ঢাকার ধামরাই থানার আসামি আপন ফকিরের যিনি আইনজীবী ছিলেন; তিনি ‘জালিয়াতির’ বিষয়টি জানতে পেরে মামলা থেকে সরে এসেছেন বলে জানিয়েছেন।
Published : 02 Nov 2024, 12:23 AM
ঢাকার ধামরাই উপজেলায় মাদক মামলার এক আসামির পরিবর্তে আরেক যুবক টাকার বিনিময়ে জেল খাটছেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
উপজেলার কুল্লা ইউনিয়নের ফোর্ডনগর গ্রামের মৃত হারুন সরদার ও রেনু বেগমের সন্তান মো. রাজীব হোসেন এক বছরের বেশি সময় ধরে ‘আসামি সেজে’ কারাগারে আছেন।
অপরদিকে মামলার মূল আসামি একই ইউনিয়নের ফকিরপাড়া গ্রামের খালেক ফকিরের ছেলে আপন ফকির (৪০) ‘প্রকাশ্যে’ ঘুরে বেড়াচ্ছেন বলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি জানিয়েছেন।
মাদকের মামলায় আপন ফকিরের যিনি আইনজীবী ছিলেন; তিনি ‘জালিয়াতির’ বিষয়টি জানতে পেরে মামলা থেকে সরে এসেছেন বলে জানিয়েছেন।
আপন ফকিরের বিরুদ্ধে মামলা করে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছিল মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর।
মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা ‘ক’ সার্কেলের পরিদর্শক নুসরাত জাহান বলেন, “২০২৩ সালের ৮ জুন ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে অফিযোগপত্র দাখিল করি। কিন্তু কিছুদিন ধরে শুনছি, মামলার প্রধান আসামি আপন ফকির এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তার পরিবর্তে হাজতবাস করছে অন্য লোক। বিষয়টি আমরা খোঁজ-খবর করছি।”
মামলার বিবরণে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ২৫ জানুয়ারি ফোর্ডনগর দক্ষিণ ফকিরপাড়া গ্রামের লাবু মার্কেটের সামনে আপন ফকির ও মোসা, বেবীকে আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
আপন ফকিরের দেহ তল্লাশি করে দুই হাজার পুড়িয়া (২০০ গ্রাম) হেরোইন এবং বেবীর (৪৮) শাড়ীর ভাজে আরও এক হাজার পুড়িয়া (১০০ গ্রাম) হেরোইন জব্দ করেন তারা।
গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসার সময় তারা চিৎকার শুরু করেন। তখন তাদের লোকজন এসে অভিযানে থাকা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ওপর হামলা চালায় এবং দুজনকে ছিনিয়ে নেয়।
পরে এ ঘটনায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা ‘ক’ সার্কেলের এসআই মনিরা বেগম বাদী হয়ে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ২০১৮ এর ৩৬ (১) সারণির ৮(গ) / ৪২(২) ধারায় ধামরাই থানায় মামলা করেন।
ওই বছরের ৮ জুন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিদর্শক নুসরাত জাহান ঢাকার মুখ্য বিচারিক হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র দেন।
এরপর ২৬ অক্টোবর মামলার প্রধান আসামি ‘আপন ফকিরের পরিবর্তে তার পরিচয়ে’ আদালতে আত্মসমর্পণ করেন রাজীব। আদালত তাকে কারাগারে পাঠায়। সেই থেকে তিনি কারাগারে আছেন।
বিষয়টি নিয়ে রাজীবের মা রেনু বেগমকে মোবাইল করা হলে তিনি সরাসরি কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন। মোবাইলেও কথা বলছিলেন ভীত কণ্ঠে।
তবে ছেলে রাজীব কারাগারে আছে জানিয়ে রেনু বেগম বলেন, “আমি মানুষের বাড়িতে কাজ করে চলি। আমার ছেলে রাজীবকে জেল থেকে ছাড়ানোর টাকা নেই। মানুষের বাড়িতে কাজ করে টাকা জমাচ্ছি। জানুয়ারির দিকে উকিল ধরে ছাড়ানোর ব্যবস্থা করব।”
কেন সরাসরি কথা বলতে চান না- এ প্রশ্নে রেনু বেগম ‘আতঙ্কের’ কথা বলেন।
আপন ফকির স্থানীয়ভাবে জমির ‘দালালি’ (বেচা-কেনা) করেন এবং এলাকায় বেশ প্রভাব রয়েছে বলে জানিয়েছেন কুল্লা ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য মো. উজ্জ্বল মিয়া।
তিনি বলেন, “ছেলেটির (রাজীব) পরিবারে কেউ নেই। মা মানুষের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালায়। মামলার মূল আসামি আপন ফকির দুই হাজার টাকা তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে আপন ফকির পরিচয়ে রাজীবকে আদালতে আত্মসমর্পণ করায়।
“এরপর থেকে রাজীব জেলহাজতে রয়েছে। আর আসামি আপন ফকির প্রকাশ্যে এলাকায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের করা মামলায় আপন ফকিরের আইনজীবী ছিলেন মেহেদী হাসান বাদল।
তিনি বলেন, “মাদক মামলায় আপন ফকিরের জামিনের জন্য কাজ করছিলাম। এর মধ্যে আমাকে না জানিয়ে আমার জুনিয়র এক উকিলের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে আপন ফকিরের পরিবর্তে অন্য এক যুবককে আপন ফকির সাজিয়ে আদালতে আত্মসমর্পণ করায়।
“এই কথা আমি জানার পর আপন ফকিরের মামলা ছেড়ে দিয়েছি। এখন কোন উকিল দিয়ে কাজ করাচ্ছে আমি জানি না।”
এভাবে একজন আসামির পরিবর্তে অন্যজনকে কারাগারে পাঠানো কিংবা অন্য কারো হয়ে জেলখাটা আইনে অপরাধ জানিয়ে আইনজীবী মেহেদী হাসান বাদল বলেন, “এ কারণেই তার মামলা আমি ছেড়ে দিয়েছি।”
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ঢাকা ‘ক’ সার্কেলের পরিদর্শক নুসরাত জাহান বলেন, “আমরা যখন অভিযানে আপন ফকিরকে আটক করেছিলাম তখন আমাদের উপর হামলা করে পালিয়ে গেল। পুলিশও তার পক্ষে, যার কারণে বারবার সে পার পেয়ে যাচ্ছে। আপন ফকিরের বিশাল বাহিনী রয়েছে। শিগগির তাকে গ্রেপ্তারে অভিযান চালানো হবে।”
এ ব্যাপারে জানতে পরিচয় গোপন রেখে আপন ফকিরের মোবাইলে কল করা হলে তিনি এলাকাতেই আছেন বলে জানান। পরে তার পরিবর্তে অন্য একজন জেল খাটছে- এমন প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি কল কেটে মোবাইল বন্ধ করে দেন।
আপন ফকিরের বিরুদ্ধে মাদকের আরও মামলা আছে কি-না জানতে চাইলে ধামরাই থানার ওসি মো. মনিরুজ্জামান বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের মামলাটি ২০২৩ সালের। তিনি কয়েকদিন আগে থানায় যোগদান করেছেন। ফলে বিষয়টি সম্পর্কে তিনি অবগত নন।
তবে বিষয়টি যেহেতু অবগত হয়েছেন খোঁজ নিয়ে জানাবেন বলেও জানান ওসি মনিরুজ্জামান।