নির্বাচনের পূর্বশর্ত খালেদার মুক্তি: বিএনপি

আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেওয়ার জন্য অনেকগুলো ‘শর্ত’ তুলে ধরেছে বিএনপি; এর প্রথমটি হল দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 July 2018, 01:46 PM
Updated : 20 July 2018, 04:06 PM

দীর্ঘ আড়াই বছর পর শুক্রবার ঢাকার নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এক সমাবেশ থেকে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই শর্ত তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, “আমরা খুব স্পষ্ট দাবি বলে দিয়েছি, বাংলাদেশে নির্বাচন করতে হলে অবশ্যই এক নম্বর পূর্বশর্ত হচ্ছে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিতে হবে। তাকে কারাগারে রেখে কোনো নির্বাচন হবে না এবং এদেশের মানুষ তা হতে দেবে না।”

বিএনপির দাবিগুলো তুলে ধরে ফখরুল বলেন, “আমরা বলছি এই সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে, আমরা বলেছি সংসদ ভেঙে দিতে হবে এবং নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন করতে হবে। আমরা বলেছি যে, নির্বাচনের সময়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন করতে হবে।”

এসব দাবির ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলতে সব রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবীদের প্রতি আহ্বান জানান বিএনপি মহাসচিব।

নির্বাচনের আগে সিপিবি, বাসদ, গণসংহতি আন্দোলনসহ আটটি বাম দল মিলে নতুন জোট গঠন করায় তাদের অভিনন্দন জানান ছাত্রজীবনে বাম রাজনীতি করে আসা ফখরুল।

তিনি বলেন, “আজকে আনন্দের কথা। আমি অভিনন্দন জানাতে চাই, আটটি বাম রাজনৈতিক দলকে, তারা মোর্চা গঠন করেছে। জনগণের এই ইস্যুগুলোকে তারা দাবি হিসেবে সামনে নিয়ে এসেছে।

“একইভাবে আমি আশা করব অন্য রাজনৈতিক দলগুলো নিজ নিজ জায়গা থেকে একত্রিত হবেন, জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করবেন এবং এই দুঃশাসন থেকে মুক্তি পাবার জন্য একটা জাতীয় ঐক্য গড়ে তুলবেন। যার মধ্য দিয়ে আমরা এদের পরাজিত করতে পারব এবং জনগণের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারব।”

খালেদা জিয়ার ‘মুক্তি ও সুচিকিৎসার’ ব্যবস্থা করার দাবিতেই দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে এই সমাবেশ করে বিএনপি।

সর্বশেষ ২০১৬ সালের ৫ জানুয়ারি দলটি নয়া পল্টনে সমাবেশ করেছিল; সেখানে প্রধান অতিথি ছিলেন দলের চেয়ারপারসন খালেদা।

এতিমখানা ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলায় পাঁচ বছরের সাজার রায়ের পর গত ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে খালেদা জিয়াকে রাখা হয়েছে নাজিমউদ্দিন রোডের পুরাতন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে।

সেখানে তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন দাবি করে তাকে মুক্তি দিয়ে ঢাকার বেসরকারি একটি হাসপাতালে চিকিৎসার ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়ে আসছেন বিএনপি নেতারা।

আদালতের সাজায় খালেদা জিয়া কারাগারে যাওয়ার পর বিএনপি সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও নয়া পল্টনে সমাবেশ করার জন্য বেশ কয়েকবার অনুমতি চেয়েও ব্যর্থ হয়। শুক্রবার বিএনপিকে সমাবেশের জন্য ২৩টি শর্ত দেওয়া হয় ঢাকা মহানগর পুলিশের পক্ষ থেকে।

এ সমাবেশ ঘিরে সকাল থেকেই নয়া পল্টনে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নেতা-কর্মীদের আনাগোনা শুরু হয়। খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবি সম্বলিত বিশাল দুটি ডিজিটাল ব্যানার টানানো হয় কার্যালয়ের সামনে।

তবে পুলিশের শর্তের কারণে নেতাকর্মীরা সমাবেশে আসতে শুরু করেন দুপুরে জুমার নামাজের পর। বেলা আড়াইটার দিকে নেতা-কর্মীরা ফকিরাপুল থেকে কাকরাইলের নাইটিঙ্গেল মোড় পর্যন্ত সড়কের দুই ধারে অবস্থান নিলে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

এ সময় ‘আমরা নেত্রী, আমার মা, বন্দি থাকতে দেব না’, ‘খালেদা জিয়াকে বন্দি রেখে নির্বাচন হতে দেয়া হবে না’- ইত্যাদি শ্লোগান দিতে থাকেন নেতা-কর্মীরা। সমাবেশ শুরুর পরপরই শুরু হয় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি।

সমাবেশে উপস্থিত নেতাকর্মীদের উদ্দেশে ফখরুল বলেন, “আমাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সাহেব, যিনি নির্যাতিত হয়েছেন এবং নির্বাসিত হয়ে আছেন, তিনি আপনাদেরকে অভিনন্দন জানিয়েছেন এই সমাবেশের জন্য। আপনারা সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে এসেছেন। এই ধারা অটুট রাখবেন।”

জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলন গড়ে তোলার প্রত্যয় জানিয়ে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “এরপরে যে কোনো কর্মসূচিতে এভাবে ঐক্যবদ্ধ হয়ে অংশ গ্রহণ করবেন, সেটাই হবে আমাদের মুক্তির পথ।”

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির পর ভল্টের সোনা নিয়ে অভিযোগের প্রসঙ্গে টেনে ফখরুল বলেন, সরকার দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে একটি ‘নৈরাজ্য’ তৈরি করেছে।

“বিনিয়োগ নেই, কর্মসংস্থান নেই, মানুষ চাকরি পাচ্ছে না। গার্মেন্টস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। অর্থনীতি চরম দুরবস্থার মধ্যে পড়েছে।”

মাদকবিরোধী অভিযানের নামে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যা ও বিরোধীদলের নেতা-কর্মীদের নিপীড়ন-গুম’ চলছে অভিযোগ করে এই বিএনপি নেতা বলেন, “একটা ভয় ও ত্রাসের রাজত্ব তৈরি করেছে তারা। দেশের প্রত্যেকটি মানুষ অনিরাপদ। তারা জানে না কখন তাদের মৃত্যু হবে। তারা স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চায়।”

ক্ষমতাসীনদের উদ্দেশে ফখরুল বলেন, “আপনার সকল দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন করবেন না, কারণ জানেন, সকল দল অংশগ্রহণ করলে, বিএনপি যদি অংশগ্রহণ করে, তাহলে আপনারা ২০টা আসনও পাবেন না।”

আর এই ‘ভয়’ থেকেই সরকার খালেদা জিয়াকে ‘কারাগারে’ আটকে রেখেছে বলে অভিযোগ করেন ফখরুল।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন সমাবেশে বলেন, “এই সরকার স্বৈরাচারী সরকার। সোজা আঙ্গুলে ঘি উঠবে না। আমাদের বিশ্বাস, সকল জাতীয় শক্তি ঐক্যবদ্ধ হয়ে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, বিএনপি জনগণকে সাথে নিয়ে রাস্তায় থাকবে। ইনশাল্লাহ এই সরকারের পতন ঘটবে।”

স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য মওদুদ আহমদ বলেন, “আগামীকাল সরকারি দল সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জনসভা করবে। সরকারি খরচে সরকারি আমলারা এই জনসভার ব্যবস্থা করবেন। দেখাবেন বিশাল জনসভা।

“আমাদের এখানে আজকে যে জনসমাগম হয়েছে… তারা যদি সত্যিকার অর্থে সরকারি ক্ষমতা ব্যবহার না করে, তাহলে এর চেয়ে কম লোকের সমাগম সেখানে হবে। কিন্তু দেখানো হবে খুব বড় সমাবেশ।”

অর্থপূর্ণ নির্বাচন করতে চাইলে ‘সব দলের জন্য সমান সুযোগ’ সৃষ্টির দাবি জানান এই বিএনপি নেতা।

স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, “আমাদের একটাই উদ্দেশ্য, দেশনেত্রীর মুক্তি চাই, তাকে নিয়েই আমরা নির্বাচনে যাব। কেউ যদি মনে করেন ফাঁকা মাঠে গোল দেবেন- সেই আশা করবেন না।”

মির্জা ফখরুলের সভাপতিত্বে এ সমাবেশে অন্যদের মধ্যে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, আবদুল মঈন খান, ভাইস চেয়ারম্যান এজেডএম জাহিদ হোসেন, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আমানউল্লাহ আমান, আবুল খায়ের ভুঁইয়া, জয়নুল আবদিন ফারুক, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, ঢাকা মহানগর দক্ষিণের কাজী আবুল বাশার, আহসানউল্লাহ হাসান, যুবদলের মোরতাজুল করীম বাদরু, নুরুল ইসলাম নয়ন, এসএম জাহাঙ্গীর হোসেন,রফিকুল ইসলাম মজনু, স্বেচ্ছাসেবক দলের শফিউল বারী বাবু, আবদুর কাদের ভুঁইয়া জুয়েল, শ্রমিক দলের নুরুল ইসলাম খান নাসিম, জাসাসের হেলাল খান, ছাত্রদলের রাজীব আহসান, আকরামুল হাসান, এজমল হোসেন পাইলট বক্তব্য রাখেন।

অন্যদের মধ্যে আবদুল আউয়াল মিন্টু,নিতাই রায় চৌধুরী, মসিউর রহমান, জহিরুল হক শাহাজাদা মিয়া,  মাসুদ আহমেদ তালুকদার, সালাহউদ্দিন আহমেদ, আফরোজা আব্বাস, আসাদুল হাবিব দুলু, শামা ওবায়েদ, এম এ মালেক, শিরিন সুলতানা, হাবিবুল ইসলাম হাবিব, মীর সরফত আলী সপু, সেলিম ভুঁইয়া, আমিনুল হক, মোস্তাফিজুর রহমান বাবুল, নাজিমউদ্দিন আলম, আবদুস সালাম আজাদ, শামীমুর রহমান শামীম,আমিরুল ইসলাম আলিম,তাইফুল ইসলাম টিপু, বেলাল আহমেদ, তকদির হোসেন জসিম, নীলুফার চৌধুরী মনি, শায়রুল কবির খানসহ কেন্দ্রীয় ও অঙ্গসংগঠনের নেতারা সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন।