লন্ডনে বাংলাদেশের প্রথম দূতাবাস

নবাব উদ্দিন
Published : 24 Dec 2021, 05:34 PM
Updated : 24 Dec 2021, 05:34 PM

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের রয়েছে গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। মার্চ থেকে ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে বিশ্ব বিবেককে জাগিয়ে দিতে বিলেতের বাঙালিরা কাটিয়েছিলেন নির্ঘুম সময়। আন্তর্জাতিক সমর্থন ছাড়া কোনো জাতির মুক্তির জন্য যুদ্ধ সফল হয় না। মুক্তিকামী প্রবাসী বাঙালিরা তাদের অব্যাহত প্রচারণার মাধ্যমে যুক্তরাজ্যকেও যুদ্ধের ময়দানে সামিল করেন। লন্ডনের ট্রাফলগার স্কয়ারের জনসভায় হাজার হাজার মানুষের অংশগ্রহণ বিশ্ববাসীর দৃষ্টি বাংলাদেশের দিকে ফেরাতে বাধ্য করে। ব্রিটেন থেকেই যুদ্ধের জন্য অস্ত্র কিনতে কিংবা শরণার্থীদের সহায়তায় অর্থ প্রেরণ করা হয়। 

এভাবে যুদ্ধের নয় মাস নিদ্রাহীন চোখে প্রবাসী বাঙালিরা স্বাধীনতার যুদ্ধকে তরান্বিত করতে ঝাঁপিয়ে পড়েন সর্বস্ব নিয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল সময়ে যুক্তরাজ্যের বাঙালিদের উদ্যমী তৎপরতা নিয়ে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, আবদুল মতিন, মহিউদ্দিন আহমদ, মাহমুদ এ রউফ, ইউসুফ চৌধুরী, খন্দকার মোশাররফ হোসেনসহ অনেকেই প্রামাণ্যগ্রন্থ লিখেছেন। এসব বইয়ের পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে মুক্তিযুদ্ধে যুক্তরাজ্য প্রবাসীদের অনন্য অসাধারণ ভূমিকার কথা। নিজ চোখে দেখা ইতিহাসের বর্ণনায় উল্লেখিত লেখকরা লন্ডনে বাংলাদেশের প্রথম মিশন এবং ঐতিহাসিক বাংলাদেশ সেন্টারের প্রসঙ্গ গুরুত্বের সাথে তুলে ধরেছেন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর অবদান সোনার হরফে লিখে রাখার মতো। তিনি যেমন মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট ছিলেন তেমনি যুক্তরাজ্যে নানান দলমতে বিভক্ত বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তিনি মুক্তিসংগ্রামের জন্য প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক কাঠামোও গড়ে তুলেছিলেন। প্রত্যয় আর ঐক্যের মন্ত্রে তিনি উজ্জীবিত করেছিলেন, যুক্তরাজ্য, ইউরোপ ও আমেরিকার প্রবাসী বাঙালিদের। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে ১৭ জুন যুক্তরাজ্যে স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তার কূটনৈতিক পরিচয়পত্রে এই দিন স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। বিচারপতি চৌধুরীর পরিচয়পত্র ব্রিটেনের রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের সরকারি বাসভবন বাকিংহাম প্যালেসে পেশ করা হয়। বাকিংহাম প্যালেস এই পরিচয়পত্রের প্রাপ্তিস্বীকার করে। এই প্রাপ্তিস্বীকার চিঠির মাধ্যমে প্রকান্তরে বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাজ্যের সমর্থন প্রকাশ পায়।

