১ সালে মামুনের জন্মের মাস চারেকের মাথায় ট্রাক চাপায় দিনমজুর কাশেম গাজী নিহত হন।

ট্রাক চাপায় স্বামীকে হারানোর পর ছেলের মৃত্যুর খবর পাওয়া মাফুজা খাতুন লাশ ফেরত চেয়ে আহাজারি করেই চলেছেন।

করোনাভাইরাস আতঙ্কে কলকাতায় আদালত কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। এতে আটকে যায় জামিনের শুনানি। সংক্রমণ থেকে বাঁচতে পরিবারের সঙ্গে দেখা করাও বন্ধ করে দেয় এসব বন্দিশালার কর্তৃপক্ষ। এ নিয়ে অসন্তোষের জেরে গত ২১ মার্চ বিচারাধীন বন্দিদের সঙ্গে সাজাপ্রাপ্ত বন্দিরা যোগ দিয়ে দমদমের কারাগারে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে বলে সেদেশের গণমাধ্যমের খবর। এতে নিহত হন বাংলাদেশের ছেলে মামুন।

শনিবার সরেজমিনে সাতক্ষীরা-মুন্সীগঞ্জ সড়কের ধারে সন্ন্যাসখোলা গ্রামে মামুনের ভূমিহীন মায়ের খুপড়ি ঘরে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। খোঁজ নিয়ে সেখান থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার দূরে সদরের ইটাগাছা গ্রামে তার ভাই মকবুল হোসেনের বস্তি ঘরে পাওয়া যায় তাকে।

নিহত মামুনের মা জানান, বিভিন্ন সূত্র তাদের জানতে পেরেছেন সেখানে ভাইরাস আতঙ্কে বন্দি মুক্তির তালিকা নিয়ে কারা পুলিশের সাথে বাদানুবাদের এক পর্যায়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হন তার ছেলে।

কলকাতার একটি দৈনিক পত্রিকার সাংবাদিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সাতক্ষীরার মামুন গাজী নিহত হওয়ার খবরটি জানান।

জীবনের ঘটনাপ্রবাহের বিবরণ দিতে গিয়ে নিহতের মা মাফুজা খাতুন জানান, তার স্বামীর মৃত্যুর পর লোকের বাড়িতে রাস্তাঘাটে দিনমজুরির কাজ করে সংসার চালিয়েছেন তিনি। ছেলেকে বেশি একটা পড়াতেও পারেননি। ছেলেকে নিয়ে বিভিন্ন ইটভাটায় কাজ করেছেন। যে মজুরি পেতেন তাতে মা-ছেলের ভাত-কাপড় ও চিকিৎসার খরচ উঠত না।

এক পর্যায়ে সাত বছর আগে ভারতে ইটের ভাটায় কাজের সন্ধানে যান মামুন। সেখানে একটি মোবাইল চুরির ঘটনায় মামুনকে সন্দেহভাজন হিসেবে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। তিন বছর ধরে চলছে কিন্তু চুরির এ মামলার নিষ্পত্তি হয়নি। মামলা চালিয়ে নেওয়ার মত কেউ না থাকায় কারগারেই থাকতে হয় মামুনকে। ছেলের জামিনের জন্য অনেক বার ভিসা করে ভারতে গেছেন বলে জানান তিনি।

মাফুজা বলেন, “ছেলে মামুন বারবার বলেছে ‘মাগো আমাকে মুক্ত করে নিয়ে যাও। সামান্য মোবাইল চুরির সন্দেহভাজন আসামির এতদিন জেল হতে পারে না। ভালো উকিল ধরো।’

“মাসজুড়ে দিনমজুরির হাড়ভাঙা পরিশ্রমে যে আয় করেছি সব টাকা বসিরহাটের হান্নান ও পাপ্পু উকিলের হাতে দিয়েছি। শুধু বলত সামনের মাসে জামিন হবে কিন্তু জামিন করা তো না।”

এদিকে, সন্ন্যাসখোলা গ্রামের রায়হান মাহমুদ জানান, এলাকার সাধারণ মানুষ এ হত্যার বিচার ও মামুনের লাশ দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি জানিয়েছে।

এ গ্রামের সফুরা বেগম বলেন, “অভাবে পড়ে ওপারে ইটের ভাটায় কাজ করতে গিয়েছিল। একটা ছেলেকে দিনের পর দিন বিনা বিচারে জেলের ভাত খেতে হলো-এটা খুব কষ্টের।

“অনাহারী অভাবী মা আশায় বুক বেঁধেছিল ছেলেকে মুক্ত করে আনবে কিন্তু ছেলের মুখটা দেখতে পারল না। এখন দুই দেশের সরকার দ্রুত এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করুক। লাশটা মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিক।”

ভাঙা প্লাস্টিক কুড়ানোর কাজ করেন মামুনের মামা মকবুল হোসেন। তিনি বলেন, মামুনের বাবা মারা যাওয়ার পর পরিবারটি খুব অসহায় হয়ে পড়ে। এ দুনিয়ায় তাদের দেখার মতো কেউ নেই।

লাশ ফেরত আনার ব্যাপারে জানতে চাইলে সাতক্ষীরা-৩৩ বিজিবি ব্যাটেলিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল গোলাম মহিউদ্দীন খন্দকার বলেন, সীমান্তে মৃত্যুর ঘটনায় বিজিবি ও বিএসএফ পর্যায়ে সমঝোতার মাধ্যমে লাশ পাওয়া যায় কিন্তু মামুনের ঘটনাটি সরকারের উচ্চ-পর্যায়ের বিষয়।

মানবাধিকারকর্মী মাধব দত্ত বলেন, কারা অভ্যন্তরে এমন মৃত্যু অত্যন্ত দুঃখজনক। যেখানে মানুষের জীবনের নিশ্চিত নিরাপদ হবে। সেখানে এমন গুলি করে হত্যার ঘটনা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন।