অমিত শাহর বক্তব্যে ‘গলদ’, প্রতিবাদ বিএনপির

বাংলাদেশে বিএনপির আমলে সংখ্যালঘু নির্যাতন হয়েছে বলে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দেওয়া বক্তব্যের প্রতিবাদ জানিয়েছেন দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 Dec 2019, 11:40 AM
Updated : 10 Dec 2019, 06:21 PM

মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন, বিএনপি নয়, আওয়ামী লীগ আমলে এখানে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন হয়েছে।

বিএনপি সরকারে থাকাকালে সংখ্যালঘুদের ‘স্বার্থরক্ষা’ হয়েছে বলেও দাবি করেছেন তিনি।  

পরে রাতে বিএনপির স্থায়ী কমিটির বৈঠকেও এ বিষয়ে আলোচনা এবং অমিত শাহর বক্তব্যের নিন্দা জানানো হয়।

সোমবার ভারতের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ লোকসভায় বহুল আলোচিত নাগরিকত্ব বিল পাস হয়, যাতে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান থেকে শরণার্থী হিসেবে যাওয়া অমুসলিমদের ভারতের নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ তৈরি হয়েছে।

পার্লামেন্টে মুসলিম সদস্যরা এই বিলের বিরোধিতা করলে যুক্তি খণ্ডন করে বক্তব্য দেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দল বিজেপির সভাপতি অমিত শাহ।

সেখানে তিনি বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের জন্য বিএনপির প্রতি অভিযোগ তুলেছেন বলে জানান মির্জা ফখরুল।

তিনি বলেন, “আপনারা শুনেছেন, গতকাল পার্লামেন্টে অমিত শাহ যে বক্তৃতা করেছেন সেখানে বিএনপির নাম করে কথা বলেছেন কিছু, যে বিএনপি সরকারের আমলে এখানে সংখ্যালঘুদের উপরে নির্যাতন হয়েছে। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

“আমরা খুব জোর গলায় বলতে পারি, বিএনপি সরকারের আমলে এখানে সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষা করা হয়েছে। তাদের ওপর নির্যাতন আওয়ামী সরকারের আমলে যতটা হয়েছে, আর কখনও সেটা হয়নি।”

ভারতের নাগরিকত্ব আইন নিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আপনারা জানেন যে, ভারতে নতুন যে নাগরিকত্ব আইন করা হয়েছে সেই আইনে খুব পরিষ্কার করে তারা বলছে, পার্লামেন্টে (লোকসভা) পর্যন্ত বলেছেন, বাংলাদেশ থেকে একদম এভাবে বলা হচ্ছে যে, মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা যাচ্ছে ভারতবর্ষে এবং তাদের অবৈধ অভিবাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে।

“পার্লামেন্টে (লোকসভা) যে আইন পাস করা হয়েছে সেই আইনের মধ্যে অমুসলিম যারা তাদেরকে নাগরিকত্ব দেওয়া হবে ৫ বছর না কত বছর গ্যাপ দিয়ে। কিন্তু মুসলিম যারা আছেন তাদেরকে দেওয়া হবে না।”

স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নিন্দা

রাতে গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে দলের জাতীয় স্থায়ী কমিটির বৈঠকের পর মির্জা ফখরুল বলেন, “ভারতের নাগরিকত্ব আইন লোকসভা ও আজকে বোধহয় রাজ্যসভায় পাস হয়ে গেল। ভারতের আইন নিয়ে আমাদের খুব বেশি কথা বলার কথা না। এটা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। কিন্তু তাদের কোনো বক্তব্য, দায়িত্বশীল নেতার বক্তব্য যদি আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে সমস্যা তৈরি করে তাহলে নিঃসন্দেহে সেই সম্পর্কে কথা বলাটা আমরা দায়িত্ব মনে করি। আজকে আমাদের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে এই বিষয়টি আলোচনা হয়েছে।

“আমরা এই ধরনের মন্তব্যে বিশেষ করে ভারতীয় জনতা পার্টির প্রেসিডেন্ট অমিত শাহ যিনি দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছেন, তার মন্তব্যে আমরা শুধু উদ্বিগ্নই নই, আমরা অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ, আমরা…। এজন্যই যে, আমরা কেউ কখনো আশা করতে পারিনি যে, তাদের দেশের এরকম দায়িত্বশীল নেতা এবং যারা এই অঞ্চলে বেশ প্রভাব নিয়ে আছেন, তাদের কাছ থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি নিয়ে যখন দায়িত্বহীন মন্তব্য আসে, সেটাকে আমাদের কোনো মতেই মেনে নেওয়া সম্ভব হয় না। সে কারণে আমরা অমিত শাহের বক্তব্যের নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছি।”