স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হলেন এখন প্রয়োজন নিজস্ব কূটনৈতিক মিশন। এক্ষেত্রেও বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর ভূমিকা অগ্রগণ্য। তারই উদ্যোগে ১৯৭১ সালের ২৭ অগাস্ট লন্ডনে বাংলাদেশের প্রথম দূতাবাস স্থাপন করা হয়। এর ফলে বিচারপতির সমগ্র কর্মধারা একটি প্রাতিষ্ঠানিক ও প্রতিনিধিত্বমূলক অবকাঠামো লাভ করে। উল্লেখ্য ৭১ সালের ১৮ এপ্রিল ভারতের কলকাতার সার্কাস অ্যাভিনিউয়ে আধুনিক বাংলাদেশের প্রথম কূটনৈতিক মিশন স্থাপন করা হয়েছিল এবং তখনকার পাকিস্তানি ডেপুটি হাই কমিশনার এম হোসেইন আলী এবং মিশনের অন্যান্য বাঙালি কর্মীরা পাকিস্তান দূতাবাসের সাথে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশর অস্থায়ী সরকারের কাছে অনুগত্য প্রকাশ করেন। আর বর্হিবিশ্বে দ্বিতীয় মিশনটিই হচ্ছে সেন্ট্রাল লন্ডনের নটিংহিল গেইটের ২৪ পেমব্রিজ গার্ডেন ভবন।

১৯৭১ সালে বিলেতে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে কার্যক্রম সেন্ট্রাল লন্ডনের গোরিং স্ট্রিটের অফিস থেকে পরিচালিত হতো। কিন্তু অফিসটির ছোট পরিসর এই বৃহৎ কর্মযজ্ঞের জন্য যথেষ্ট ছিলো না। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বিভিন্ন মিটিং, বিদেশি দূতাবাস কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎসহ গুরুত্বপূর্ণ কর্মকাণ্ড গোরিং স্ট্রিটের অফিস থেকে আয়োজন করা জটিলসাধ্য হয়ে উঠেছিল। তাই বিচারপতি চৌধুরী দূতাবাস ও মিশনের জন্য আরও বড় পরিসরে অফিসের সন্ধান করছিলেন।

ওই সময়ে যুক্তরাজ্যে বাঙালি দ্বারা পরিচালিত বেশ কয়েকটি সংগঠন ও সমিতি ছিল। এতদসত্বেও ১৯৭১ সালে 'অ্যাকশন বাংলাদেশ' নামের একটি সংগঠন কেবল শ্বেতাঙ্গদের সমন্বয়ে গঠিত হয়। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী অ্যাকশন বাংলাদেশ- এর প্রধান ছিলেন পল কনেট। এই সংগঠনের ব্যানারে পয়লা অগাস্ট ট্রাফলগার স্কয়ারে বিরাট জনসমাবেশের আয়োজন করা হয়। সমাবেশস্থলটি লোকারণ্যে পরিণত হয়, মানুষের ভীড়ে কোথাও তিলমাত্র জায়গা অবশিষ্ট ছিলো না। ট্রাফলগার স্কয়ারের সন্নিকটে ন্যাশনাল আর্ট গ্যালারির বারান্দাগুলোও গমগম করছিলো বিলেতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থনে সবচেয়ে বড় এই সমাবেশে।

মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট এবং রাজনৈতিক কারণে মুজিবনগর সরকার লন্ডনে একটি দূতাবাস স্থাপনের প্রয়োজনীয়তা গভীরভাবে অনুভব করেছিল। বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে লেখা এক চিঠিতে লন্ডনে দূতাবাস স্থাপনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস দেন। আর এ বাস্তবতাকে সামনে রেখে মুজিবনগর সরকারের অনুমতি নিয়েই পয়লা অগাস্ট 'অ্যাকশন বাংলাদেশ' আয়োজিত ট্রাফলগার স্কোয়ারের জনসমাবেশে লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাস স্থাপনের প্রথম আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন বিচারপতি চৌধুরী।

ট্রাফলগার স্কয়ার ঘোষণার পর দূতাবাস স্থাপনে লন্ডনে বিভিন্ন এলাকায় যখন অফিস খোঁজা হচ্ছিল তখন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক জাকারিয়া খান চৌধুরী লন্ডনের নটিংহিল গেইটের ২৪ পেমব্রিজ গার্ডেন ভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোর এবং বেইসমেন্টে রুম পাওয়ার সম্ভাবনার কথা বিচারপতি চৌধুরীকে জানান।

