ঢাকার আদি বাসিন্দাদের গালি দেওয়ার স্বভাব অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। তারা নাকি বাপের নামের আগেও 'শ্যালক' সম্বোধন যোগ করে। আর নিজের প্রসঙ্গে বলতে হলেও বলে 'আমি..'। পুরানো ঢাকার গালির ভাণ্ডার অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও রসপূর্ণ। সেই পুরান ঢাকার মেয়ে হয়েও আমি গালি শিখতে পারিনি আমার সতর্ক মায়ের কারণে। তিনি সব সময় খেয়াল রাখতেন যেন তার সন্তানরা কোন গালাগাল না শিখতে পারে এবং কোন খারাপ শব্দ উচ্চারণ করতে না পারে।
আমার শৈশবে গালি ছিল একটা ভয়াবহ বিষয়। একবার স্কুলে এক ছেলে তার কোন সহপাঠীকে বরাহ-নন্দন বলেছিল। তাতে সেই ছেলেটির বাবা মাকে ডেকে এনে আমাদের প্রিন্সিপাল আপা অভিযোগ করেছিলেন। বলেছিলেন, ছেলেটি যদি আরেকবার এমন শব্দ স্কুলে উচ্চারণ করে তাহলে তাকে বের করে দেওয়া হবে। বাড়িতে শিশুদের নৈতিক শিক্ষা প্রসঙ্গেও ছেলের বাবা মাকে সেদিন অনেক উপদেশ হজম করতে হয়েছিল। আমার শৈশবে আমি স্কুলে কখনও কোন শিক্ষকের কণ্ঠে গালি শুনিনি। কানমলা, নিল ডাউন প্রভৃতি বহুবিধ শাস্তি দেখলেও শিক্ষক কাউকে গালি দিচ্ছেন সেটি দেখার বা শোনার অভিজ্ঞতা আমার শিক্ষাজীবনে হয়নি।
কিন্তু 'সে যুগ হয়েছে বাসি'। এখন আর বরাহ নন্দন, সারমেয় সন্তান টাইপ গালিকে কেউ গালি বলেই মনে করে না। বরং এসব শব্দ এখন আদর করে প্রেমিক প্রেমিকা পরষ্পরকে বলে থাকে।
এখন উচ্চতর শব্দ প্রয়োগের যুগ। এর সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা হলো একটি ফোনালাপ শুনে।
দু দিন পর পর একেকটা ফোনালাপ ফাঁস হয়, আর সমাজের কুৎসিত চিত্রটা আরও পরিস্কার হয়ে ওঠে। একজন শিক্ষিকার ফোনালাপ এখন যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল। দেশের নামকরা একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ হয়ে কি কুৎসিত ভাষাতেই না তিনি কথা বলছেন, অশালীন গালাগাল করছেন!
কিছুদিন আগে আরেকজনের গালাগাল ফেইসবুকে ভাইরাল হয়েছিল। সেটাও ছিল অতি কুৎসিত। তার আগে একজন 'ধর্মীয়' ব্যক্তিত্বের প্রেমালাপও ভাইরাল হয়।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, কিছুই আর ব্যক্তিগত নেই, গোপনীয় নেই। সবই এখন ফাঁস হচ্ছে এবং ফাঁসিয়ে দিচ্ছে।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষের মুখের ভাষা কেন এত জঘন্য সে প্রশ্নে আমি যাচ্ছি না। আমি এই প্রশ্নও করবো না যে, যেখানে একজন শিক্ষক এত অশালীন গালি দেন সেখানে ছাত্রীরা কী শিখবে। যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে এত কথা, সেখানে একটার পর একটা ঝামেলা কিন্তু লেগেই আছে। বিশেষ করে এই প্রতিষ্ঠানের ভর্তি-বাণিজ্য অতি পুরাতন ও নৈমিত্তিক ঘটনা। তবে ভর্তি বাণিজ্য ও এ সংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়েও আমি প্রশ্ন তুলবো না।
