‘শেষ ট্রেনের যাত্রী’ সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত

দেশের প্রায় সব সংসদে যার প্রতিনিধিত্ব ছিল, প্রথম সংবিধান প্রণয়ন এবং পরে দফায় দফায় পরিবর্তিত সংবিধানকে ৭২ এর চেহারায় ফিরিয়ে আনতে যার ছিল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, সেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের শেষ বয়সের স্বল্পমেয়াদী মন্ত্রিত্বের অভিজ্ঞতা পরিণত হয়েছিল তিক্ততায়।

জ‌্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 5 Feb 2017, 12:22 PM
Updated : 6 Feb 2017, 07:50 AM

ষাটের দশকে স্বাধিকারের দাবিতে উত্তাল বাংলাদেশে বাম ধারার রাজনীতিতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের পদার্পণ। দুই দশক আগে আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার আগ পর্যন্ত একাত্তরের রণাঙ্গনের এই মুক্তিযোদ্ধা পরিচিত ছিলেন ‘ছোট দলের বড় নেতা’ হিসেবে।

স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি সাতবার জাতীয় সংসদে সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। মৃত‌্যুর সময় ছিলেন আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি। 

সংবিধান নিয়ে অভিজ্ঞতা আর রাজনৈতিক বিশ্লেষণে দক্ষতার কারণে বাকপটু সুরঞ্জিত দায়িত্বপূর্ণ পদের বাইরে থেকেও সংবাদের শিরোনামে থেকেছেন দীর্ঘ সময়।    

তবে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে তার গুরুত্ব কোথায় ছিল, তা স্পষ্ট হয়েছে রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানের শোকবার্তায়, ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের কথায়।    

রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সংসদীয় রাজনীতিতে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতাকে বলেছেন ‘অতুলনীয়’। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, তার মৃত্যুতে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ একজন অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান হারালো, আর আওয়ামী লীগ হারালো সকল প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রামের একজন অগ্র সেনানীকে।

আর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, তার বিবেচনায়, সুরঞ্জিত ছিলেন পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে ‘নাম্বার ওয়ান’।

ঢাকার ল‌্যাবএইড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রোববার ভোর রাত ৪টা ১০ মিনিটে মারা যান আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস‌্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত।

তাকে শেষবার দেখতে সকালে তার জিগাতলার বাসায় জড়ো হন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। কথায় কথায় তারা ফিরিয়ে আনেন নানা স্মৃতি।

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের চেয়ে বয়সে ছোট হলেও সত্তরের প্রাদেশিক পরিষদে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত রাজনীতি শুরু করেছিলেন মুহিতের অনেক আগে।

সুরঞ্জিত যে সময় প্রথম সাংসদ হয়েছিলেন, সেই সময়ের রাজনীতিবিদদের মধ‌্যে কেবল তোফায়েল আহমদ ও রাষ্ট্রপতি হামিদ এখনও দৃশ‌্যপটে আছেন বলে জানান মুহিত। 

তিনি বলেন, “পার্লামেন্ট হ্যাজ লস্ট এ গ্রেট পার্লামেন্টারিয়ান। এ গ্রেট লস। সে আপাদমস্তক পলিটিশিয়ান ছিল। সংসদে দাঁড়ালেই হত।”

সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের নিজের দেওয়া তথ‌্য অনুযায়ী, তার জন্ম ১৯৩৯ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি, সুনামগঞ্জের দিরাই উপজেলার আনোয়ারাপুরে। অবশ‌্য তার পাসপোর্টে জন্ম সাল ১৯৪৫ এবং জাতীয় সংসদে থাকা সাংসদদের জীবন বৃত্তান্তে ১৯৪৬ সালের কথা লেখা হয়েছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে স্নাতকোত্তর করে ঢাকা সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে আইনে ডিগ্রি নেন সুরঞ্জিত। পরে কিছুদিন আইন পেশায় যুক্তও ছিলেন।

ছাত্রজীবনে ছাত্র ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত সুরঞ্জিত ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের নির্বাচনে ন্যাপ থেকে জয়ী হয়ে আলোচনার জন্ম দেন। একাত্তরে তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন ৫ নম্বর সেক্টরের সাব কমান্ডার হিসেবে।

সুরঞ্জিত ১৯৭৯ সালের সংসদে ছিলেন একতা পার্টির প্রতিনিধি হয়ে। ১৯৯১ সালের সংসদে গণতন্ত্রী পার্টি থেকে নির্বাচিত হন তিনি।

