সর্বনাশা কূটনীতির পথে নয়

প্রতিবেশীর সঙ্গে সদ্ভাব যেমন বজায় রাখতে হবে, তেমনি দ্বিপক্ষীয় কিংবা বহুপক্ষীয় যেকোনো সমস্যার সমাধানেও সচেষ্ট হতে হবে।

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 6 Sept 2022, 04:30 AM
Updated : 6 Sept 2022, 04:30 AM

সেপ্টেম্বর ৬, ১৯৬৫। আমাদের এ অঞ্চলের রাজনৈতিক ভূগোল পাল্টে দেওয়ার সূচনা হয়েছিল ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার ১৭ দিনের যুদ্ধের মাধ্যমে। এ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকেই আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান স্বায়ত্তশাসনের ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচি উপস্থাপন করেন। তিনি সহকর্মী-সমর্থকদের কাছে স্পষ্ট করে দেন– ৬ দফা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পথে সাঁকো। জনগণ বুঝে যায়, শেখ মুজিবুর রহমান কোন পথে চলেছেন। পাকিস্তানের শাসকরাও বুঝে যায় তার উদ্দেশ্য। এ কারণে তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করা হয়। কিন্তু বিক্ষুদ্ধ জনগণ তাকে মুক্ত করে আনে এবং বরণ করে নেয় বঙ্গবন্ধু হিসেবে। যার নেতৃত্বেই এসেছে এ ভূখণ্ডের স্বাধীনতা।

১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বরে শুরু হওয়া ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের ৫৭ বছর পর ২০২২ সালের একই তারিখে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে আলোচনায় বসছেন বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং নরেন্দ্র মোদী । এ বৈঠকের ইস্যু অনেক। তবে তারিখ নির্বাচন কি কাকতালীয়? ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মনমোহন সিং ঢাকায় এসেছিলেন। ওই সময় তিস্তা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে চুক্তি সম্পাদন চূড়ান্ত হওয়ার পর আকস্মিকভাবে তা স্থগিত হয়ে যায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আপত্তির কারণে। অথচ ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বরে গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন নিয়ে ৩০ বছর মেয়াদী চুক্তি সম্পাদনে ওই সময়কার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। পরের বছর পার্বত্য চট্টগ্রামে অশান্তির অবসান ঘটাতেও ভারতের দিক থেকে সহায়তা মিলেছিল। এ ঘটনায় উভয় দেশই লাভবান হয়। যেমন লাভবান হচ্ছে সীমান্ত বিরোধ অবসানে ১৯৭৪ সালের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির বাস্তবায়ন এবং সমুদ্র সীমা নিয়ে বিরোধ অবসানে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের রায় মেনে নিয়ে দুই দেশের নেতৃত্বের প্রজ্ঞাবান সিদ্ধান্ত।

কিন্তু এ ধরনের প্রজ্ঞা সব সময় দেখা যায়নি। উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরতে পারি ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত ২০০৩ সালের ২ জুলাইয়ের এ খবরটি– Another stunning ammo haul in Bogra, this time from BNP workers' houses 26,500 bullets, 48kg explosives recovered. With yesterday's raids, 88,600 bullets and 168kg explosives have so far been recovered in Bogra.

ওই সময় নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছিলেন– ভারত অভিযোগ করে আসছিল, বাংলাদেশের ভূখণ্ড ভারতের বিরুদ্ধে subversive activities পরিচালনার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। এত বিপুল পরিমাণ গুলি ও বিস্ফোরক উদ্ধারের ঘটনা থেকে বলা যায়– এ অভিযোগ অমূলক ছিল না। দুর্ভাগ্যজনক যে এক বছর যেতে না যেতেই ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল কর্ণফুলী নদীতে চট্টগ্রাম ইউরিয়ার সার কারখানার জেটি থেকে- Police and Coast Guard interrupted the loading of ten trucks and seized extensive illegal arms and ammunition at a jetty of Chittagong Urea Fertilizer Limited (CUFL) on the Karnaphuli River. This is believed to be the largest arms smuggling incident in the history of Bangladesh. Investigators believed that delivery was intended for the United Liberation Front of Asam (ULFA), a militant group considered responsible for causing thousands of deaths since 1979. Its military wing chief, Paresh Baruah, [1] then living in Dhaka, was among the 50 persons ultimately charged in the case.

