হিরো আলম এবার সত্যিই হিরো হলেন

‘মাইরের উপর ওষুধ নাই’—এটা রাজনীতিতে খুব একটা ইতিবাচক ফল দেয় না। বরং এতে জিরো-রা হিরো বনে যায়। এর আগে লাগাতার ‘মাইর’ হজম করে অখ্যাত নুর ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। হিরো আলমও ‘মাইর’ খেয়ে আন্তর্জাতিকভাবে হিরো হয়ে গেছেন।

চিররঞ্জন সরকারচিররঞ্জন সরকার
Published : 19 July 2023, 03:57 AM
Updated : 19 July 2023, 03:57 AM

ক্ষমতাসীনদের উচিত ছিল হিরো আলমের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানানো। তাকে পুরস্কৃত করা। কেননা বিএনপিসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর বর্জনের মুখে উপনির্বাচনগুলো যখন একেবারেই একপেশে, বিবর্ণ ও আকর্ষণহীন হয়ে পড়ছিল, তখন হিরো আলম ‘যদি লাইগ্যা যায়’ ভরসায় এগিয়ে এসেছেন।

বগুড়ার উপনির্বাচনের পর ঢাকা-১৭ আসনেও প্রার্থী হয়েছেন তিনি। ঢাকার ভোটার নন, তারপরও গুলশান-বনানী-ক্যান্টনমেন্ট এলাকার অভিজাত ভোটারদের ভোটে জিতে এমপি হবার স্বপ্ন দেখেছেন। তিনি তার সীমিত সামর্থ্য নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের একজন ‘তুখোড়’ প্রার্থীর বিরুদ্ধে নির্বাচন-যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। টিভি টকশোর চেনামুখ, বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সাবেক বাকপটু শিক্ষকের বিরুদ্ধে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন। রসকষহীন নির্বাচনে আলোচিত হয়েছেন, আলোচনার খোরাক যুগিয়েছেন।

হিরো আলম কোথায় গেলেন, কী বললেন, কী করলেন, গণমাধ্যমের কাছে তা বড় ধরনের খবরের উপাদান। যে নির্বাচন নিয়ে কাকপক্ষীরও কোনো আগ্রহ থাকার কথা ছিল না, হিরো আলম সেই নির্বাচনকে জমিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা হিরো আলমের মাহাত্ম্য অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তারা ‘মাইরের উপরে ওষুধ নাই’ নীতিতে অবিচল থেকেছেন। শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের কাছে হিরো আলম কী বললেন, কত ভোট পেলেন, তার চেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে তিনি কতবার মার খেলেন? ভোট যা পেয়েছেন, তা-ও কিন্তু নেহায়েত ফেলে দেওয়ার মতো নয়। হিরো আলম ৫৬০৯ ভোট পেয়েছেন। আরাফাত পেয়েছেন ২৮,৮১৬ ভোট।

ক্ষমতাসীনরা যতই অস্বীকার করুন, বাস্তবতা হলো হিরো আলমকে একাধিকবার ধোলাই দেওয়া হয়েছে। ‘তৃতীয় পক্ষ এই কাজ করেছে’ ক্ষমতাসীনদের এমন বক্তব্য কারো কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। কারণ নির্বাচনের মাঠে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও পুলিশ ছাড়া তেমন কেউ ছিল না। হিরো আলমকে যদি ‘তৃতীয় পক্ষ’ হামলা ও মারধর করে চলে যায়, তাহলেও প্রশ্ন ওঠে: পুলিশ করেছেটা কী? একজন প্রার্থীকে যদি নিরাপত্তা দিতে না পারে, তাহলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও নির্বাচন কমিশনের কাজটা কী? হিরো আলমকে রক্ষার দায়িত্ব তো আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগেরও ছিল। কেননা এই হিরো আলমই তাদের ‘বিনা ভোটে’ নির্বাচিত হওয়ার লজ্জা থেকে বাঁচিয়েছেন। যে হিরো আলম এত ত্যাগ স্বীকার করলেন, সাহস দেখালেন, তাকেই কিনা বিনা কারণে পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে দেওয়া হলো?

