নুসরাত হত্যা: ওসি কেন আসামি নয়, প্রশ্ন বাদীপক্ষের

ফেনীর মাদ্রাসা ছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার ঘটনায় আসামির তালিকা থেকে ওসিকে বাদ রেখে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়ায় আপত্তি করেছে বাদীপক্ষ।

ফেনী প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 May 2019, 11:36 AM
Updated : 29 May 2019, 12:09 PM

মামলার তদন্ত কর্মকর্ত ফেনীর পিবিআই পরিদর্শক মো. শাহ আলম জানান, বুধবার দুপুরে ফেনীর জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের সোনাগাজী আমলী আদালতে মোট ১৬ জনকে আসামি করে তারা এই অভিযোগপত্র জমা দেন।

ফেনীর সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত গত ৬ এপ্রিল ওই মাদ্রাসা কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে গেলে কৌশলে ছাদে ডেকে নিয়ে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে করা শ্লীলতহানির মামলা তুলে না নেওয়ায় তাকে হত্যা করা হয় বলে পরিবারের অভিযোগ।

পরিদর্শক শাহ আলম বলেন, অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাকে এ মামলায় ‘হুকুমদাতা’ হিসেবে ১ নম্বর আসামি করা হয়েছে। আওয়ামী লীগ নেতা হিসেবে নির্বাচিত পৌর কাউন্সিলর ও মাদ্রাসার প্রভাষকও রয়েছে আসামির তালিকায়।

এছাড়া এ ঘটনায় তিন পুলিশ সদস্যের দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ মিলেছে। আর ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে প্রচার চালানোর অভিযোগে আদালত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছে সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনের বিরুদ্ধে। কিন্তু তাকে মামলায় আসামি করা হয়নি।

বাদীপক্ষের আইনজীবী এম শাহজাহান সাজু বলেন, “ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন প্রথম থেকে হত্যার ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে প্রচারণা চালান। কিন্তু তাকে আসামি করা হয়নি।

“অভিযোগপত্রের শুনানির দিন আইনজীবীরা পিবিআইর কাছে জানতে চাইবেন কেন তাকে আসামি করা হয়নি। প্রয়োজনে মামলার বাদী নুসরাতের ভাই নোমানের সঙ্গে আলাপ করে অভিযোগপত্রের বিরুদ্ধে নারাজি জানানো হবে।”

বৃহস্পতিবার অভিযোগপত্রের ওপর শুনানি হবে বলে তিনি জানান।

ফেনীর সোনাগাজী থানার সাবেক ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন

আইনজীবী শাহাজান বলেন, ধারা অনুযায়ী মামলাটির বিচারকাজ চলবে নারী ও শিশুনির্যাতন দমন ট্রাইবুনালে। সেক্ষেত্রে আমলী আদালত থেকে মামলাটি ওই ট্রাইবুনালে স্থানান্তর করতে হবে। এরপর মামলার অভিযোগপত্র গ্রহণের ওপর শুনানি হবে।

পিবিআই চট্টগ্রাম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইকাবাল জানান, পিবিআই মামলা তদন্তের দায়িত্ব নেওয়ার ৫০ দিনের মধ্যে ৩৩ কার্যদিবসে ৮০৮ পৃষ্ঠার অভিযোগপত্রটি আদালতে দাখিল করেছে।

“অভিযোগপত্রে আগুন দেওয়ার ঘটনায় সরাসরি জড়িত পাঁচজনসহ মোট ১৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। এছাড়া ওই মাদ্রাসার গভর্নিং বডির সহ-সভাপতি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা রুহুল আমীন ও সোনাগাজীর পৌর কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা মাকসুদ আলম ওই হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নে আর্থিক সহযোগিতাসহ বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে।”

পিবিআই চট্টগ্রাম বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ইকাবাল আরো বলেন, “অভিযোগপত্রে ৯২ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। তাদের মধ্যে কার্যবিধির ১৬১ ধারায় ৬৯ জনকে সাক্ষী করা হয়েছে। আর সাতজন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দিমূলক স্বাক্ষ্য দিয়েছেন।

“আদালতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অভিযোগপত্রের সারমর্ম বিচারকের কাছে তুলে ধরেন। হত্যার পরিকল্পনা, প্রস্তুতি, হত্যার সময়ের ঘটনার ডিজিটাল স্কেচও আদালতে তুলে ধরেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।”

ইকাবাল বলেন, “আগুনে পুড়িয়ে হত্যা, হত্যার পরিকল্পনায় অংশগ্রহণ ও হত্যাকাণ্ডে সহযোগিতায় জড়িতদের বিরুদ্ধে নারী ও শিশুনির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৪ (১) ও ৩০ ধারায় অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। পিবিআই অভিযোগপত্রে ১৬ আসামির সবার সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড চেয়েছে।”