আন্তর্জাতিক চ্যারিটি সংস্থা ওয়ার অন ওয়ান্ট এর চেয়ারম্যান ডনাল্ড চেমওয়ার্থ বাঙালি কমিউনিটির কাছে ছিলেন অত্যন্ত পরিচিতজন এবং তিনি ছিলেন যুদ্ধদিনে বাঙালির প্রকৃত বন্ধু, স্বজন। ২৪ পেমব্রিজ গার্ডেনে তখন টক-এইচ নামে একটি ইন্টারন্যাশনাল হোস্টেল ছিল। আর সে হোস্টেলের ওয়ার্ডেন ছিলেন ডনাল্ড চেমওয়ার্থ। আগে থেকেই চেমওয়ার্থের সঙ্গে পরিচয় ছিল বিচারপতি চৌধুরীর। এই পরিচয়টি ২৪ পেমব্রিজ গার্ডেন নিয়ে আলোচনার পথ সহজ করে দিয়েছিল।

মুক্তিযুদ্ধের দুই সংগঠক শেখ আবদুল মান্নান ও জাকারিয়া চৌধুরীকে সঙ্গে নিয়ে একদিন চেসওয়ার্থের সঙ্গে দেখা করেন বিচারপতি চৌধুরী। ওই সময়ে তিনি দূতাবাস হিসেবে পেমব্রিজ গার্ডেনের নিচতলা বা গ্রাউন্ডফ্লোর ভাড়া নেওয়ার প্রস্তাব দেন।

বাঙালির সুহৃদ ডনাল্ড চেমওয়ার্থ সানন্দচিত্তে প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন এবং ভবনের মালিক টক-এইচ এর কাছ থেকে নামমাত্র ১০০ পাউন্ড ভাড়ায় গ্রাউন্ড ফ্লোরে দূতাবাস স্থাপনের ব্যবস্থা করে দেন।

তখনকার দিনে সেন্ট্রাল লন্ডনে বাংলাদেশের দূতাবাসের জন্য কোনো ভবন পাওয়া ছিল অনেক চ্যালেঞ্জিং। কেননা ওই সময়ে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি বাংলাদেশ।

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তার 'প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি' বইয়ে বিষয়টি সম্পর্কে লিখেন,

আমি যখন মনে মনে এই সব চিন্তা পোষণ করছি, তখন দু'টি ঘটনা ঘটল। ওয়ার অন ওয়ান্ট- এর চেয়ারম্যান ডনাল্ড চেজওয়ার্থ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ থেকেই নানাভাবে সাহায্য করে আসছিলেন। তিনি ভারতে বাঙালী শরণার্থীদের সাহায্যের ব্যবহার জন্য ওয়ার অন ওয়ান্ট এর পক্ষ থেকে কয়েক বার কলকাতায় যান। এবং প্রত্যেকবারই বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। চেজওয়ার্থ তিন সদস্য বিশিষ্ট বাংলাদেশ ফান্ডের ট্রাস্টিও ছিলেন। তাঁকে একদিন বাংলাদেশ দূতাবাস সম্পর্কে আমার সমস্যার কথা বলি।