বিএনপি মহাসচিব বলেন, “আমরা মনে করি যে, এই ধরনের কোনো রাজনৈতিক দলকে ভিন্ন দেশ বা অন্য দেশে সুনির্দিষ্ট করে দোষারোপ করা থেকে তারা বিরত থাকবেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজকে তিনি (অমিত শাহ) যে মন্তব্য করেছেন যেটাতে আমাদেরকে দোষারোপ করা হয়েছে সাম্প্রদায়িক সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তার প্রশ্নে। যেটা একেবারে ভিত্তিহীন।

“ড. আবুল বারাকাত সাহেবের যে রিপোর্ট সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপরে যেটা বেরিয়েছে গত ১০ বছরে। তাতে করে উনি পরিষ্কার করে রিপোর্টে বলেছেন যে, শতকরা ৭০ ভাগ যদি কেউ দখল করে থাকে সেটা আওয়ামী লীগের হাতে আছে। ইতিহাস তাই বলে যে, একাত্তর সালের পর থেকে এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর যত অত্যাচার-নির্যাতন-নিপীড়ন হয়েছে এবং তাদের সম্পত্তি যে বেদখল কিছু হয়ে থাকে তা সম্পূর্ণভাবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যাবে যে, তা আওয়ামী লীগের দ্বারাই হয়েছে।”

এ প্রসঙ্গে আলোচনায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সমালোচনা করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তিনি বলেন, “অমিত শাহর বক্তব্যের সঙ্গে সঙ্গে ওবায়দুল কাদের সাহেবও হঠাৎ করেই আজকে বিএনপিকে সম্প্রদায়িক দল বলে আখ্যা দিয়েছেন। আমি এটার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।”

বিএনপি কখনই সাম্প্রদায়িক দল ছিল না দাবি করে তার পক্ষে যুক্তি হিসেবে ১৯৯২ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালে ভারতে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর বাংলাদেশে দাঙ্গা না ছড়ানোর কথা বলেন তিনি।

মির্জা ফখরুল বলেন, “আজকে এদেশের জনগণ যে ধারণা নেবে যে, অমিত শাহের এই উক্তি সুনির্দিষ্ট করে একটি রাজনৈতিক দলকে সমর্থন দিচ্ছে কি না সেটা নিয়ে প্রশ্ন এসে যায়। এই বিষয়গুলো…।

“আমি আগেও বলেছি, এখনও বলছি- ভারত আমাদের বন্ধু দেশ। আমরা সব সময় যেটা আশা করি, ভারতের নেতৃত্ব যে দলেরই আসুক, সরকার যে দলেরই আসুক তাদের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভালো থাকবে, সুন্দর থাকবে, জনগণের সাথে সম্পর্ক সুন্দর থাকবে। কিন্তু এমন কোনো কাজ, এমন কোনো কথা বা উক্তি করাটা ঠিক হবে না যেটা এই দুই দেশের সম্প্রীতিকে বিনষ্ট করবে। জনগণের সাথে জনগণের সম্পর্কে বিনষ্ট করবে এ রকম কোনো উক্তি কারোরই করা উচিত হবে না।”

সংবাদ সম্মেলনে রোহিঙ্গা সংকট ‍নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকার সমালোচনাও করেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

তিনি বলেন, “মিয়ানমার যারা এখানে রোহিঙ্গাদেরকে ঠেলে পাঠিয়ে দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের সরকারের পক্ষ থেকে মানবাধিকার লংঘনের কথা বলা হচ্ছে। মিয়ানমারে মানবাধিকার লংঘন, গণহত্যার বিষয়ে বাংলাদেশ সরকার সোচ্চার হয়ে এখন পর্যন্ত বিশ্ব সংস্থায় অথবা আন্তর্জাতিক আদালতে কোনো কথা বলছেন না। আন্তর্জাতিক আদালতে গাম্বিয়া মামলা করেছে, সেখানে বাংলাদেশ সরকারের কোনো ভূমিকা নেই।”

নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স, মানবাধিকার বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান আসাদ, স্বেচ্ছাসেবক বিষয়ক সম্পাদক মীর সরফত আলী সপু, কেন্দ্রীয় নেতা আবদুস সালাম আজাদ, আনিসুর রহমান তালুকদার খোকন, মহিলা দলের সুলতানা আহমেদ, শ্রমিক দলের আনোয়ার হোসেইন, তাঁতী দলের আবুল কালাম আজাদ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

আর রাতে দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে স্কাইপে যুক্ত হয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সভাপতিত্ব করেন। স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, জমিরউদ্দিন সরকার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সেলিমা রহমান ও ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।