সমালোচনার মুখে মেননের ব্যাখ্যা

একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে বক্তব্যের জন্য সমালোচনার মুখে এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন আওয়ামী লীগের জোট শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 Oct 2019, 11:11 AM
Updated : 20 Oct 2019, 07:08 PM

তিনি দাবি করেছেন, শনিবার বরিশালের অনুষ্ঠানে তার দেওয়া বক্তব্য গণমাধ্যমে খণ্ডিতভাবে গণমাধ্যমে আসায় সবার কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে।

একাদশ সংসদ নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে মেননের ওই বক্তব্য নিয়ে রোববার বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে ছিল তুমুল আলোচনা। সরব ছিল ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমও।

মেননের ওই বক্তব্যকে ভোট নিয়ে নিজেদের অভিযোগের প্রমাণ হিসেবে দেখিয়েছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা কামাল হোসেন। বিএনপি নেতা রুহুল কবির রিজভী আওয়ামী লীগ জোটের এই নেতাকে বলেছেন ‘রাজসাক্ষী’।

অন্যদিকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোটের মুখপাত্র মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতির দায়িত্বহীন ওই বক্তব্যের সঙ্গে জোটের কোনো সম্পর্ক নেই।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, মন্ত্রিত্ব না পাওয়ার বেদনা থেকে মেনন ওই বক্তব্য দিতে পারেন।

বাম দল ওয়ার্কার্স পার্টি গত এক যুগ ধরে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ১৪ দলীয় জোটে রয়েছে। জোটের প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে গত তিনটি নির্বাচনে বিজয়ী হন মেনন। এক দফায় মন্ত্রীও ছিলেন তিনি।

শনিবার নিজের জেলা বরিশালে ওয়ার্কার্স পার্টির এক সভায় মেনন বলেন, “আমিও নির্বাচিত হয়েছি। তারপরও আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, ওই নির্বাচনে জনগণ ভোট দিতে পারেনি। এমনকি পরবর্তীতে উপজেলা এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনেও ভোট দিতে পারেনি দেশের মানুষ।”

একাদশ সংসদ নির্বাচন ভোট ডাকাতি হয়েছে দাবি করে তার ফল প্রত্যাখ্যান করেছিল বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। ফলে মেননের বক্তব্যে তারা খুশি হয়েছিল।

ওই বক্তব্যের ব্যাখ্যায় মেনন বিবৃতিতে বলেন, “বরিশাল জেলা পার্টির সম্মেলনে আমার একটি বক্তব্য সম্পর্কে জাতীয় রাজনীতি ও ১৪ দলের রাজনীতিতে একটা ভুল বার্তা গেছে। আমার বক্তব্য সম্পূর্ণ উপস্থাপন না করে অংশ বিশেষ উত্থাপন করায় এই বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে।”

তিনি বলেন, “আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, এ যাবতকালের নির্বাচন ১৪ দলের সংগ্রামেরই ফসল এবং সরকারও গঠিত হয়েছে ১৪ দলের লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে। আজকে মৌলবাদ-সাম্প্রদায়িকতার যে বিপদ বিদ্যমান তাকে মোকাবেলা করতে ১৪ দলের ওই সংগ্রামকেই এগিয়ে নিতে হবে।”

বরিশালের সভায় রাশেদ খান মেনন

এর আগে জাতীয় সংসদে রাষ্ট্রপতির ভাষণের উপর দেওয়া বক্তব্যেও একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে কথা বলেছিলেন বলে বিবৃতিতে উল্লেখ করেন মেনন।

ওই বক্তব্য উদ্ধৃত করে বিবৃতিতে বলা হয়, “একাদশ সংসদের সফল নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু অভিজ্ঞতাটি সুখকর নয়। বিএনপি-জামাত নির্বাচনে আসলেও নির্বাচনকে ভণ্ডুল করা, নিদেন পক্ষে জাতীয় আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ করার কৌশল প্রয়োগ করেছে নির্বাচনে। ... এটা যেমন সত্য তেমনি এ ধরনের পরিস্থিতিতে অতি উৎসাহী প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বাড়াবাড়ি করতে পারে। কিন্তু তাতে এই নির্বাচন অশুদ্ধ বা অবৈধ হয়ে যায় না।”

মেনন বলেন, “বক্তৃতায় আমি বলেছি, স্বাধীনতা উত্তরকাল থেকে এ যাবত জিয়া-এরশাদ-বিএনপি-জামাত আমলের ধারাবাহিক অনিয়ম অব্যবস্থাপনা ও ক্ষমতার অপব্যবহার ঘটেছে। বিভিন্ন সময় আমি প্রার্থী হিসেবে এ সকল ঘটনার সাক্ষী।