চেজওয়ার্থ একটি বৃটিশ ট্রাস্ট কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক হোস্টেলের ওয়ার্ডেন রূপে কাজ করছিলেন। এই হোস্টেলের নিচের তলায় বেশ প্রশস্ত কয়েকটি কক্ষ ছিল। এই বাড়ীটি চব্বিশ নম্বর পেমব্রিজ গার্ডেনস-এ অবস্থিত। পেমব্রিজ গার্ডেন ওয়েস্ট এন্ডে বেশ ভাল জায়গা। আন্ডার গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে মাত্র দুই মিনিটের পথ। তিনি গ্রাউন্ড ফ্লোরের কক্ষগুলো আমাদের দূতাবাসের জন্য ভাড়া দিতে সম্মত হলেন। ভাড়াটা নাম মাত্র। ট্রাস্ট প্রপার্টি ভাড়া না নিয়ে অন্যকে দেয়া চলে না। আমরা একটি মহৎ সংগ্রামে লিপ্ত, তাই ট্রাস্টের কর্মকর্তাগণ নামমাত্র ভাড়ায় থাকতে দিতে রাজী হলেন। আমরা একশ' পাউন্ড ভাড়া দিয়ে রুমগুলো নিই। এই কক্ষগুলো যিনি দেখেছেন তিনি স্বীকার করেছেন যে, ভাড়াতো নয়, এমনিতেই আমাদের দেয়া হয়েছে।

জুলাই মাসের শেষের দিকে একজন বাঙালী যুবক আমাকে একা পেয়ে জহুরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করতে অনুরোধ করেন। এই যুবকটি বাঙালী হলেও ইতিপূর্বে আমাদের সঙ্গে কোন যোগাযোগ করেননি। শেখ আবদুল মান্নান এবং আরো দু'একজন ঘনিষ্ঠ সহকর্মীকে একথা বলায় তাঁরা এভাবে সাক্ষাতের ঘোরতর আপত্তি করেন। তখন আমি যুবকটিকে বললাম, আজ খুবই ব্যস্ত, পরে দেখা যাবে। তিনি চলে গেলেন। কর্মব্যস্ততার মাঝে কথাটা আমিও ভুলে গেলাম। এর পাঁচ ছ'দিন পর মোশাররফ হোসেন জোয়ারদার আমাকে এসে বললেন জহুরুল ইসলাম লুইসহ্যাম হাসপাতালে আছেন। তাঁর কোন অসুখ নেই। তিনি অসুখের কথা বলে পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষের অনুমতিক্রমে লন্ডনে এসেছেন। তিনি আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাচ্ছেন। আমি সেদিনই জোয়ারদারের গাড়ীতে হাসপাতালে যাই। জহুরুল ইসলামের সঙ্গে সেটাই আমার প্রথম দেখা।