অথচ এই নির্বাচনের একমাত্র আকর্ষণই ছিলেন হিরো আলম। ঢাকায় তার কোনো চাল-চুলো নেই, থাকার জায়গা নেই, দুই হাতে উড়ানোর মতো যথেষ্ট টাকা নেই। দল নেই। নেই নিজস্ব সমর্থক ও কর্মীবাহিনী। ভালো করে বক্তৃতাও দিতে পারেন না। শুধু মনের জোরে তিনি সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি আরো বড় হিরো হয়েছেন। 

একথা ঠিক যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আলোচিত ব্যক্তি মো. আশরাফুল আলম বা হিরো আলম বগুড়ার উপনির্বাচনে যতটা সাড়া ফেলেছিলেন, রাজধানীতে তা করতে পারেননি। অবশ্য পারার কথাও নয়। এখানে তিনি স্বাভাবিকভাবে প্রচার-প্রচারণাতেও অংশ নিতে পারেননি। ক্ষমতাসীন দলের কর্মীসমর্থকরা তাকে নানাভাবে হয়রানি ও নাজেহাল করেছে।

এমনকি শেষদিনও কোনো কার্যকারণ ছাড়া তার উপর ন্যাক্কারজনকভাবে হামলা করা হয়েছে। এই ডামাঢোলে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী মোহাম্মদ আলী আরাফাত (মোহাম্মদ এ আরাফাত) নির্বাচিত হয়েছেন। মাত্র মাস চারেক সংসদে বসার সুযোগ পাবেন মোহাম্মদ এ আরাফাত। কারণ, বর্তমান জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হয়ে আসছে।

জাতীয় নির্বাচনের মাত্র চার মাস আগে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচন নিয়ে তাই ভোটারদের খুব একটা আগ্রহ ছিল না। ক্ষমতাসীনদের ব্যাপক তৎপরতার পরও এই উপনির্বাচনে ভোট পড়ার হার ১১ দশমিক ৫১ শতাংশ। আমাদের দেশের মানুষ যে রকম নির্বাচন পাগল, তাতে ভোট প্রদানের এই হার মোটেও সন্তোষজনক নয়।

এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ এ আরাফাত জিতলেও ক্ষমতাসীনরা তেমন কিছুই অর্জন করতে পারেননি। বরং তাদের ভাবমূর্তি আরও বেশি কালিমালিপ্ত হয়েছে। ‘মাইরের উপর ওষুধ নাই’ এটা রাজনীতিতে খুব একটা ইতিবাচক ফল দেয় না। বরং এতে জিরো-রা হিরো বনে যায়। এর আগে লাগাতার ‘মাইর’ হজম করে অখ্যাত নুর ডাকসুর ভিপি নির্বাচিত হয়েছিলেন। হিরো আলমও ‘মাইর’ খেয়ে আন্তর্জাতিকভাবে হিরো হয়ে গেছেন। জাতিসংঘ, মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও শক্তিধর দেশগুলো এখন হিরো আলমের উপর হামলার ঘটনার প্রতিবাদ জানাচ্ছে। তার খোঁজখবর নিচ্ছে। এ জন্য অবশ্য হিরো আলমেরও ‘অজ্ঞাত’ হামলাকারীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা উচিত। কেননা তিনি এমপি হলে এতটা প্রচার পেতেন কিনা সন্দেহ আছে। এ আরাফাত নয়, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের কাছে ‘হিরো’ এখন হিরো আলম!

আরেকটি কথা, মুখে যাই বলুন না কেন, নির্বাচন কমিশন এই উপনির্বাচন পরিচালনায় দক্ষতার পরিচয় দিয়ে পারেনি। তারা ভোটারদের যেমন ভোট কেন্দ্রে আসার ব্যাপারে উজ্জীবিত করতে ব্যর্থ হয়েছে, পাশাপাশি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিরো আলমকে নিরাপত্তা প্রদানের ক্ষেত্রেও ক্ষমাহীন ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। একটি মাত্র সংসদীয় আসনে উপনির্বাচন। নির্বাচনের কমিশনের ভান্ডারে রয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকরী বাহিনীর হাজার হাজার সদস্য। অথচ নির্বাচনের প্রচার চালানোর সময় এবং নির্বাচনের দিন বিকেলে তার উপর হামলা চালানো হলো। সাংবাদিকরা ছবি তুলল, ভিডিও করল, সেই ভিডিও ভাইরাল হলো, কিন্তু পুলিশ কিছুই করতে পারল না, এটা সত্যিই দুঃখজনক।

তারপরও অবশ্য শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশের মহড়া থেমে নেই। নির্বাচন কমিশন বলছে, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, দুয়েকটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া নির্বাচন শান্তিপূর্ণ হয়েছে। ক্ষমতাসীনরা বলছেন, নির্বাচন ভালো হয়েছে। যতটুকু যা অভিযোগ, নির্বাচনে তেমনটা হয়েই থাকে। হিরো আলম বলছেন, এ সরকারের অধীনে আর নির্বাচন নয়। সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তিনি জয়ী হতেন। সবাই নিজ নিজ অবস্থান থেকে বক্তব্য দিচ্ছেন। কেউ কারো অভিযোগ আমলে নিচ্ছেন না।