“আমি বলেছি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে মিলে ভোটাধিকার ও ভোটের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে আমরা যে লড়াই করেছি তা যেন বৃথা না যায়, সেজন্য নির্বাচনকে যথাযথ মর্যাদায় ফিরিয়ে আনতে হবে।”

বিরোধীরা খুশি

মেননের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় কামাল হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, “দেরিতে হলেও উনি (মেনন) এটা করেছেন। আমি খুশি।”

গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটাররা ভোট দিতে পারেননি বলে অভিযোগ করে আসছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।

ফ্রন্টের শীর্ষনেতা কামাল বলেন, “আমি তো এই কথাটি বার বার বলে যাচ্ছি যে, আপনারা কেউ কি ৩০ ডিসেম্বর ভোট দিয়েছিলেন? আমি এই পর্যন্ত একজনের কাছ থেকে পাইনি যে ‘হ্যাঁ’ দিয়েছেন।

“এখন উনিও (রাশেদ খান মেনন) কনফার্ম করলেন। এজন্য আমি উনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।”

বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্মমহাসচিব রুহুল কবির রিজভী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “সত্যের ঢোল বাতাসে বাজে, অপর্কম করেও কখনো কখনো বিবেকের তাড়নায় সত্য প্রকাশ করতে বাধ্য হয় মানুষ।

রুহুল কবির রিজভী

“নিশি রাতের দুর্নীতিবাজ সরকারের বিশ্বস্ত সঙ্গী কমরেড ছিলেন রাশেদ খান মেনন। জাতির সামনে রাজসাক্ষী হয়ে রাতের ভোটের স্বীকারোক্তি প্রদানের মাধ্যমে নিজের দায় ও অপরাধ তিনি স্বীকার করে নিলেন।”

রিজভী বলেন, “এই বক্তব্যের পর নৈতিকতা ও বাস্তবতার দিক দিয়ে সরকারের উচিৎ সংসদ ভেঙে দেওয়া। কিন্তু সেই বিবেকটি সরকারের নাই, থাকলে এত বড় অনাচার, এত বড় ডাকাতি করতে পারত না ২৯ ডিসেম্বর রাতে।

“সংসদ বহাল থাকার নৈতিক অধিকার তাদের নেই। যেহেতু তারা জনগণের ভোটে নির্বাচিত নন। বর্তমান সরকারেরও যদি বিন্দুমাত্র লজ্জা থাকে, তাহলে আজকেই তাদের পদত্যাগ করে সরে যাওয়া উচিৎ।”

জবাব চাইবে ১৪ দল

এই বক্তব্যের জন্য ১৪ দলের পক্ষ থেকে মেননের কাছে জবাব চাওয়া হবে বলে জানিয়েছেন জোটের মুখপাত্র ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মোহাম্মদ নাসিম।

ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতির বক্তব্যকে দুঃখজনক আখ্যায়িত করে তিনি সিরাজগঞ্জে সাংবাদিকদের বলেন, “রাশেদ খান মেনন একজন প্রবীণ রাজনীতিবিদ। তার কাছ থেকে আমরা সব সময় দায়িত্ববোধ থেকে বক্তব্য আশা করি।

“জনগণ ভোট দিয়ে সরকার প্রতিষ্ঠার এক বছর পর তিনি কেন এ কথা বললেন, এর জবার ১৪ দলের মিটিং ডেকে তার কাছ থেকে নেওয়া হবে।”

“জনগণ ভোট দিয়েছেন বলেই রাশেদ খান মেনন নির্বাচিত এমপি হয়েছেন। তার এই বক্তব্য অত্যন্ত দুঃখজনক এবং আমরা বিস্মিত হয়েছি,” বলেন নাসিম।

এদিকে সচিবালয়ে সমসাময়িক বিষয় নিয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নে মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, “তিনি যদি বলেই থাকেন, আমার প্রশ্ন হচ্ছে এতদিন পরে কেন? এই সময়ে কেন? নির্বাচনটা তো অনেক আগে হয়ে গেছে।

“আরেক প্রশ্ন সবিনয়ে- মন্ত্রী হলে কি তিনি এ কথা বলতেন? আর কোনো কিছু বলতে চাই না।”

ক্যাসিনোকাণ্ডের পর একটি ক্লাবের সঙ্গে মেননের সম্পৃক্ততার কথা ওঠার ক্ষোভে তিনি এসব কথা বলছেন কি না- জানতে চাইলে কাদের বলেন, “এটি তাকে জিজ্ঞাসা করলে ভাল হয়, তিনি কেন ক্যাসিনোকাণ্ডের পর এ কথা বললেন, ইলেকশনের পর কেন বললেন না।”