কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাট পৌরসভার মেয়র কাদের মির্জা শনিবার বসুরহাটের বঙ্গবন্ধু চত্বরে এক সমাবেশে উপজেলায় রোববার সকাল থেকে অর্ধবেলা হরতালের ঘোষণা দেন।
তিনি বলেন, “নোয়াখালীতে যে অপরাজনীতি চলছে, এর একমাত্র হোতা হলেন একরামুল করিম চৌধুরী। তার অপরাজনীতি সম্পর্কে আমি কথা বলায় আমার বড় ভাই ও আমার পরিবারকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্য করেছেন তিনি। অথচ সবাই জানেন ওবায়দুল কাদের একজন মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার।
“এসব কারণে তার (একরামুল করিম চৌধুরী) অপসারণ দাবি করে রোববার সকাল ৬টা থেকে বেলা ২টা পর্যন্ত হরতাল আহ্বান করছি। হরতাল চলাকালে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলায় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে জরুরি সেবা ও পচনশীল পণ্যবাহী গাড়ি হরতালের আওতামুক্ত থাকবে।”
ওই ভিডিওতে তাকে বলতে শোনা যায়, “দেশের মানুষ স্লামালাইকুম। আমি কথা বললে তো আর মির্জা কাদেরের বিরুদ্ধে কথা বলব না, আমি কথা বলব ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধে। একটা রাজাকার ফ্যামিলির লোক এই পর্যায় আসছে, তার ভাই শাসন করতে পারে না। এইগুলা নিয়ে আমি আগামী কয়েক দিনের মধ্যে কথা বলব। আমার যদি জেলা আওয়ামী লীগের কমিটি না আসে তাহলে আমি এটা নিয়ে শুরু করব।”
আওয়ামী লীগের কমিটিতে বিভিন্ন পদে থেকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আসা ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। আশির দশকের প্রারম্ভে ছাত্রলীগের প্যানেল থেকে দুই দফায় ডাকসুর ভিপি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তিনি।
দীর্ঘ দিন ঢাকায় রাজনীতি করলেও ওবায়দুল কাদের নির্বাচন করেন তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীতে। কোম্পানীগঞ্জ-কবিরহাট উপজেলা নিয়ে গঠিত নোয়াখালী-৫ আসন থেকে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি।
তারই নির্বাচনী এলাকার কবিরহাটে বাড়ি হলেও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক একরামুল করিম চৌধুরী নির্বাচন করেন সদর ও সুবর্ণচর উপজেলা নিয়ে গঠিত নোয়াখালী-৪ আসনে। এই আসন থেকে টানা তৃতীয় মেয়াদে সংসদে প্রতিনিধিত্ব করছেন তিনি।
ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাই মির্জা কাদের কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য। এবার তাকে দ্বিতীয় দফায় বসুরহাট পৌরসভায় মেয়র পদে মনোনয়ন দেয় আওয়ামী লীগ।
গত ৩০ ডিসেম্বর ওই নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণার অনুষ্ঠান থেকে নোয়াখালীর সংসদ সদস্যদের সমালোচনা এবং সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা জানিয়ে বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। তার ওই বক্তব্য নিয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতারা উচ্চকণ্ঠ হয়েছিলেন। সে সময় ওবায়দুল কাদের দলীয় শৃঙ্খলা না মানলে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না বলে ভাইকে হুঁশিয়ার করেন।
তবে এরপরেও আওয়ামী লীগের সমালোচনামূলক নানা বক্তব্য দিয়ে যান মির্জা কাদের। গত ১৬ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিপুল ভোটে জয়ী হয়ে মেয়র নির্বাচিত হন তিনি।
এরপরেও মির্জা কাদের স্থানীয় সংসদ সদস্যদের নিয়ে বিভিন্ন তীর্যক মন্তব্য করে আসার মধ্যে বৃহস্পতিবার ফেইসবুকে ওই ভিডিও প্রকাশ করেন একরামুল করিম চৌধুরী।
