রবীন্দ্রনাথ সরেন— লড়াইয়ের মাঠে দেদীপ্যমান

রবীনদা বহুমত্রিক সাংগঠনিক দক্ষতার অধিকারী একজন নেতা এবং একই সঙ্গে মাঠের কর্মী। আদিবাসী অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে শেকড় ও শিখরের সমন্বয় ঘটাতে তিনি সফলতার পরিচয় দিয়েছিলেন।

দীপায়ন খীসাদীপায়ন খীসা
Published : 16 Jan 2024, 01:27 PM
Updated : 16 Jan 2024, 01:40 PM

রবীন্দ্রনাথ সরেন। আমাদের সবার প্রিয় রবীনদা। তিনি প্রয়াত হযেছেন ১২ জানুয়ারি গভীর রাতে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে নিজের গ্রামের বাড়িতে।  রবীন্দ্রনাথ সরেন জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ-সভাপতি ছিলেন। বরেন্দ্র অঞ্চলসহ দেশের আদিবাসী জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য আমৃত্যু লড়েছেন সম্মুখসারিতে থেকে। জন্মেছিলেন ১৯৫৭ সালের ১৩ ডিসেম্বর পার্বতীপুরের বারকোনা গ্রামে।

বরেন্দ্র ভূমির আদিবাসী মানুষের চিরায়ত দ্রোহের রক্তের নাচন রবীনদার ধমনিতেও প্রবাহিত হয়েছে। তাই তো তিনি দীক্ষা নিয়েছেন মানব মুক্তির মন্ত্রে। তারপর উত্তরাঞ্চলের আদিবাসী জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে নিজেকে সমর্পিত করেছেন। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের পতাকাতলে নিজে যুক্ত হয়েছেন । সেই সঙ্গে উত্তরবঙ্গের আদিবাসীদের সংগঠিত করছেন। 

আমার সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ সরেনের যোগাযোগ এই শতাব্দীতে। একটু দেরিতে যোগাযোগ স্থাপিত হলেও রবীনদার সঙ্গে বরেন্দ্রভূমির মাঠেঘাটে আদিবাসী জনপদে হেঁটেছি দীর্ঘ সময়।  রবীনদার সবচেয়ে বড়গুণ তিনি চারণ ছিলেন। কিছুদিন রাজশাহীতে বসবাস করলেও আবার পার্বতীপুরের নিজ ভিটেতেই ফিরে গেছেন।

নগর-মহানগর তাকে টানেনি। কিন্তু তিনি জাতীয় নেতা। আদিবাসী জনগণের লড়াই সংগ্রামের প্রতিনিধিত্ব করেন তাদের মধ্যে যে কয়জনকে জাতীয় নেতা বলা যায় রবীন্দ্রনাথ সরেন তাদের একজন। মাঠে ময়দানের সঙ্গে জাতীয় পর্যায়ের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন তিনি।

দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে এশিয়া এনার্জির উন্মুক্ত কয়লাখনির বিরুদ্ধে ২০০৬ সালের ২৬ অগাস্টের আগুনঝরানো প্রতিরোধ মিছিলে রবীনদা আদিবাসীদের নিয়ে যোগ দিয়েছিলেন।  সেই মিছিলে ছোট যমুনার পূর্ব পার্শ্বে পৌঁছলে  পুলিশ ও তৎকালীন বিডিআর গুলি চালায়।  ঘটনাস্থলেই ৩ জন মারা যান।  কর্মসূচিতে যারা ঢাকা থেকে যোগ দিয়েছিলেন সেই দলটি ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ঢাকার মূল দলটির সঙ্গে আমার যোগযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় অচেনা জায়গায় সেই অস্বাভাবিক পরিস্থিতে আমি বেশ অনিরাপদ বোধ করতে থাকি। হঠাৎ রবীনদার কথা স্মরণে আসে। রবীনদাকে ফোন দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঢাকা মোড়ে চলে যেতে বললেন। শুনশান ফুলবাড়ীতে রবীনদা আমার ভরসা হয়ে উঠলেন। তারপর ঢাকা মোড়ে দাদার সঙ্গে দেখা। আমাকে ঢাকাগামী ট্রেনে তুলে দিয়ে তিনি বাড়ির পথ ধরলেন। এভাবেই রবীনদার কাছাকাছি আসা।

মহাদেবপুরের নাটশাল মাঠে কারাম উৎসবে প্রথমবারের মত শরিক হয়েছিলাম রবীনদার আমন্ত্রণে। নওগাঁর পোরশার প্রান্তিক সাঁওতাল জনপদেও রবীনদার সঙ্গে যাওয়া। সেখান থেকে মিছিল নিয়ে উপজেলা শহরে আসা।  রবীনদার ডাকে ঢাকা থেকে সাংবদিক নিয়ে উত্তরঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে আদিবাসীদের নিপীড়ন নির্যাতনের তথ্য সংগ্রহ করা। এই সব নানান কাজে রবীনদার সাথী ছিলাম।