আমাদের দেশের রাজনীতির এটাও একটা বড় সমস্যা।

একথা ঠিক যে, ভোটের রাজনীতিতে অনেক কিছু ‘শুদ্ধ’ হয় না। ‘ব্যাকরণসিদ্ধ’ও হয় না। অনেক কিছু করতে হয়, অনেক কিছু মানিয়ে নিতে হয়। কিন্তু এটা করতে গিয়ে উপযুক্ত লোকেরা হারিয়ে যায়। হয় তারা নিজেরা সবকিছু থেকে সরিয়ে নেন। অথবা তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়। খারাপ বা ময়লা টাকা যেমন চকচকে টাকাকে বাজার থেকে সরিয়ে দেয়, সেভাবে। আপসকামিতা, মাত্রাতিরিক্ত আদর্শহীনতার কারণে সাধারণ মানুষ ক্রমেই রাজনীতির প্রতি আস্থা হারাচ্ছে। সামরিক শাসক নয়, বিরাজনীতিকীকরণ ঘটছে রাজনীতির মানুষের হাত দিয়ে। স্বাধীন দেশের রাজনীতিতে এর চেয়ে বড় অধঃপতন আর কী হতে পারে?

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীমাত্রই জানেন যে, কোনো দলের ক্ষমতায় থাকার দুটি উপায় আছে। প্রথমটি হচ্ছে যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করা। এটি কিছু সময়ের জন্য কাজ করতে পারে, কিন্তু সব সময়ের জন্য কাজ করবে না। বরং এতে অসন্তোষ ও ক্ষোভ বাড়ে। এই ক্ষোভ নিরসনের জন্য তখন কঠোর ব্যবস্থা নিতে হয়। এতে করে ক্ষোভ দিন দিন বাড়তেই থাকে। শেষ পর্যন্ত বাঁধ ভেঙে গেলে পরিণতি কী হয়, তা আমরা জানি। অন্য বিকল্প হলো, ক্ষমতাসীন দল নতুন ম্যান্ডেট পাওয়ার যোগ্য কিনা তা জনগণকে সিদ্ধান্ত নিতে দেওয়া। সম্ভাব্য প্রতিশোধের ভয় পেয়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নস্যাৎ করলে তাতে আরো খারাপ পরিণতিকেই আমন্ত্রণ জানানো হয়।

পুনশ্চ:

আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলো সব সময় নিজেদের সেরা দাবি করেন। এমকী চরম দুঃসময়েও বাকচাতুর্য দিয়ে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্বের বিজ্ঞাপন দিয়ে চলেন। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে এক প্রাচীন উপকথার গল্প।

এক বাসায় কুকুর আর বিড়ালের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে সবসময় ঝগড়া হতো! বিড়াল বলত: আমি মাছ-মাংস দুধ ইত্যাদি অভিজাত খাবার খাই। বিছানায় ঘুমাই! কাজেই আমিই সেরা! কুকুর সম্পর্কে বিড়ালের মূল্যায়ন: তুমি ডাস্টবিন নর্দমার খাবার খাও! এমনকি মল পর্যন্ত খাও! ঘুমাও মাটিতে! তুমি তো মহা-নিকৃষ্ট!

একদিন বাড়ির গিন্নি মুড়িঘণ্ট রাঁধবেন বলে রুই মাছের মাথা ভেজে রেখেছেন! অন্য সব প্রস্তুতির পর যখন মুড়ো কড়াইয়ে দিবেন তখন দেখেন মুড়োটা বিড়ালে খাচ্ছে! চরম ক্ষুব্ধ গৃহিণী বিড়ালের গলায় দড়ি বেঁধে কাজের ছেলেকে নির্দেশ দিলেন, বিড়ালটাকে নিকটস্থ নদীতে ফেলে দিয়ে আসতে!

গলায় দড়ি বেঁধে যখন বিড়ালকে টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, তখন কুকুরটি বিড়ালকে প্রশ্ন করল:

‘এত দিন শুনেছিলাম তোমার মুখে বড় বড় কথা,

মরার দড়ি গলায় দিয়ে যাওয়া হচ্ছে কোথা?’

বিড়ালের উত্তর: ‘যার যেখানে মন,

তুলসি মালা গলায় দিয়ে চলছি বৃন্দাবন!’