মোশাররফ হোসেন জোয়ারদার আমাকে পরিচয় করিয়ে দেবার পর আমরা এমনভাবে আলাপ-আলোচনা করলাম যেন অনেকদিন থেকেই পরস্পর পরিচিত। তিনি তাঁর দুর্দশার কথা বললেন। ঢাকার রমনা প্রেসিডেন্ট ভবনে (পরে গণভবন) তাঁকে নিয়ে গিয়েছিল পাকিস্তানী সৈন্যরা। সেখানে তাঁকে দেয়ালের সঙ্গে দাঁড় করিয়ে গুলী করার ভয় দেখায়। এমন সময় তাঁর একজন পাঞ্জাবী বন্ধু খবর পেয়ে আসে এবং অনুনয়-বিনয় করে তাঁকে সেদিনকার মতো মুক্ত করে আনে। সেই বন্ধুরই সাহায্যে তিনি লন্ডনে চিকিৎসার জন্য আসার অনুমতি পেয়েছেন। বুঝলাম তিনি শংকিত এবং দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত ঢাকায় ফিরবেন না। তিনি বললেন যে, তিনি মুজিবনগর, বিশেষ করে তাজউদ্দিন সাহেবের কাছ থেকে আমাদেরকে অর্থ সাহায্য করার অনুরোধ পেয়েছেন। তিনি নিজেও স্বাধীনতা আন্দোলনে সাহায্য করতে চান। আমি তখন তাঁকে বলি যে, বাংলাদেশ ফান্ড নামে আমরা একটি ফান্ড করেছি মূলতঃ স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রয়োজনে অস্ত্র কিনে প্রেরণ করতে ও স্টিয়ারিং কমিটির খরচ চালাতে। সেই ফান্ড থেকে অন্য কোন খরচ করা বাঙালীদের বা আমার ব্যক্তিগত মত নয়। কিন্তু আমাদের দূতাবাস করার প্রয়োজন রয়েছে। তাঁকে আরো বলি যে, দেখা গেছে বেতন এবং অন্যান্য খরচ বাবদ প্রতিমাসে দু'থেকে আড়াই হাজার পাউন্ডের মতো লাগবে। পরে আরো কূটনীতিবিদ যোগ দিলে বেশী লাগতে পারে। এই দূতাবাসের খরচ যদি তিনি চালিয়ে নেন তাহলে আমি নিশ্চিন্ত মনে কূটনৈতিক কাজ সুচারুরূপে করতে পারি। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন যে, আমার এস্টিমেট অনুযায়ী তিনি যদি দু-তিন বছরের টাকা একসঙ্গে দিয়ে দেন তাতে আমি সন্তুষ্ট হব কিনা। আমি উত্তর দিলাম যে, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তিনি যদি আমাদের দূতাবাসের মাসিক খরচ প্রতি মাসে দেন তাহলেই ভাল হয়। তিনি এককথায় রাজী হয়ে বললেন যে, প্রতিমাসে তিনি মোশাররফ হোসেন জোয়ারদারের মাধ্যমে তাঁর দেয়া অর্থ পাঠিয়ে দেবেন। তবে সেটা অন্য কারো নামে জমা করে নিতে হবে। অন্যথায় পাকিস্তানীরা কোনভাবে এ খবর পেলে ঢাকায় অবস্থানরত তাঁর স্ত্রী ও সন্তানদের জীবন বিপন্ন হতে পারে। তখনই আমরা তিনজনে মিলে একটি নাম ঠিক করলাম। প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে মোশাররফ হোসেন জোয়ারদার সুবিদ আলি নামে একজন রোগীর পক্ষ থেকে দূতাবাসের খরচ বাবদ প্রয়োজনীয় অর্থ দিয়ে আসবেন। যতদূর মনে পড়ে মাসিক আড়াই হাজার পাউন্ড দেয়ার কথা ধার্য হয়। এর মাত্র কয়েক মাস পরেই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়। তারপর আর তাঁকে দিতে হয়নি। অথচ তিনি দু'তিন বছরের খরচ এক সঙ্গে দিতে চেয়েছিলেন। একেই বলে ভাগ্য।

দূতাবাসের ফিনান্স ডিরেক্টর লুৎফর মতিন এই পাউন্ড গ্রহণ করে সুবিদ আলীর নামে যথারীতি রশিদ দিতেন। এই অর্থ দিয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসের নামে অন্য একাউন্ট খোলা হয়। দূতাবাসের খরচ এই একাউন্ট থেকে চলত। এই একাউন্টের সঙ্গে 'বাংলাদেশ ফান্ডের' কোন সম্বন্ধ ছিল না। দূতাবাস একাউন্ট পরিচালনা করেছে। তদানীস্তন ফিনান্স ডিরেক্টর লুৎফুল মতিন বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব।

