এক বিঘার ধান কাটতে লাগে ‘৫ মণের দাম’

এবার বোরো মৌসুমে ধানের ফলন ভালো হলেও উৎপাদন খরচের চেয়ে বাজার মূল্য কম হওয়ায় চরম বিপাকে পড়েছেন নীলফামারীর কৃষকরা।  

নীলফামারী প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 18 May 2019, 04:49 PM
Updated : 19 May 2019, 05:46 AM

জমি ও বীজ তৈরি থেকে শুরু করে ঘরে তোলা পর্যন্ত এক মণ ধানে খরচ পড়েছে অন্তত ৭৩০ টাকা। এখন বিক্রি করতে হচ্ছে ৪০০ টাকা মণ দরে।

এদিকে, সরকার ধান-চাল ক্রয়ের জন্য ২৫ এপ্রিল থেকে ৩১ অগাস্ট পর্যন্ত সময় নির্ধারণ করলেও জেলায় ক্রয় অভিযান এখনও শুরু হয়নি। 

সরকারিভাবে এবার প্রতিকেজি ধান ২৬ টাকা এবং প্রতি কেজি চাল ৩৬ টাকা কেনা হবে।

নীলফামারী জেলায় এবার সরকারিভাবে দুই হাজার ৬৬২ মেট্রিক টন ধান ও ১৭ হাজার ৯৬৫ মেট্রিক টন চাল ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

কিন্তু ধান ও চাল ক্রয় এখনু শুরু না হওয়ায় ফরিয়া ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো দাম নির্ধারণ করে ধান ক্রয় করছে; কৃষকরা অসহায় হয়ে পড়েছেন।

নীলফামারী সদরের ইটাখোলা ইউনিয়নের চৌধুরী পাড়ার কৃষক আইয়ুব আলীর (৫৫) নিজের আবাদী জমি নেই। মানুষের জমি ইজারা নিয়ে আবাদ করে সংসার চালান। এবার বোরো মৌসুমে আট বিঘা জমি ইজারা নিয়ে ধান চাষ করেছেন।

প্রতি বিঘা জমির ইজারা বাবদ জমির মালিককে পরিশোধ করতে হয়েছে চার হাজার করে মোট এক ৩২ হাজার টাকা। ধানের চারা রোপন থেকে শুরু করে কাটা-মাড়াই পর্যন্ত প্রতি বিঘায় তার খরচ হয়েছে ১৩ হাজার ৫০০ টাকা। সেই হিসাবে এক বিঘা জমি ইজারা নেওয়া থেকে শুরু করে চারা রোপন আর কাটা-মাড়াই পর্যন্ত খরচ হয়েছে ১৭ হাজার ৫০০ টাকা। আর প্রতি বিঘায় গড়ে ধান হয়েছে ২৪ মণ।

অর্থাৎ প্রতিমণ ধানের উৎপাদন খরচ ৭৩০ টাকার মতো। আট বিঘার মোট ধানের উৎপাদন খরচ এক লাখ ৪০ হাজার টাকা।

কৃষক আইয়ুব আলীর ভাষ্য, পরিকল্পনা ছিল ধান বিক্রির টাকা থেকে ধার-দেনা পরিশোধ করবেন। যেসব গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি বিক্রি করেছিলেন ছাষের খরচ যোগাতে তা আবার কিনবেন। কিন্তু ৪০০ টাকা মণ দরে ধান বিক্রি করে পেয়েছেন ৭৬ হাজার ৮০০ টাকা। লোকসান হয়েছে ৬৩ হাজার ২০০ টাকা।

আইয়ুব আলী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “একজন কিষাণের এক দিনের মাইনা দিতে হয়েছে ৫০০ টাকা। ওই মাইনা পরিশোধ করতে লেগেছে ৫০ কেজি ধান। এক বিঘা জমির ধান কাটতেই বিক্রি করতে হয়েছে পাঁচ মণ ধান।

“এত ধান আবাদ করিনু। সেই ধান বিক্রি করি খরচ ওঠা তো দূরের কথা পূঁজিই গায়েব। ধান আবাদ করি যদি লোকসান গুনতে হয়, তাহলে মুই আর ধান আবাদ করিম না।”

শনিবার জেলার বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা যায়, পাকা ধানের ভরা মাঠ, ফলনও হয়েছে বাম্পার; কিন্তু ফসলের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় আইয়ুব আলীর মতো অনেক কৃষকের মুখ মলিন।

কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, জেলায় এবার ৮৩ হাজার ৬৪৫ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। ইতিমধ্যে ৩০ ভাগ জমির ধান কাটা হয়েছে।

বিভিন্ন হাট-বাজারে ঘুরে দেখা গেছে, প্রতিমণ ধান বিক্রি হচ্ছে ৩৭০ টাকা থেকে ৪০০ টাকার মধ্যে। এমন দামেও ক্রেতার ঘাটতি। ব্যবসায়ীরা ওত পেতে আছে আরও কম দামের আশায়। ফলে হাটবাজারে ধান বিক্রি করতে না পেরে ফিরে গেছেন অনেক কৃষক।

নিজের ২২ বিঘা জমিতে ধান আবাদ করেছে পৌর শহরের বাড়াইপাড়া গ্রামের কৃষক রতন সরকার (৪৫)। নিজের জমি হওয়ায় ইজারা বাবদ অতিরিক্ত চার হাজার টাকা প্রতি বিঘায় কম খরচ হয়েছে। এরপরও তার প্রতি বিঘায় লোকসান হয়েছে প্রায় চার হাজার টাকা।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকার প্রতি কেজি ধান ২৬ টাকা এবং চাল ৩৬ টাকা মূল্য নির্ধারণ করেছে; কিন্তু সেটা তো কৃষক পাচ্ছে না। ব্যবসায়ীরা ইচ্ছামতো দাম নির্ধারণ করে ধান কিনছে। পূঁজি হারানো কৃষক ধান আবাদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে।”