গাইবান্ধার সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার আন্দোলনকে রবীন্দ্রনাথ সরেন যেভাবে সংগঠিত করেছিলেন তা সত্যিই প্রশংসনীয়। দীর্ঘদিন একটানা যুক্ত থেকে বাগদা ফার্মের আন্দোলনকে একটা জাতীয় চরিত্রের রূপ দিতে রবীনদা নির্ভীক ও নিরলস খেটেছিলেন।

জীবনাবসানের বছর খানেক আগ থেকেই রবীনদার শরীর ভালো যাচ্ছিল না। উচ্চ ডায়াবেটিস, কিডনির সমস্যায় তিনি বেশ ভুগছিলেন। পায়ের দুটি আঙুলও কেটে ফেলতে হয়েছিল। হাসপাতালে হাসপাতালে তিনি জীবন কাটাচ্ছিলেন। কিন্তু যখনই একটু ভালো বোধ করেছেন সঙ্গে সঙ্গে ছুটেছেন। শরীরের রুগ্নতাকে কঠিন মনোবল দিয়ে বশ করে অধিকার আদায়ের কঠোর সংগ্রামে সক্রিয় থেকেছেন ররীন্দ্রনাথ সরেন। অসুস্থ শরীর নিয়েও তার প্রিয় সংগঠন জাতীয় আদিবাসী পরিষদকে অভিভাবকের দায়িত্বে আগলে রেখে নানান ঘাত প্রতিঘাত সামলে নিয়েছিলেন।

জাতীয় আদিবাসী পরিষদকে উত্তরবঙ্গের সীমানা ছাড়িয়ে দক্ষিণ বঙ্গের খুলনা, সাতক্ষীরা পর্যন্ত বিস্তৃত করেছেন তিনি। যখন বাড়িতে বসে শরীরের যত্ন নেওয়ার কথা, সেই সময় তিনি সাংগঠনিক কর্মসূচি ঘোষণা করে জাতীয় আদিবাসী পরিষদকে নিয়ে রাজপথে নেমে গেলেন ৯ দফা দাবি নিয়ে। বিশ্রামে না থেকে আবার মাঠঘাট চষে বেড়াতে লাগলেন রবীন্দ্রনাথ সরেন। এখানেই রবীনদা অনন্য এবং সম্পূর্ণ ব্যাতিক্রমধর্মী। তার এই অফুরান প্রাণশক্তি দেখে আমি নিজেও অনেক সময় অবাক হয়েছি। নিজেকে অনেকবার প্রশ্ন করেছি। কিভাবে রবীনদা এসব সম্ভব করে চলেছেন

রবীন্দ্রনাথ সরেন নিজেকে শুধুমাত্র বরেন্দ্র ভূমির আদিবাসীদের মাঝে আটকে রাখেননি। তিনি সমগ্র দেশের আদিবাসীদের সংগ্রামের একজন পুরোধা হয়ে উঠেছিলেন। বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের নেতৃস্থানীয় দায়িত্ব পালন করেছেন। সর্বশেষ সম্মেলনে বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। দেশের সব প্রান্তের আদিবাসীদের নেতা হিসেবে নিজেকে বিকশিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ সরেন।

আদিবাসীদের মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠন কাপেং ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন ছিলেন তিনি। আন্তর্জাতিক পরিসরেও রবীনদার পরিচিত বেশ ব্যাপক ছিল। তিনি বেশ কয়েকটি আদিবাসী বিষয়ক আন্তর্জাতিক সেমিনারে বাংলাদেশের আদিবাসীদের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।

সবকিছু পরেও রবীনদার মূল পরিচয় তিনি রাজনৈতিক কর্মী। তার বিচরণ গ্রামীণ জনপদে। পাহাড়ের জুমিয়া মানুষের পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নের যে সংগ্রাম সেই লড়াইয়েও তিনি তার কণ্ঠকে সোচ্চার রেখেছিলেন। জুম পাহাড়ের মানুষদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামের একজন অকৃত্রিম লড়াকু সহযোদ্ধা ছিলেন তিনি। পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির সভাপতি ও  বাংলাদেশের আদিবাসী  জনগণের অবিসংবাদিত নেতা জ্যোতিরিন্দ্র বোধিপ্রিয় সন্তু লারমার নিকটজন ছিলেন রবীন্দ্রনাথ সরেন।

রবীনদা বহুমত্রিক সাংগঠনিক দক্ষতার অধিকারী একজন নেতা এবং একই সঙ্গে মাঠের কর্মী। আদিবাসী অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে শেকড় ও শিখরের সমন্বয় ঘটাতে তিনি সফলতার পরিচয় দিয়েছিলেন।