ছোট দলের বড় নেতা হিসেবে রাজনৈতিক অঙ্গনে পরিচিত সুরঞ্জিত আওয়ামী লীগে যোগ দেওয়ার পর ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে হেরে গিয়েছিলেন। পরে অবশ্য অন্য আসনে উপনির্বাচনে বিজয়ী হন তিনি। এরপর অষ্টম, নবম ও দশম সংসদেও তিনি নির্বাচিত হন।

দেশের প্রথম সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য সুরঞ্জিত ছিলেন নবম সংসদে পঞ্চদশ সংবিধান সংশোধন কমিটির কো-চেয়ারম্যান। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্ব দিয়েছিলেন।

২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপিতে সংস্কারের প্রস্তাব তোলাদের দলে সুরঞ্জিতও ছিলেন।

নির্বাচনের পর হাসিনার ‘সংস্কারপন্থি’ হিসেবে পরিচিত অন‌্যদের মত সুরঞ্জিতকেও মন্ত্রিসভার বাইরে রাখা হয়। পরে দলের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকেও বাদ পড়েন সুরঞ্জিতের মতো ‘সংস্কারপন্থী’ নেতারা, তাদের কয়েকজনের স্থান হয় ‘ক্ষমতাহীন’ উপদেষ্টা পরিষদে।

জরুরি অবস্থার সময় ভূমিকা নিয়ে দলে ‘কোনঠাসা’ হওয়ার প্রেক্ষাপটে গণমাধ্যমে সাবলীল এই বর্ষীয়ান এই রাজনীতিককে এটাও বলতে দেখা যায়, ‘বাঘে ধরলে ছাড়ে, শেখ হাসিনা ধরলে ছাড়ে না’।

সরকারের তিন বছর পেরিয়ে যাওয়ার পর ২০১১ সালে সুরঞ্জিতের মন্ত্রিসভায় স্থান হয়। বয়স ৬৫ পার হওয়ার পর পান নবগঠিত রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। দায়িত্ব নেওয়ার পর তিনি বলেছিলেন, “আমি শেষ ট্রেনের যাত্রী।”

বাকপটু সুরঞ্জিত দেশের প্রথম রেলমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার পরই রেল বিভাগকে দুর্নীতিমুক্ত করার সংকল্প জানিয়ে বলেছিলেন, রেলের ‘কালো বিড়ালটি’ খুঁজে বের করতে চাই। কিন্তু পাঁচমাসের মাথায় এপিএসের গাড়িতে বিপুল অর্থ পাওয়া গেলে তিনি চাপে পড়ে যান।

সহকারীর অর্থ কেলেঙ্কারির দায় মাথায় নিয়ে তিনি পদত্যাগ করলেও তা গ্রহণ না করে সে সময় তাকে দপ্তরবিহীন মন্ত্রী হিসাবে রাখেন শেখ হাসিনা।

দশম সংসদে নির্বাচিত হওয়ার পর সুরঞ্জিতকে আর মন্ত্রিত্বে ফেরানো হয়নি। তবে আলোচনা সভায় সমসাময়িক বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে সরস মন্তব‌্যের কারণে তিনি সংবাদ শিরোনামে এসেছেন নিয়মিতভাবে। মৃত‌্যুর এক সপ্তাহ আগেও জাতীয় সংসদে বক্তৃতা দিয়েছেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরীর দেখায় সুরঞ্জিত ছিলেন ‘ব‌্যতিক্রমধর্মী প্রখর যুক্তিবোধ ও হাস‌্যরসে পরিপূর্ণ’ একজন মানুষ।

“তিনি অনুকরণীয়। বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অধ‌্যায়কে আমরা হারালাম।”

দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে বিভিন্ন সময়ে সংসদের সার্বভৌমত্ব প্রশ্নে অনঢ় অবস্থানে দেখা গেছে সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে। এ নিয়ে আদালতের সঙ্গেও বাহাসে জড়াতে দেখা গেছে দীর্ঘদিনের এই আইন প্রণেতাকে।  

সে কথা স্মরণ করে ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, “পার্লামেন্টের সার্বভৌমত্বে কেউ যদি আঘাত করার চেষ্টা করত, তাহলে উনি মন্ত্রী থাকা অবস্থাতেও তার প্রতিবাদ করতেন।”

চার ভাই ও এক বোনের মধ্যে সুরঞ্জিত ছিলেন সবার ছোট। তিন ভাই আগেই মারা গেছেন; একমাত্র বোন কলকাতায় বসবাস করছেন।

সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের স্ত্রী জয়া সেনগুপ্ত একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন। সৌমেন সেনগুপ্ত তাদের একমাত্র সন্তান।