জহুরুল ইসলাম সেদিন এক পর্যায়ে নিজে থেকেই আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, 'স্যার আপনার খরচ চলে কি করে ?' আমি উত্তর দিলাম, ন্যাশনাল ওয়েস্ট মিনিস্টার ব্যাংকে ১৯৪৬ সাল থেকে আমার একটি একাউন্ট আছে। এই পুরনো সম্বন্ধ এবং একজন বন্ধু গ্যারান্টার হওয়াতে ওভারড্রাফট-এর ব্যবস্থা করেছি। অবশ্য বর্তমান পরিস্থিতিতে আমার ব্যক্তিগত খরচ খুবই কমিয়ে রেখেছি। তাছাড়া আমার পরিবার আমার সঙ্গে জেনেভায় আসাতে স্টেট ব্যাংকের অনুমোদন নিয়ে কিছু অর্থ বেশী আনতে পেরেছিলাম। তিনি বললেন, 'আমি আপনার জন্য জোয়ারদারের মাধ্যমে এককালীন তিন হাজার পাউন্ড পাঠিয়ে দেব।' আমি বললাম, 'অশেষ ধন্যবাদ। আমি সেই অর্থ গ্রহণ করব এই শর্তে যে, দেশ স্বাধীন হলে সেই সময়কার সরকারী বিনিময় হার অনুসারে আমি এই টাকা পরিশোধ করব, আর আপনি গ্রহণ করবেন। আর যদি দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত বেঁচে না থাকি আপনি কোন দাবী রাখবেন না। তবে যখনই সম্ভব হবে আমার পরিবার এটা শোধ করে দেবে।' এই তিন হাজার পাউন্ড শেষ হওয়ার আগেই দেশ স্বাধীন হয়ে যায়।

দেশ স্বাধীন হবার পর জহুরুল ইসলামকে তখনকার বিনিময় হারে তিন হাজার পাউন্ডের সমপরিমাণ বাংলাদেশী টাকা সোনালী ব্যাংকের মারফত আমার নিজের একাউন্ট থেকে চেক দ্বারা পরিশোধ করেছি। এই ঋণ গ্রহণের কথা প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবকে জানিয়ে ছিলাম এবং তাঁর জ্ঞাতসারেই পরিশোধ করেছি।

এভাবে স্থান এবং খরচের ব্যবস্থা হয়ে যাওয়ায় সাতাশে আগস্ট ২৪ নম্বর পেমব্রিজ গার্ডেনস–এ বাংলাদেশ দূতাবাস উদ্বোধন করা হয়। ভারত ছাড়া এটিই বিশ্বে বাংলাদেশের প্রথম দূতাবাস। মুজিবনগর সরকার এই বিষয়টিকে খুবই গুরুত্ব প্রদান করেন। অবিশ্যি এগার নম্বর গোরিং স্ট্রীটে আমাদের কার্যালয় মে মাসে স্থাপিত হয়।''

১৯৭১ সালের ২৭শে অগাস্ট প্রায় তিন শরও বেশি প্রবাসী বাঙালি ও দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী দূতাবাসের সামনে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। দূতাবাস উদ্বোধনের খবর সাপ্তাহিক জনমত, লন্ডন টাইমসসহ বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় প্রকাশিত হয়।

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। প্রধান বক্তা ছিলেন পিটার শোর এমপি, জন স্টোনহাউজ এমপি, সাংবাদিক অ্যান্থনি মাসকারেনহাস এবং সায়মন ড্রিং।

অনুষ্ঠানে যারা দূতাবাসের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন তারা হলেন- মহিউদ্দিন আহমেদ, লুৎফুল মতিন, শিল্পী আবদুল রউপ, মহিউদ্দিন চৌধুরী, আবদুস সালাম, একেএম নূরুল হুদা ও ফজলুল হক চৌধুরী।

প্রবাসী বাঙালির মধ্যে উপস্থিত ছিলেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন, জাকারিয়া খান চৌধুরী, শেখ আবদুল মান্নান, হাবিবুর রহমান, শামসুল আলম চৌধুরী, গউস খানসহ কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ।

লন্ডনে দূতাবাস স্থাপনের পর স্বাভাবিক কারণেই বিচারপতি চৌধুরী আন্দোলনের কাজ ভাগ করে দেন। ১১ নং গোরিং স্ট্রিটে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে যে সব সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতো সেগুলো সেখান থেকেই চালাবার সিদ্ধান্ত হয়। আরও সিদ্ধান্ত হলো যে, ২৪ পেমব্রিজ গার্ডেনে কর্মরত দূতাবাসের অফিসারবৃন্দ বিভিন্ন সরকারের নিকট চিঠিপত্রের আদান প্রদান এবং ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রাখবেন। তাছাড়া কোনো বিদেশি কূটনৈতিক বিচারপতি চৌধুরীর সাথে দেখা করতে চাইলে তাদেরকে নতুন এ অফিসে আসতে বলা হতো।

