ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় উপকূলে প্রস্তুতি 

ঘূর্ণিঝড়  ‘মোরা’ র আঘাত মোকাবেলায় কক্সবাজারসহ উপকূলীয় জেলাগুলো ক্ষয়-ক্ষতি ও দুর্যোগ মোকাবিলা করতে প্রস্তুতি সভা করেছে প্রশাসন।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 May 2017, 09:59 AM
Updated : 29 May 2017, 02:50 PM

ঘূর্ণিঝড়টি আরও উত্তর দিকে সরে বাংলাদেশ উপকূলে দিকে চলে আসায় উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোতে ৭ নম্বর বিপদ সংকেত দেখাতে বলা হয়েছে।

আর পায়রা ও মোংলা বন্দরসহ ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোকে দেখাতে বলা হয়েছে ৫ নম্বর বিপদ সংকেত।

সংকেত দেখানোর পর সোমবার জরুরি প্রস্তুতি সভা করে উপকূলীয় জেলাগুলোর প্রশাসন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর

কক্সবাজারে নিরাপদ আশ্রয়ে সরে আসার মাইকিং

কক্সবাজার জেলা জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে সোমবার সকাল সাড়ে ১১টায় দুর্যোগ মোকাবিলা ও ব্যবস্থাপনা কমিটির এ প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত হয়।

জেলা প্রশাসক মো. আলী হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায়, উপকূলীয় এলাকায় মাইকিং করে মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে বলা হয়েছে।

প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে দুর্যোগকালীন নিরাপত্তায় অর্ধশতাধিক মেডিকেল টিম ও স্বেচ্ছাসেবক দল। পাশাপাশি আশ্রয়কেন্দ্রের লোকজনের জন্য খাদ্য সরবরাহ করা হয়েছে বলেও জানানো  হয় সভায়।

সেইসঙ্গে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল ও সবধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠদান বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলে জেলা প্রশাসক আলী হোসেন জানান।

জেলা প্রশাসক আলী বলেন, “উপকূলীয় এলাকার মানুষকে সরিয়ে নিতে জেলার ৫৩৮টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এ সব আশ্রয়কেন্দ্রে পাঁচ লাখের বেশি মানুষকে আশ্রয় দেওয়া যাবে। তাদের নিরাপত্তার পাশাপাশি খাদ্য সরবরাহের ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছে।”

তিনি বলেন, দুর্যোগকালীন নিরাপত্তায় গঠন করা হয়েছে ৮৮টি মেডিকেল টিম। প্রস্তুত রাখা হয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মসূচির আওতায় থাকা ৪১৪ টি ইউনিটের ৬ হাজার ১০ জন স্বেচ্ছাসেবক।

“তাছাড়া রয়েছে রেড ক্রিসেন্টের ১৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবক কর্মী।”

সার্বিক কার্যক্রম তদারকি করতে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সাইফুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে বলে জানান তিনি।

এদিকে দুর্যোগ মোকাবেলায় জেলা প্রশাসনের প্রস্তুতি সভার পর জেলার উপকূলীয় এলাকায় চলছে সতর্কতামূলক মাইকিং ও প্রচার। এতে ঘূর্ণিঝড় আঘাতহানার আগেই পার্শ্ববতী আশ্রয়কেন্দ্রে  নিরাপদে সরে আসতে বলা হচ্ছে।

তবে উপকূলীয় এলাকার লোকজনকে এখনও আশ্রয়কেন্দ্রে আসতে দেখা যায়নি।

সভায় কক্সবাজারের সিভিল সার্জন উ: পুঁচনু ,অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. রুহুল কুদ্দুস, কক্সবাজার পৌরসভার ভারপ্রাপ্ত মেয়র মাহবুবর রহমান চৌধুরী ও জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সিরাজুল মোস্তফাসহ প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, এনজিও ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

নোয়াখালীতে ঘূর্ণিঝড় পূর্ব ও পরবর্তী প্রস্তুতি সম্পন্ন

নোয়াখালীতে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ মোকাবেলায় আশ্রয় কেন্দ্র, মেডিকেল টিম ও ত্রাণ সহায়তা হিসেবে নগদ টাকা ও চাল মজুদসহ নানা ব্যবস্থা নিয়েছে প্রশাসন।

জেলা প্রশাসক মো. মাহবুব আলম তালুকদার বলেন, ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ মোকাবেলায় ‘ব্যাপক’ প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