এদিকে, জেলায় এবার সরকারিভাবে দুই হাজার ৬৬২ মেট্রিক টন ধান ও ১৭ হাজার ৯৬৫ মেট্রিক টন চাল ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ২৫ এপ্রিল থেকে ৩১ অগাস্ট পর্যন্ত ধান ও চাল ক্রয়ের সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। কিন্তু সরকারি ক্রয় অভিযান এখনও শুরু হয়নি।

এ বিষয়ে ডোমার উপজেলার জোড়াবাড়ি ইউনিয়নের হলহলিয়া গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলাম (৪৫) বলেন, “কৃষকের ঘরে ধান শেষ হলে সরকারি ক্রয় শুরু হয়। আর কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান ক্রয়ের নিয়ম থাকলেও কৃষক সে সুবিধা পায় না। এক শ্রেণির লোক মেম্বার-চেয়ারম্যানের মাধ্যমে ধান সরবরাহের স্লিপ সংগ্রহ করে খাদ্য গুদামে সরবরাহ করে থাকে।”

ধান সংগ্রহে নিয়ম পরিবর্তনের দাবি জানান এই কৃষক।

জেলা কৃষক সমিতির সভাপতি আতিয়ার রহমান বলেন, “প্রতি মণ ধান উৎপাদনে একজন কৃষকের খরচ হয় আটশ টাকা। সেখানে ধান বিক্রি করে পাচ্ছেন অর্ধেক টাকা। এ অবস্থায় পুঁজি হারানো কৃষক ধান আবাদ থেকে বিরত থাকবেন। এতে খাদ্য ঘাটতিতে পড়বে দেশ।”

তিনি বলেন, “সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়া সহজীকরণের জন্য প্রতিটি বড় হাট-বাজারে ক্রয় কেন্দ্র খোলার দাবি জানিয়ে আসছি। আর সেটি চালু করতে হবে কৃষকের ঘরে ধান উঠার মুহূর্তে; কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সে দাবি উপেক্ষিত রয়ে গেছে।”

এই কৃষক নেতা বলেন, এবার জেলায় ধানের বাম্পার ফলন হয়েছে; কিন্তু সরকার মাত্র দুই হাজার ৬৬২ মেট্রিক টন ধান ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় অনেক কৃষক বঞ্চিত হবেন। কৃষকরা যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য জেলায় ধান ক্রয়ের লক্ষ্যমাত্রা আরও বাড়ানো উচিত সরকারের। 

এ ব্যাপারে জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক কাজী সাইফুদ্দিন অভি বলেন, সরকারের অভ্যন্তরীণ বোরো ধান সংগ্রহ অভিযান চলবে ২৫ এপ্রিল থেকে ৩১ অগাস্ট পর্যন্ত। অন্যান্য অঞ্চলের ধান আগে ওঠা শুরু করলেও এ অঞ্চলের ধান দেরিতে ওঠে।

“নীলফামারী জেলায় গত দুই তিন দিন থেকে কৃষকরা ধান কাটা-মাড়াই শুরু করেছেন। কৃষকদের এই ধান শুকাতে কমপক্ষে ৪ থেকে ৫ দিন লাগবে। এরপর কৃষকরা ধান বিক্রি করতে পারবেন।

“আমরা গত ৩০ এপ্রিল জেলা পর্যায়ের সংগ্রহ অভিযান কমিটির মিটিং করে কৃষকদের তালিকা চেয়ে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালকে পত্র দিয়েছি। তারা তালিকা জমা দিচ্ছেন। সেগুলো যাচাইবাছাই কাজ চলছে। রোববার থেকে জেলার ছয় উপজেলায়  একযোগে ধান সংগ্রহ অভিযান শুরু হবে।”

২৫ এপ্রিল থেকে ক্রয় অভিযান শুরুর সময় নির্ধারিত থাকলেও এখনও কৃষকদের তালিকা প্রণয়ন হয়নি কেন জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ক্রয় অভিযান শুরুর তারিখের আগেই তারা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগকে কৃষকের তালিকা দিতে বলেছেন। কিন্তু কৃষি বিভাগ তালিকা দিতে না পারায় এ বিলম্ব।

এখানে খাদ্য বিভাগের কোনো ঘাটতি নেই বলে দাবি তার।   

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগের উপ-পরিচালক আবুল কাশেম আযাদ বলেন, “বীজ, সেচ ও সারের কোনো সংকট ছিল না জেলায়। পাশাপাশি আবাহাওয়া অনুকূলে থাকায় বাম্পার ফলন হয়েছে। দাম কম হওয়ায় কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।”

সরকারিভাবে ধান ক্রয় শুরু হলে কৃষকরা ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পাবেন বলে তিনি মনে করেন।।

কৃষকদের কাছ থেকে সরকারের ধান ক্রয়ের প্রক্রিয়া

জেলা বা উপজেলা কৃষি বিভাগ প্রতিটি ইউনিয়ন পর্যায়ে প্রকৃত কৃষকদের তালিকা প্রণয়ন করে  জেলা বা উপজেলা পর্যায়ের গঠিত ধান-চাল সংগ্রহ কমিটির কাছে জমা দেবে। ওই কমিটি তালিকা যাচাইবাছাই শেষে প্রকৃত কৃষকদের মাঝে কৃষক পরিচয়পত্র দেবে। কৃষকরা নিজেদের জাতীয় পরিচয়পত্র এবং কৃষক পরিচয়পত্রসহ ধান নিয়ে খাদ্য গুদামে গেলে তাদের ধান ক্রয় করবে খাদ্য বিভাগ।