এসব প্রশ্ন এখন আর তুলে লাভ নেই। সমাজের সর্বত্রই এখন পচন আর পচন। এখন কুশিক্ষিত শিক্ষক, পদলেহী সাংবাদিক, দুর্নীতিবাজ আমলা, ফাঁকিবাজ চিকিৎসক আর বক ধার্মিকদের রমরমা। কোন পেশাটা ভালো মানুষের দখলে আছে সেটাই এখন গবেষণা করে বের করার বিষয়। তাই ওসব দাখিলায় না গিয়ে বরং অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরাই। সেটা হলো বন্ধুদের এবং শত্রুদের জন্য সাবধান বাণী উচ্চারণ।
যেভাবে ফোনালাপ, ইনবক্সের চ্যাটিং আর স্ক্রিন শট ফাঁস হচ্ছে, যেভাবে অন্তরঙ্গ মুহূর্তের ছবি ভাইরাল হচ্ছে- তাতে একটাই উপদেশ, তা হলো কথা কয়ো না গো। ফোনে হুমকি হোক বা প্রেমালাপ কোনটাই আর নিরাপদ নয়। বিশেষ করে সেই প্রেমালাপ যদি অবৈধ প্রেমের হয়ে থাকে তাহলে তো আর কথাই নেই। আর গালি, হুমকি ইত্যাদিও যদি কাউকে দিতে চান তাহলে ফোনে বা অন্য কোন ভার্চুয়াল মাধ্যমে নয়। বরং সামনাসামনি। অবশ্য সেখানেও নিশ্চিত হতে হবে তিনি গোপনে আপনার কথা রেকর্ড করছেন কিনা।
আর যারা মেসেঞ্জার ইনবক্সে বা অন্য কোনভাবে অবৈধ প্রেমালাপ করতে চান তারাও সেভাবে না করে সরাসরি আলাপ করুন। বরং কবুতরের পায়ে চিঠি বেঁধে দিতে পারেন যোগাযোগের জন্য তবু কোনভাবেই ভার্চুয়ালি অবৈধ প্রেম করতে গিয়ে ধরা খাওয়ার ঝুঁকি নিবেন না।
মনে রাখবেন এগুলো হলো কুপরামর্শ। এমন আরও অনেক কুপরার্শ রয়েছে। যেমন, যিনি বা যাহারা এমন সুমধুর গালাগাল ফোনালাপে বর্ষণ করেন তারা কেন নিজেদের প্রতিভার প্রতি সুবিচার করেন না? তারা তো অনায়াসেই গালি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষ হয়ে বসতে পারেন। সেইসঙ্গে 'বিচিত্র গালি' নামে বই লিখতে পারেন। ফেসবুক লাইভে এসেও তারা গালি দিতে পারেন। তাতে তাদের ফ্রেন্ড ফলোয়ারের সংখ্যা বাড়বে আশাতীতভাবে। কথা না বলে তারা 'ইশারায় শিস দিয়ে'ও মনের কথা প্রকাশ করতে পারেন। মাইম বা মুখাভিনয়ের চর্চা করতে পারেন। তাতে করে তাদের গালি দানের যোগ্যতা পাবলিকের কাছে প্রকাশিত হওয়ার ভয় থাকবে না।
কুপরামর্শ দিলাম। এবার সুপরামর্শ দিই। ফোনে, সরাসরি, ইনবক্সে কোথাও খারাপ কথা বলবেন না, অবৈধ কিছুর সঙ্গে জড়িত হবেন না। প্রেমালাপ, গালি-আলাপ সব কিছুতেই সংযত হোন। ভদ্রতার ও শালীনতার সীমা অতিক্রম করবেন না।
'মাতৃবৎ পরদারেষু, পরদ্রব্য লোষ্ট্রবৎ' –সেই পুরনো, বাতিল হয়ে যাওয়া সুপরামর্শই আরেকবার দিতে চাই। পুরনো চালই ভাতে বাড়ে। কিন্তু আজকের দিনে এসব ভালো কথার 'বেল' নাই।
সমাজে নীতিহীনতা ও রুচিহীনতা এত প্রকট হয়ে উঠছে যে এটাকে নৈতিক অবক্ষয়ের মহামারীও বলা চলে। এ থেকে উত্তরণের জন্য শুভ মূল্যবোধের পুনরুদ্ধার দরকার। তারজন্য চাই সমাজের সর্বস্তরে নীতি শিক্ষা এবং শীর্ষ পর্যায় থেকে সব জায়গায় নীতি নৈতিকতা ও সুরুচির চর্চা।