দূতাবাসটি যখন ভাড়া নেওয়া হয় সেখানে কোনো ধরনের আসবাবপত্র ছিল না। কক্ষগুলো হোস্টেলের বিভিন্ন রুম হিসেবে ব্যবহৃত হতো। তাই সিদ্ধান্ত হল পুরাতন আসবাবপত্র দিয়ে অফিস কক্ষগুলো সাজানো হবে।

অফিস সাজানোর এই বিপুল কর্মযজ্ঞে দূতাবাসের কর্মকর্তা এবং কমিউনিটি নেতৃবৃ প্রচুর পরিশ্রম করেন। এমনকি ব্রিটিশ এমপি জন স্টোনহাউসের দশ-বারো বছরের ছেলে মেথিউ এবং মেয়ে জেইন স্টোনহাউস অফিস সাজানোর কাজে সহায়তা করেন। এছাড়াও নারী নেত্রী লুলু বিলকিস বানুর মেয়েরাও এ ব্যাপারে বেশ পরিশ্রম করেন।

লন্ডনে বাংলাদেশ দূতাবাস কেবল একটি অফিস প্রতিষ্ঠাই ছিল না, বিশ্বের দরবারে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্তিত্বের জানান দেওয়া এবং আত্মপ্রকাশের গর্বিত বার্তাও ছিল। এই দূতাবাস স্থাপন বিদেশি কূটনৈতিক মহলে ইতিবাচক প্রক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল। পাশাপাশি প্রবাসী বাঙালিদের করেছিল উদ্দীপ্ত এবং অনুপ্রাণিত।

বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানী বিচারপতি চৌধুরীর কাছে লিখিতপত্রে লন্ডনে দূতাবাস স্থাপনের জন্য অভিনন্দন জানান এবং দূতাবাসের সফলতা কামনা করেন। উল্লেখ্য স্বাধীনতার পর বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ঢাকায় ফিরে যান এবং ১৯৭২ সালের ১২ জানুয়ারি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন।

১৯৭২ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ বিষয়ক সেক্রেটারি অব স্টেইট স্যার অ্যালেক ডকলাস হোম হাউজ অব কমন্সে ঘোষণা করেন যে, ব্রিটিশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

পরে ওই দিন ২৪ পেমব্রিজ গার্ডেনে টক-এইচ ভবন থেকে আবারও আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। আর সেদিন থেকেই ভারতের বাইরে প্রথম বাংলাদেশ হাই কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়।

১৯৭৩ সালের এপ্রিলের দিকে হাই কমিশন অফিস ২৪ পেমব্রিজ গার্ডেন থেকে কেনসিংটনের ২৮ কুইন্স গেইটের নিজস্ব ভবনে স্থানান্তরিত করা হয়। ওই ভবনটি ক্রয়ে প্রবাসীরাও আর্থিকভাবে সহায়তা করেন বলে উল্লেখ করেছেন হাফিজ মজির উদ্দিন, শেখ আবদুল মান্নান ও শামসুল আলম চৌধুরী।

বাংলাদেশের জন্মক্ষণে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনকারী ২৪ পেমব্রিজ গার্ডেন ভবনটি এখন ঐতিহাসিক বাংলাদেশ সেন্টার হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।

তথ্যসূত্র :

১. An Experiment in Nottinghill : By Steve Smith

২. One hundred years of Toc H

৩. সাপ্তাহিক জনমত (১৯৭২), লন্ডন

৪. John Stonehouse : My father

৫. The Times (Newspaper) London

৬. প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি : আবু সাঈদ চৌধুরী

৭. মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসীদের অবদান : ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন

৮. স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালি : আবদুল মতিন