রবীনদার সঙ্গে সর্বশেষ সাক্ষাৎ ২০২৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ঢাকার শাহবাগে। জাতীয় আদিবাসী পরিষদের ৩ দশক উপলক্ষে আয়োজিত সমাবেশে। গেল বছর ২০২৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বরের পর রবীনদার সঙ্গে আর দেখা হয়নি। সেই সমাবেশের পর নওগাঁতে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। রবীন্দ্রনাথ সরেন পুনরায় সভাপতি নির্বচিত হলেন।

তিনি চিকিৎসার জন্য ভারতে গেলেন। যাওয়ার আগে ফোনে আলাপ। ফেরার পরও ওই ফোনেই কথোপকথন। আমি ধরে নিয়েছিলাম তিনি আগের চেয়ে একটু শারীরিক জটিলতা কাটাতে সক্ষম হযেছেন। ধীরে ধীরে সেরে উঠছেন। ২০২৩ সালের ডিসেম্বরে রবীনদা ঢাকার বেশ কয়েকটি কর্মসূচিতে সাবলীলভাবে অংশ নিয়েছিলেন।

কিন্তু ২০২৪ সালের প্রথম দিনেই আমরা শুনি রবীনদা দিনাজপুরের জিয়া হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতালে আইসিউতে লাইফ সাপোর্টে আছেন। আমরা উদ্বিগ্ন হলাম। দিনাজপুরের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে চেষ্টা করলাম। জানুয়ারি ৪ তারিখে রবীনদা অবস্থার উন্নতি ঘটেছে বলে জানলাম। একটু উন্নতি হলে তিনি নিজ বাড়িতে ফিরে গেলেন। ৮ জানুয়ারি রবীনদা তার বাড়ির উঠোনে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছেন— এই রকম একটি ছবি রবীনদার ছেলে মানিক সরেন ফেসবুকের নিউজফিডে পোস্ট করল। আমরা যারা রবীনদাকে নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলাম, সেই তারা একটু আশ্বস্ত হলম।

ধরেই নিয়েছিলাম বিপদ কেটে গেছে। কিন্তু ৩-৪ দিন গত হতে না হতেই আমাদের জন্য চরম দুঃসংবাদ। ১২ জানুয়ারির গভীর রাতে দিনাজপুরের পার্বতীপুরের নিজ গ্রামের বাড়িতে রবীনদার জীবনাবসান ঘটে হঠাৎই।

এই দুসংবাদটি নিয়ে ১৩ জানুয়ারির দিনটি শুরু হয়। আমরা হতভম্ব হয়ে পড়ি। কিন্তু তখন আমাদের প্রিয় রবীনদা নিথর ও নীরব। মাত্র ৬৫ সছর বয়সে চিরকালের জন্য থেমে গেলেন রবীন্দ্রনাথ সরেন। আদিবাসী জনগণের লড়াই সংগ্রামের অন্যতম এই নেতার হঠাৎ মৃত্যু একটি বিরাট ক্ষতি তাতে সন্দেহ নেই। রবীনদা আগাগোড়া রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি মার্কসীয় সমাজবিজ্ঞানের পাঠ নিয়েছেন।

মার্কসীয় জীবন দর্শনকে জীবনের সঙ্গে আত্মস্থ করার অনুশীলন করেছেন। আদিবাসী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি লড়েছেন নির্লোভ ও  নির্মোহভাবে। একটি সমর্পিত জীবন তিনি আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন। তার এই অকস্মাৎ  প্রয়াণে উত্তরবঙ্গের আদিবাসী আন্দোলন একজন অবিভাবককে হারাল। রবীন্দ্রনাথ সরেনের যাপিত জীবন তরুণ আদিবাসী প্রজন্মের জন্য অনুকরণীয় হয়ে উঠুক। শূনত্যা কাটিয়ে নব প্রজন্ম রবীনদার ফেলে যাওয়া সংগ্রামকে এগিয়ে নিক। সারাদেশের অগণিত আদিবাসী যুবার ধমনিতে রবীনদার হার না মানা জীবন সংগ্রাম নতুনভাবে প্রবাহিত হোক। লড়াইয়ের মাঠে, মুষ্টিবদ্ধ হাতের গগণবিদারী শ্লোগানে, বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রান্তিক জনপদের অন্দরে অন্দরে, ভূমিহারা আদিবাসী মানুষের দ্রোহী মননে, বিক্ষোভে বিক্ষোভে পথ চলতে চলতে অগণিত সংগ্রামীদের মাঝে কমরেড রবীন্দ্রনাথ সরেন চেতনার মশাল হয়ে দেদীপ্যমান থাকবেন। প্রিয় অগ্রজ রবীনদা, তোমায় লাল লাল লাল সালাম।