“জেলায় ৪১২টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। প্রস্তুত রাখা হয়েছে ১০২টি মেডিকেল টিম। তাৎক্ষণিক ত্রাণ সহায়তা হিসেবে নগদ ছয় লাখ ৩৯ হাজার টাকা ও ২৯৮ মেট্রিক টন চাল মজুদ রয়েছে।”

আশ্রয় কেন্দ্রগুলোকে প্রয়োজনীয় খাবার, আলো ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। লোকজনকে নিরাপদে আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ছয় হাজার ২৪০ জন স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে বলে জানান তিনি।

পুলিশ সুপার মো. ইলিয়াছ শরীফ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বাড়িঘর থেকে লোকজন আশ্রয় কেন্দ্রে চলে আসার পর যাতে ঘরের কোনো কিছু খোয়া না যায় সেদিকে সর্তক দৃষ্টি রাখা হচ্ছে।

“লোকজনকে নিরাপদে সরিয়ে আনার পাশাপাশি সব রকম প্রয়োজনের জন্য জেলা পুলিশ, গ্রাম পুলিশ পুরোপুরি প্রস্তুত রয়েছে।”

জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে বলে জানান তিনি।

 

জেলা ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচির উপ-পরিচালক মো. সরাফৎ হোসেন খান বলেন, নোয়াখালী উপকূলে সাত নম্বর বিপদ সংকেত থাকায় সব ধরণের নৌ চলাচল বন্ধ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

স্বেচ্ছাসেবকরা মাইকে লোকজনকে নিরাপদে আশ্রয় যাওয়া ঘোষণা দিয়ে যাচ্ছে বলেন তিনি।

পটুয়াখালীতে প্রস্তুত ৩৫১টি আশ্রয় কেন্দ্র

‘মোরা’ র প্রভাবে পটুয়াখালীর কোথাও কোথাও থেমে থেমে মাঝারি ও গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে।

এর মধ্যে বেলা ১১টায় জেলা প্রশাসক দরবার হলে প্রস্তুতিমূলক জরুরি সভা করে দুর্যোগ মোকাবেলা প্রস্তুতিমূলক কমিটি।

প্রস্তুতি সভায় জেলা প্রশাসক মাছুমুর রহমান জানান, ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলার জন্য জেলা ও উপজেলায় কন্ট্রোলরুম খোলা হয়েছে। জেলার সকল দপ্তরের কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।

তাছাড়া উপজেলা, ইউনিয়ন এবং ওয়ার্ড পর্যায়ে সভা করে ঘূর্ণিঝড়ের বার্তা এবং এর মোকাবেলার প্রস্তুতি নেওয়ার বিষয়ে সাধারণ মানুষের মাঝে প্রচারের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

সভায় সব উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে জরুরি সভা করে ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ এবং সরকারি কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ঘূণিঝড় মোকাবেলায় জেলার ৩৫১টি সাইক্লোন সেল্টার ও আশ্রয়ন কেন্দ্রকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। শুকনো খাবারের পর্যাপ্ত মজুদ রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ মজুদ রাখা হচ্ছে বলে প্রস্তুতি সভায় জানানো হয়।

এছাড়া সাগর উপকূলীয় উপজেলা সমূহের অদূরবর্তী দ্বীপ ও নিম্নাঞ্চলের বসবাসরত মানুষকে নিরাপদ আশ্রয় সরিয়ে আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

রেড ক্রিসেন্ট, বিভিন্ন এনজিওর স্বেচ্ছাসেবকসহ সবাইকে সর্তক থেকে প্রশাসনের সঙ্গে কাজ করাও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

বাগেরহাটে ১০ নিয়ন্ত্রণ কক্ষ, ২৩৪ আশ্রয়কেন্দ্র

ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ মোকাবেলায় বাগেরহাটে সব সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে।

সেইসঙ্গে খোলা হয়েছে ১০টি কন্ট্রল রুম, স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে ৮৩ টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে বলে সোমবার বিকালে জেলা প্রশাসনের জরুরি সভায় জানানো হয়।

সভায় জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১০টি কন্ট্রল রুম খোলা হয়েছে। উপকূলীয় এলাকার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের জরুরি সভা করে দুর্যোগ মোকাবেলায় সব প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

তাছাড়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিলসহ স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে ৮৩ টি মেডিকেল টিম ও ২৩৪টি সাইক্লোন শেল্টার প্রস্তুত রাখা হয়েছে বলে জানান তিনি।

