বন্যা: পদ্মার পানি বেড়ে দুর্ভোগ পাবনায়, ক্ষতিগ্রস্ত ফসলি জমি

আকস্মিকভাবে পানি বেড়ে সৃষ্ট বন্যায় পাবনার পদ্মা তীরের ৩০টি গ্রামের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।

পাবনা প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 2 Oct 2019, 10:53 AM
Updated : 2 Oct 2019, 11:25 AM

পাবনার সদর, ঈশ্বরদী ও সুজানগর উপজেলার ৩০টি গ্রামের মানুষ পনিবন্দি হয়ে পড়েছেন বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ।

টানা বৃষ্টি এবং উজানে পানি বাড়ায় দেশের পশ্চিমাঞ্চলে, বিশেষ করে পদ্মা অববাহিকার রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুষ্টিয়া ও নাটোর অঞ্চলে স্বল্পকালীন বন্যা হতে পারে বলে আগেই আভাস দিয়েছিলেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলীরা।

এর মধ্যে ভারতের উত্তর প্রদেশ ও বিহার রাজ্যে প্রবল বর্ষণের কারণে বন্যা দেখা দেওয়ায় গঙ্গায় ফারাক্কা বাঁধের ১১৯টি গেইটের সবগুলোই সোমবার খুলে দেয় ভারত। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ড বলেছে, দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে নদীর পানি বেড়ে যে বন্যা পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে, তার মূল কারণ অতিবর্ষণ; ফারাক্কা বাঁধ নয়।

বুধবার সকাল ১০টা থেকে পাবনার হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পদ্মার পানি বেড়ে বিপদ সীমার সাত সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে বলে পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী জহুরুল ইসলাম জানিয়েছেন।

সোমবার সকাল ১০টা নাগাদ হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পদ্মার বিপদসীমা পানি অতিক্রম করে। মঙ্গলবার দুপুর ৩টায় হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে পদ্মা নদীর পানি রেকর্ড করা হয় ১৪ দশমিক ২৮ সেন্টিমিটার, যা বিপদসীমার চেয়ে ৩ সেন্টিমিটার বেশি।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ক্রমাগত পানি বৃদ্ধির কারণে সদর, ঈশ্বরদী ও সুজানগর উপজেলার পদ্মাপাড়ের অনেক গ্রামের বসত বাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে। পানিবন্দি হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন ওইসব কয়েক শতাধিক পরিবার। খাবার, পানীয় জল ও গোখাদ্য সংকটে গবাদি পশু ও পরিবার পরিজন নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তারা।

পাবনার সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা জয়নাল আবেদীন বলেন, “আকস্মিক বন্যায় এ উপজেলার দোগাছি, ভাঁড়ারা, চরতারাপুর ও হেমায়েতপুর ইউনিয়নের ৬৯২ হেক্টর ফসলি জমি পানিতে তলিয়ে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন প্রায় এক হাজার পরিবারের মানুষ।“

মঙ্গলবার ও পানি বৃদ্ধি অব্যহত থাকায় আরও বেশ কিছু নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। উপজেলা প্রশাসন বন্যা কবলিত এলাকায় ত্রাণ কার্যক্রম চালাচ্ছে বলে জানান তিনি।

দোগাছি ইউনিয়নের চরকোমরপুর এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, বন্যায় কৃষকদের ধান, মাসকলাই ও সবজি ক্ষেত তলিয়ে গেছে। কৃষকরা কাঁচা ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছেন। হু হু করে পানি ঢুকেছে বসতবাড়িতে। রান্নার ব্যবস্থা না থাকায় দূর দূরান্তের স্বজনদের বাড়ি থেকে খাবার নিয়ে আসছেন।

কৃষকরা জানান, বন্যায় সমস্ত ফসল নষ্ট হয়েছে, এখন গোখাদ্য হিসেবে ব্যবহারের জন্য কাঁচা ধানই কেটে আনছেন তারা।

এই ইউনিয়নের চর কোষাখালি গ্রামের কৃষক সোলায়মান জানালেন, বন্যার পানিতে তার আট নয় বিঘা মাসকালাই এবং তিন থেকে চার বিঘা কাঁচা মরিচের ক্ষেত তলিয়ে গেছে ।

এদিকে ঈশ্বরদী উপজেলার সাঁড়া, পাকশি ও লক্ষীকুণ্ডা ইউনিয়নের চরের গাজর, শিম, করলা, মূলাসহ আগাম শীতের সবজির ব্যপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।

পদ্মার এসব চরের ঊর্বর জমিতে সবজি ভালো উৎপাদন ও সচরাচর বন্যায় প্লাবিত না হওয়ায়, বর্গাচাষিরা এসব জমিতে চুক্তিভিত্তিক চাষাবাদ করেন।

লক্ষীকুণ্ডা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আনিসুর রহমান শরীফ বলেন, তার ইউনিয়নের  প্রায় ১৫ হাজার একর জমির সবজি ও আখক্ষেত পদ্মার পানিতে তলিয়ে গেছে। যার অধিকাংশই আগাম শীতের সবজি।

“বাজার মূল্য বেশি হওয়ায় এসব ফসলে কৃষকের বিনিয়োগও বেশি থাকে। টাকার অংকে কমপক্ষে কয়েকশ কোটি টাকার ফসল নষ্ট হয়েছে।”

লক্ষীকুণ্ডা ইউনিয়নের মেম্বর দাদাপুর চরের জিয়াউল হক জিয়া জানালেন, তার ভাইয়ের ৫০ বিঘা গাজরের ক্ষেত তলিয়ে গেছে। প্রতি বিঘাতে গাজরের বীজ বুনতেই তার খরচ হয়েছে ১৫ হাজার টাকা।

এই ইউনিয়নের চর কুরুরিয়া গ্রামে জহুরুল ইসলাম বলেন, “তার ১০ বিঘা কফি, চার বিঘা বরবটি, আর দুই বিঘা মুলার ক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে।”

যখন জহুরুলের সঙ্গে কথা হচ্ছিল, তখন তার স্ত্রীকে পাশে বসে কাঁদছিলেন।

আকস্মিক বন্যায় সমস্ত ফসল নষ্ট হওয়ায় দিশেহারা চরকুড়লিয়া, চরদাদাপুর, শান্তিনগর, মালপাড়া, উদিপাড়াসহ ২০ গ্রামের চাষিরা।

এদিকে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৮ সালের পর পদ্মায় এমন পানি বৃদ্ধি হয়নি। আগাম প্রস্তুতি না থাকায় ক্ষয়ক্ষতিও হয়েছে বেশি। ‘আরও কয়েকদিন পদ্মার পানি প্রতিদিন ১০ সেন্টিমিটার করে বাড়তে পারে’ বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন।

তবে পরিস্থিতি মোকাবেলায় ‘পর্যাপ্ত’ প্রস্তুতি রয়েছে জানিয়ে জেলা প্রশাসক কবীর মাহমুদ বলেন, “তিন উপজেলার বন্যা দুর্গত মানুষদের সহায়তায় তারা সর্বাত্মকভাবে কাজ করছেন।

“পরিস্থিতি মোকাবেলায় উপজেলা ভিত্তিক টিম করে প্রয়োজনীয় ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।”

কৃষকের ক্ষতির বিষয়টি তদারকি করছে জেলার কৃষিবিভাগ। তাদের সহযোগিতার বিষয়ে মন্ত্রণালয়ে জানানো হয়েছে।

“ইতিমধ্যে একটি কন্ট্রোল রুমও খোলা হয়েছে।”

বন্যার ক্ষয়ক্ষতির হিসেব জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সদর, ঈশ্বরদী ও সুজানগর উপজেলার চরাঞ্চলের প্রায় ৩০ গ্রামের মানুষ পনিবন্দি হয়ে পড়েছে।

“তবে ক্ষয়ক্ষতির ‘সঠিক পরিসংখ্যান’ এখনিই দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না, কেননা পানি বাড়ছে এবং প্রতিনিয়ত ক্ষতির পরিমানও বৃদ্ধি পাচ্ছে।”