মামলার বাদী নুসরাতে বড় ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান বলেন, “পিবিআই আদালতে যে অভিযোগপত্রটি দিয়েছে তার বিস্তারিত আমার এই মুহূর্তে জানা নেই। আমি দেখব অভিযোগপত্রে কারা আসামি হয়েছেন। তবে আমি মনে করি আমার বোনকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া ওসি মোয়াজ্জেম হোসেনকে এ মামলায় অভিযোগপত্রে আসামি করা উচিত ছিল। আমি আমার আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শকরে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করব।”

নুসরাতের মা শিরিন আক্তার বলেন, “মামলার পর থেকে অনেক ধরনের হুমকি পেয়েছি। তবে আমরা এটাকে আমলে নিইনি। যেখানে মেয়েকে হারিয়েছি, সেখানে নিজেরা বেঁচে থেকে কী করব? যেখানে নুসরাত হত্যার বিচারের দায়িত্ব প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিয়েছেন, সেখানে আমাদের মেরে ফেললেও কোনো সমস্যা নেই। মামলার অভিযোগপত্রে অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলা, কাউন্সিলর মাকসুদ আলমসহ ১৬ জনকে অভিযুক্ত করায় আমরা সন্তোষ প্রকাশ করছি। একই সঙ্গে আমরা আদালতের কাছে সব আসামির সর্বোচ্চ শাস্তি দাবি করছি।”

১৬ আসামি হলেন- সোনাগাজীর চরকৃষ্ণজয়ের কলিম উল্যাহ সওদাগার বাড়ীর কলিম উল্যার ছেলে এসএম সিরাজ-উদ-দৌলা (৫৭), চরচান্দিয়া ইউনিয়নের উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের মো. আহসান উল্যাহর ছেলে নুর উদ্দিন (২০), চরচান্দিয়া ইউনিয়নের ভূইয়া বাজারে এলাকার নবাব আলী টেন্ডল বাড়ী মো. আব্দুর রাজ্জাকের ছেলে শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), পৌরসভার ৪নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর, পৌর আওয়ামী লীগের যুগ্ন সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক) ও চরগণেশ গ্রামের পান্ডব বাড়ীর আহসান উল্যাহ ছেলে মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ আল কাউন্সিলর (৫০), পূর্ব তুলাতলী গ্রামের খায়েজ আহাম্মদ মোল্লা বাড়ীর আবুল বাশারের সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১), উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের সৈয়দ সালেহ আহাম্মদের বাড়ীর রহমত উল্যাহ ছেলে জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন জাবেদ (১৯), সফরপুর গ্রামের খান বাড়ীর আবুল কাশেমের ছেলে হাফেজ আব্দুল কাদের (২৫), সোনাগাজীর ইসলামিয়া ফাজিল (ডিগ্রী) মাদ্রাসার ইংরেজি বিভাগের প্রভাষক ও উত্তর চারচান্দিয়া গ্রামের সওদাগর বাড়ীর ইবাদুল হকের ছেলে আবছার উদ্দিন (৩৩), চরগণেশ গ্রামের আজিজ বিডিআর বাড়ীর আব্দুল আজিজের (পালক বাবা) মেয়ে কামরুন নাহার মনি (১৯), লক্ষীপুর গ্রামের সফর আলী সর্দার বাড়ীর শহিদুল ইসলামের মেয়ে উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে শম্পা ওরফে চম্পা (১৯), পূর্ব চরচান্দিয়া গ্রামের সোজা মিয়া চৌকিদার বাড়ীর আব্দুল শুক্কুরের ছেলে আব্দুর রহিম শরীফ (২০), চরগণেশ গ্রামের হাজী ইমান আলীর বাড়ী ওরফে মালশা বাড়ীর জামাল উদ্দিন জামালের ছেলে ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), চরগণেশ গ্রামের এনামুল হকের নতুন বাড়ীর এনামুল হক ওরফে মফিজুল হকের ছেলে ইমরান হোসেন ওরফে মামুন (২২), তুলাতলী গ্রামের আলী জমাদ্দার বাড়ীর সফি উল্যাহ ছেলে মোহাম্মদ শামীম (২০), সোনাগাজী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও চরচান্দিয়া গ্রামের ভূইয়া বাজার এলাকার কোরবান আলী বাড়ীর কোরবান আলীর ছেলে রুহুল আমিন (৫৫), উত্তর চরচান্দিয়া গ্রামের বোর্ড অফিস সংলগ্ন রুহুল আমিনের নতুন বাড়ীর মো. রুহুল আমিনের ছেলে মহিউদ্দিন শাকিল (২০)।

এ মামলায় এজাহারভুক্ত আটজনসহ ২১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পিবিআই। তাদের মধ্যে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ-উদ-দৌলাসহ ১২ জন হত্যার দায় স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।