নোয়াখালীর প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ ইদ্রিছ মিয়ার ছেলে একরামুল করিম ২০০১ সালে ওবায়দুল কাদেরের আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়েছিলেন। চট্টগ্রামে ব্যবসা করা একরামুল ২০০৮ সালের নির্বাচনে নোয়াখালী-৪ আসনে দলীয় মনোনয়ন পান। এরপর টানা তৃতীয় মেয়াদে সেখানকার সংসদ সদস্য তিনি।
এই পরিস্থিতিতে একরামুল করিম চৌধুরী বলছেন, তার ওই বক্তব্য ওবায়দুল কাদেরকে উদ্দেশ্য করে নয়।
ফেইসবুকে আপলোড করা আরেকটি ভিডিওতে তাকে বলতে শোনা যায়, “সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমি যে বক্তব্যটা দিয়েছি সেটা আমি ওবায়দুলকে মিন করি নাই। মেয়র আবদুল কাদের মির্জাকে মিন করেছি।”
ঢাকায় বিক্ষোভ
ওবায়দুল কাদেরকে নিয়ে ওই বক্তব্যের জন্য একরামুল করিম চৌধুরীকে জাতীয় সংসদ থেকে অপসারণ এবং দল থেকে বহিষ্কারের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছে বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চ।
বিকালে টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে সমাবেশের পর বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ঘুরে শাহবাগ মোড় গিয়ে কর্মসূচি শেষ করেন তারা।
“স্থানীয় রাজনৈতিক দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একরামুল করিম চৌধুরীর বক্তব্য ছিল পুরোপুরি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী। এহেন বক্তব্যের মাধ্যমে তিনি দলীয় গঠনতন্ত্র ও শৃঙ্খলা ভঙ্গ করেছেন। সংবিধান পরিপন্থি বক্তব্যের মাধ্যমে শপথ ভঙ্গ করে তিনি সংসদ সদস্য পদে থাকার নৈতিক যোগ্যতা হারিয়েছেন।"
সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক মো. আল মামুন বলেন, “একজন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকারের বংশধর বলে কটূক্তি করে তিনি মহান মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করেছেন। সংবিধান লঙ্ঘন ও মহান মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করে তিনি রাষ্ট্রদ্রোহ অপরাধ করেছেন। একজন রণাঙ্গনের বীর মুক্তিযোদ্ধাকে অবমাননা করে তিনি সমগ্র বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অবমাননা করেছেন বলে আমরা মনে করি।”
এই বক্তব্যের একরামুল করিম চৌধুরীকে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে জাতির কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাওয়ার দাবি জানান তিনি।
সমাবেশে সংহতি জানিয়ে ‘অপরাজেয় বাংলা’ সংগঠনের সদস্য-সচিব এইচ রহমান মিলু বলেন, “ওবায়দুল কাদের একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, তার সময়ের অনেক মুক্তিযোদ্ধা আজকে জীবিত। তিনি ছিলেন সম্মুখ সারির যোদ্ধা। তিনি এই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের রাজনীতি করেছেন। দলের জন্য তার ত্যাগ আমরা কাছ থেকে দেখেছি। স্বৈরাচার ও বিএনপি- জামাতের বিরুদ্ধে লড়েছেন।
“সেই লোককে আপনি কীভাবে রাজাকারের বংশধর বললেন? দলের একজন সাধারণ সম্পাদককে, একজন মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকারের পরিবার বলে আখ্যায়িত করে শুধু তাকেই ছোট করা হয়নি, বাংলাদেশের সকল মুক্তিযোদ্ধাকে অপমান করা হয়েছে।”
সমাবেশে অন্যদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ মঞ্চের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি সনেট মাহমুদ, কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক শুভ্র মাহমুদ, ঢাকা মহানগর উত্তর শাখার সাধারণ সম্পাদক দ্বীন ইসলাম বাপ্পী, বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক রেদোয়ানুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।