সেইসঙ্গে শুকনো খাবার সরবরাহের জন্য স্বেচ্ছাসেবকদের তৈরি রাখা হয়েছে। সরকারি বিভিন্ন সংস্থার পাশাপাশি বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনগুলোকে মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এদিকে মংলা সমুদ্র বন্দরে অবস্থান করা ১১টি বাণিজ্যিক জাহাজে পণ্য ওঠানামার কাজ বন্ধ করে দিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। দুর্যোগ মোকাবেলা করতে বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রস্তুতি সভা করেছে। খুলেছে কন্ট্রোল রুম।

বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান কমডোর ফারুক হাসানের সভাপতিত্বে ওই জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়।

মংলা বন্দর কর্তৃপক্ষের হারবার মাস্টার কমান্ডার মো. ওয়ালিউল্লাহ বলেন, মংলা বন্দরে বর্তমানের সার, ক্লিংকার, যন্ত্রাংশসহ ১১টি জাহাজ অবস্থান করছে।বন্দরে অবস্থান করা সব জাহাজে পণ্য ওঠানামার কাজ বন্ধ রাখা হয়েছে।

“এছাড়া চট্টগ্রাম বন্দর থেকে নৌবাহিনীর ১০টি এবং কোস্টগার্ডের ২টি জাহাজ আমাদের বন্দরে সরিয়ে আনা হয়েছে।”

বাগেরহাট পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. সাইদুল ইসলাম জানান, ঘুর্ণিঝড় ‘মোরা ’মোকাবেলায় বঙ্গোপসাগর থেকে আশ্রয় নেওয়া পাঁচ শতাধিক মাছ ধরার ট্রলারকে দুবলা, হিরণপয়েন্ট, কটকা, কচিখালীসহ বিভিন্ন এলাকার ছোট ছোট নদী ও খালে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।

লক্ষ্মীপুরে প্রস্তুতি সভা

ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ মোকাবেলায় প্রস্তুতি সভা করেছে লক্ষ্মীপুর জেলা প্রশাসন।

সোমবার সকালে জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা, রেড ক্রিসেন্ট সদস্য ও স্থানীয় সাংবাদিকদের নিয়ে এ প্রস্তুতি সভা করা হয়।

জেলা প্রশাসক হোমায়রা বেগমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভায় উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষদের নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসা, দুর্যোগ পূর্ববর্তী, দুর্যোগকালীন ও পরবর্তী সময়ে খাদ্য সরবরাহ, মেডিকেল টিম গঠন ও ছয়টি কন্ট্রোলরুম খোলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

চাঁদপুরে চরাঞ্চলে মাইকিং

চাঁদপুরে ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ মোকাবেলায় জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির প্রস্তুতি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

সোমবার দুপুরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা প্রশাসক মো. আব্দুস সবুর মণ্ডল।

এ সময় চরাঞ্চলের মানুষদের সচেতন করতে মাইকিংয়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া নৌ-যানবাহন সতর্কতার সাথে চলাচলের জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ আরও ঘনীভূত হয়ে উত্তর দিকে অগ্রসর হওয়ার পর মঙ্গলবার ভোরে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার উপকূল অতিক্রম করতে পারে বলে আবহাওয়া অধিদপ্তরের থেকে জানানো হয়েছে।

ভোলায় লঞ্চ চলাচল বন্ধ

ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ মোকাবেলায় ভোলায় খোলা হয়েছে সাতটি কন্ট্রোল রুম।

জেলা প্রশাসক মোহা. সেলিম উদ্দিন জানিয়েছেন, তাছাড়া সোমবার দুপুর থেকে উপকূলীয় এলাকায় মাইকিং করছে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির স্বেচ্ছাসেবকরা।

তিনি বলেন, জেলার চরাঞ্চলের মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে যেতে বলা হয়েছে। এছাড়া আশ্রয় কেন্দ্রে সরবরাহের জন্য শুকনো খাবার,  সেচ্ছাসেবক প্রস্তুত রেখেছে জেলা প্রশাসন। জেলার হাসপাতালগুলোর অ্যাম্বুলেন্স এবং ওষুধ প্রস্তুত রাখার জন্য বলা হয়েছে।

ছোট ছোট নৌযানকে নিরাপদ আশ্রয়ে আসতে বলা হয়েছে।

বিআইডব্লিউটিএর ভোলা কর্মকর্তা মো. নাসিম জানিয়েছেন সোমবার বেলা ১২টার পর থেকে ভোলা থেকে সকল রুটের লঞ্চ ও স্পিড বোট চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।