মুম্বাই হত্যাযজ্ঞ আমাদের যা স্মরণ করিয়ে দেয়

শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকশামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক
Published : 28 Nov 2021, 06:04 PM
Updated : 28 Nov 2021, 06:04 PM

মুম্বাইয়ে পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈয়বার নৃশংস হামলার ১৩ বছর অতিক্রান্ত হলেও সেই হামলা নিয়ে আজও চলছে বিশ্বব্যাপী নানারকম ভাবনা এবং গবেষণা।

বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের সৌভাগ্য যে চারদিনব্যাপী সেই হামলা চলাকালেই আজমল কাসাব নামে এক জঙ্গি ধরা পড়েছিল যাকে ধরতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছিল এক ভারতীয় পুলিশ। তার দেয়া তথ্য থেকে বেরিয়ে আসে যে, এই পৈশাচিক হামলা আসলে পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর পরিকল্পনারই ফসল। ওই হৃদয়বিদারক হামলায় নিহত হন ১৭৫ জন এবং মারাত্মকভাবে আহত হন ৩০০ জন নিরীহ মানব সন্তান। নিহতদের মধ্যে ভারতীয় ছাড়াও ছিলেন যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের নাগরিকও। অনেককে গুলি করা হলেও বেশ কজনকে অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয়েছিল। দশ পাকিস্তানি হামলাকারী শুধু মুম্বাইয়ের দুটি পাঁচ তারকা হোটেলেই তাদের হামলা সীমিত রাখেনি, তারা আক্রমণ করেছিল বিদেশি ভ্রমণকারীরা যেত এমন একটি ক্যাফে, একটি রেল স্টেশন, ইহুদিদের ক্লাবসহ বেশি কিছু বাণিজ্যিক এবং আবাসিক প্রকল্পে। তারা নগরীতে এমনভাবে অগ্নিসংযোগ করেছিল যে পুরো মুম্বাই শহরকে দেখে মনে হচ্ছিল এক বিশাল অগ্নিকুণ্ডের মতো। দাউ দাউ করে জ্বলছিল বিখ্যাত তাজ হোটেল, ট্রাইডেন্ট হোটেল, সিবাজী রেল স্টেশন এবং অন্যান্য আক্রান্ত স্থানসমূহ।

কাসাবের বক্তব্য পাওয়ার আগেই ধারণা করা হয়েছিল এর পেছনে পাকিস্তানি সেনাদের হাত আছে। যে গোপনীয়তা এবং সামরিক দক্ষতার সাথে তারা পাকিস্তান থেকে মুম্বাই প্রবেশ করে হামলা চালিয়েছিল তা সামরিক বিশেষজ্ঞদের সহায়তা ছাড়া সম্ভব ছিল না। কাসাব যে সব তথ্য ফাঁস করেছিল তার মধ্যে ছিল– দশজন সন্ত্রাসীর সকলেই ছিল পাকিস্তানি লস্কর-ই-তৈয়বার সদস্য। তারা করাচি বন্দর থেকে একটি নৌযানে সাগর পাড়ি দিয়ে এমনভাবে মুম্বাই পৌঁছে যাতে কেউ সন্দেহ করতে না পারে এবং তার আগে তারা হিন্দি ভাষায় তালিম নেয় যেন তাদের ভারতীয় বলেই মনে করা হয়। যাত্রাপথে এবং হামলাকালীন সময়ে তাদের সমস্ত কর্মকাণ্ড নিয়ন্ত্রণ করার এবং নির্দেশনা প্রদানের জন্য করাচিতেই স্থাপন করা হয়েছিল একটি নিয়ন্ত্রণ কক্ষ যার পরিচালনায় ছিল আইএসআই কর্মকর্তাগণ। জঙ্গিরা মোবাইল এবং ইন্টারনেট প্রযুক্তি ব্যবহার করে হামলাকে সফল করতে পেরেছিল। কাসাব জানায়, আইএসআই তাদের অস্ত্র, অর্থ এবং হামলা চালানোর প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের তদন্ত সংস্থা এফবিআই-এর কর্মকর্তাগণও কাসাবকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন।

১১ মাস পরে ডেভিড হেডলি ছদ্মনামধারী পাকিস্তানি বংশোদ্ভুত মার্কিন এক নাগরিককে যুক্তরাষ্ট্র সরকার জঙ্গি সম্পৃক্ততার অভিযোগে গ্রেফতার করলে সে মার্কিন এবং ভারতীয় তদন্ত কর্মকর্তাদের নিকট অমূল্য তথ্য প্রদান করে। মার্কিন সরকার ভারতীয় তদন্তকারীদের অনুমতি দিয়েছিল হেডলিকে জিজ্ঞাসাবাদ করার। জিজ্ঞাসাবাদে হেডলি জানায়, মুম্বাই হামলার জন্য দশ জঙ্গিকে পাকিস্তানের বিশেষজ্ঞ সৈন্যরা প্রশিক্ষণ দিয়েছিল। ভারতে এ ধরনের আক্রমণ পরিকল্পনা আইএসআই-এর বহু পুরানো পরিকল্পনার অংশ যার উদ্দেশ্য ছিল কাশ্মীর এবং লস্কর-ই-তৈয়বার জঙ্গিদের মধ্যে বিভেদ রোধ করে একটি সাফল্যের ঘটনার মাধ্যমে তাদের উৎসাহিত করা। হেডলি আরো জানায়, বিশেষ কৃতীত্ব প্রমাণের এবং বিশ্ববাসীর নজর কাড়ার জন্যই বিদেশিদের হত্যা করা হয়। আইএসআই আশা করেছিল যে, হামলাটি ভারতে হওয়ার কারণে বিশ্ববাসী পাকিস্তানের সাথে এর সম্পৃক্ততার অভিযোগ করতে পারবে না। তারা ধারণাও করতে পারেনি কেউ ধরা পড়বে, ভেবেছিল হামলাকারীরা নিজেদের রক্ষা করার জন্য আমৃত্যু লড়বে। কিন্তু কাসাবের গ্রেফতার পাকিস্তানের সম্পৃক্ততার বিষয়টি গোপন রাখার পরিকল্পনাকে নস্যাৎ করে দেয়, প্রমাণিত হয়ে যায় জঙ্গিরা পাকিস্তান থেকেই এসেছে। হেডলি জানায়, তিনি এককালে মাদক পাচারের সাথে জড়িত ছিলেন, পরে মার্কিন গোয়েন্দা বিভাগের গুপ্তচরের কাজ করার সময় তিনি আইএসআই-এর নজরে আসেন এবং আইএসআই তাকে লস্কর-ই-তৈয়বার সাথে সম্পৃক্ত করে দেয়। এরপর সৌদী সরকার জিয়াউদ্দিন আনসারি নামক এক পলাতক জঙ্গিকে ভারতে হস্তান্তর করলে আনসারির কাছ থেকেও মূল্যবান তথ্য পাওয়া যায়। আনসারি নিশ্চিত করেন যে আইএসআই হামলাকারীদের অস্ত্র, অর্থ, নির্দেশনা, পরিকল্পনা এবং প্রযুক্তিগত সহায়তা দিয়েছিল। তারা করাচিতে স্থাপিত নিয়ন্ত্রণ কক্ষে মেজর সামির আলি নামক এক সামরিক কর্মকর্তাকে দিকনির্দেশনা দেওয়ার দায়িত্ব প্রদান করেছিল। তিনি বলেন, হামলাকারীরা যাতে ভারতীয় বলেই বিবেচিত হয় এ জন্য তাদের হিন্দি এবং মুম্বাইয়ের আঞ্চলিক ভাষা শেখানো হয়। তাদের দেয়া তথ্য থেকে জামাত উদ দাওয়া (জেইউডি) নামক আরো একটি জঙ্গিগোষ্ঠীর পরিচয় সামনে আসে। পাশ্চাত্যের চাপে পড়ে এক সময় পাকিস্তানের ফেডারেল তদন্ত সংস্থা-এফআইএ ধরপাকড় শুরু করলেও আইএসআই-এর চাপে তারা সবাইকে ছেড়ে দেয় যা ডন পত্রিকায় লিখিত এফআইএ-এর প্রাক্তন প্রধান তারিক খোশার নিবন্ধ থেকে খানিকটা আঁচ করা যায়। পাকিস্তানে জঙ্গি কর্মকাণ্ড নিয়ে গবেষণা করা, পুলিৎজার পুরস্কারপ্রাপ্ত বিশ্বনন্দিত সাংবাদিক স্টিভ কোল তার বইয়ে উল্লেখ করেছেন মুম্বাই হামলাকারীদের আইএসআই-এর 'এস' শাখা পরিচালিত করেছিল। তিনি আরও লিখেছেন, হামলার বিষয়ে পাকিস্তানিদের ব্যাখ্যায় ছিল প্রচুর অসংলগ্নতা এবং স্ব-বিরোধিতা। কূটনৈতিকভাবে পাকিস্তান বিষয়টি তদন্তের প্রতিজ্ঞা করলেও পাকিস্তানি ভূমি ব্যবহার হয়নি বলে দাবি করে এবং অন্যদিকে হামলার সাথে পাকিস্তান এবং লস্কর-ই-তৈয়বার সম্পৃক্ততার সমস্ত প্রমাণ নষ্ট করতে থাকে।

এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র মেজর ইকবাল নামক এক পাকিস্তানি গোয়েন্দা কর্মকর্তাকে বিচারে সোপর্দ করে, যিনি জঙ্গিদের অর্থায়ন করতেন। পাশ্চাত্যের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আইএসআই-এর শীর্ষ এক কর্মকর্তার সাথে বৈঠক করে জঙ্গিদের বিচারের দাবি তোলেন।

জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে যে সব জড়িতদের নাম উঠে আসে, আন্তর্জাতিক চাপের পরও পাকিস্তান তাদের বিচার করেনি। বিশেষ করে মুখ্য ভূমিকায় থাকা বিশ্বময় জঙ্গি রফতানির দায়িত্বে নিয়োজিত সাজিদ মীর, জাকিউর রহমান লাকভি এবং হাফিজ সাঈদ-এর মতো দুর্ধর্ষ জঙ্গিদের তারা বিচার করেনি। লাকভিকে লোক দেখানোর জন্য নামমাত্র সাজা দেয়া হয়। আর সাঈদ হাফিজ রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। ২০১৩ সালে মামলার প্রসিকিউটারকে হত্যা এবং বিচারককে মৃত্যুর হুমকি দিয়ে সব কিছু স্তব্ধ করে দেয়া হয়। তাছাড়া নিরাপত্তা পরিষদ জঙ্গি সংস্থা, জামাত উদ দাওয়াকে (জেইউডি) সন্ত্রাসী সংস্থা হিসাবে ঘোষণার পরও পাকিস্তান উক্ত সংস্থার কাউকে গ্রেফতার করেনি, সংস্থাকে নামে মাত্র কাগজে-কলমে কালো তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।

পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফও বেশ কয়েক বছর পর বলেছেন পাকিস্তান মুম্বাই হামলাকারীদের বিচার না করায় আন্তর্জাতিকভাবে তাদের সুনাম ক্ষুণ্ন হয়েছে। পাকিস্তান যে বিদেশে জঙ্গি রফতানি করছে তা নিশ্চিত করেছেন সে দেশের প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিরুল্লাহ বাবর। পাকিস্তান যে এখনো জঙ্গি পালন এবং বিদেশে রফতানি করা বন্ধ করেনি সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে জঙ্গি রোধকল্পে সৃষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থা ফিনানসিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফআইটিএফ) এখনো পাকিস্তানকে ধূসর তালিকায় রেখেছে। বিভিন্ন জঙ্গি সংস্থা এখনো পাকিস্তানে প্রকাশ্যে অর্থ আদায়, সদস্য বাড়ানো, প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে লিপ্ত রয়েছে কর্তৃপক্ষের নজরের মধ্যেই। তারা সরবে জিহাদের কথা বলে যাচ্ছে।

গত ২৬ নভেম্বর মুম্বাই হামলার ওপর একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভায় ভাষণ দিতে গিয়ে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব আসাদুজ্জামান কামাল বলেছেন, ২০০৮ সালের মুম্বাই এবং ২০০৪ সালে ঢাকায় গ্রেনেড হামলা একই রকম বিষয়। এরা একাত্তরের পরাজিত শক্তি। তিনি আরো বলেন, জঙ্গিবাদের আশ্রয়-প্রশ্রয় এবং প্রশিক্ষণদাতা পাকিস্তানের সকল চক্রান্ত প্রতিহত করে ভারতীয় উপমহাদেশে শান্তি বজায় রাখা হবে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় আরো উল্লেখ করেন যে, আইএসআই আমাদের নানাভাবে বিব্রত করার প্রচেষ্টা নিয়েছে, তবে আমরা সে ব্যাপারে সব সময় খেয়াল রাখছি, তাদের গতিবিধির উপর লক্ষ্য রাখছি।

পশ্চিমা বিশেষজ্ঞদের মতে আইএসআই-এর 'এস' শাখা শুধু লস্কর-ই-তৈয়বাই নয়, পাকিস্তানভিত্তিক অন্যান্য জঙ্গি সংগঠন যথা জইশ-ই-মোহম্মদ, জামাত উদ দাওয়া, হাক্কানি গ্রুপ, হিজবুল মুজাহিদিন, হরকত উল জিহাদের মতো অন্যান্য জঙ্গি সংগঠনকে পালন করছে, প্রয়োজনে যাদের বিদেশেও রফতানি করা হয়। ২০২০ সালের ডিসেম্বরে কানাডায় আশ্রয় গ্রহণকারী বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা দাবিদার কারিনা বালুচের মৃত্যুদেহ পাওয়া যাওয়ার পরই অভিযোগ ওঠে আইএসআই কর্মীরাই তাকে হত্যা করেছে। কারিনা আইএসআই-এর ভয়ে ২০১৬ সালে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে কানাডায় আশ্রয় নেয়। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কথা অনুযায়ী আইএসআই এখনো বাংলাদেশের ব্যাপারে তৎপর, যা আমরা সব সময় বলে আসছি। তবে আমরা এটা জেনে আশ্বস্ত যে, তাদের ওপর নজরদারি রয়েছে। ২০০৮ সালের মুম্বাই নগরীতে যে হত্যাযজ্ঞ পাকিস্তানি সেনাদের মদদে ঘটানো হয়েছিল তা বিশ্বের অন্যান্য দেশের শান্তিকামী জনতার মতো আমাদেরও শংকিত করে তোলে। পাকিস্তান যেন জঙ্গি রফতানি করে এ অঞ্চলসহ বিশ্বের অন্য কোথাও অশান্তির সৃষ্টি করতে না পারে সে দিকে নজর দেয়া আজ অত্যন্ত জরুরী হয়ে পড়েছে, বিশেষ করে তালেবানরা আফগানিস্তান দখল করার পরে।