ওই সময়ে বিএনপি-জামায়াতে ইসলামীর জোট ছিল ক্ষমতায়। তারা চেয়েছে ‘ভারতের সর্বনাশ’। ২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনে জয়ী হয়ে শেখ হাসিনা দ্বিতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর নিরাপত্তা নিয়ে ভারতের উদ্বেগ নিরসনে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বাংলাদেশ এখন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে পারছে– আমরা আপনাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের অবসান ঘটিয়েছি। কেবল উত্তর-পূর্ব ভারতের সীমান্ত নিয়ে উদ্বেগ দূর করা হয়নি, আপনাদের প্রতিরক্ষা বাজেটেও এর ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কেউ কেউ বলতে চাইছেন– ভারতকে আমরা ‘অনেক দিয়েছি’, কিন্তু বিনিময়ে তারা কিছু দেয়নি। কিন্তু প্রতিবেশীর নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা-উদ্বেগ দূর করা কি অন্যায় বা অযৌক্তিক? ভারত যে পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে নিজেকে ‘গুটিয়ে’ নিয়েছে, সেটাও অযৌক্তিক নয়।

বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য, স্বাধীনতার পরের ৫০ বছরের প্রায় ৩০ বছর এমন অপশক্তি ক্ষমতায় ছিল যারা প্রতিবেশীর সঙ্গে সৎ সম্পর্ক বজায় রাখতে উৎসাহী ছিল না। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী সব কিছুতে ভারতের ‘হাত’ দেখতে পেত। পূর্ব পাকিস্তানে বন্যা হলে বলা হতো– ভারত পানি ছেড়ে দিয়েছে। অথচ পাকিস্তানের সাম্প্রতিক বন্যার সময় বলা হচ্ছে– ‘দেশটি অন্তত ৫০ বছর পিছিয়ে গেছে।’

বাংলাদেশ পাকিস্তানের চেয়েও ভয়াবহ অনেক বন্যা-ঝড়-জলোচ্ছাস মোকাবিলা করেই এগিয়ে চলেছে। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ যথার্থই বলেছিলেন– ‘সাত কোটি মানুষকে দবায়ে রাখতে পারবা না।’ পাঁচ দশকে বাংলাদেশের লোকসংখ্যা দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। এখনও আমাদের কেউ দাবায়ে রাখতে পারছে না। আমরা খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। নিজের অর্থে পদ্মা সেতুর মতো প্রকল্প নির্মাণ করতে পেরেছি। করোনার মতো স্বাস্থ্য-বিপর্যয় আমরা মোকাবিলা করেছি। বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক দুর্যোগের মধ্যেও বাংলাদেশ অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধিও হার উচ্চ রাখতে পেরেছে। মিয়ানমারের শাসকদের ‘চরম অবন্ধুসুলভ’ পদক্ষেপের কারণে বাধ্য হয়ে বাংলাদেশ ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয়-খাদ্য-চিকিৎসা সুবিধা প্রদান করছে।

এ সমস্যার সমাধানে প্রধানমন্ত্রী বিশেষভাবে ভারতের সহায়তা চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, যতদিন রোহিঙ্গারা নিজ নিজ ঘরে যেতে না পারছে, তাদের একটি অংশকে ভারত আশ্রয় দিতে পারে।

আমাদের স্মরণে আছে, ১৯৭১ সালে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশের নাগরিক ভারতে আশ্রয়-বাসস্থান পেয়েছিল। তারা সর্বক্ষণ চিন্তায় রেখেছে– প্রিয় স্বদেশে দ্রুততম সময়ে ফিরে যেতে চাই। ভারতে অবস্থানকালে বাংলাদেশের নাগরিকরা কেউ ওই দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে, এমন কাজ করেননি। কিন্তু রোহিঙ্গাদের একটি অংশের কর্মকাণ্ড কেবল বাংলাদেশের জন্য নয়, আঞ্চলিক নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বেগ বাড়াচ্ছে। এ অঞ্চলের সার্বিক নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে যে উদ্বেগ রয়েছে, তার নিরসনে ভারত নিশ্চয়ই কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। চীনকেও এ বিষয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।

তিস্তা নদীর পানি বণ্টনের বিষয়টি ১১ বছর ঝুলে আছে। ভারত এ নিয়ে দীর্ঘ সময়ে এক পা-ও অগ্রসর হয়নি। সীমান্তে হত্যাকাণ্ডও বন্ধ করা যায়নি। কেউ অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করলে কিংবা চোরাচালানে সংশ্লিষ্ট হলে তাকে গ্রেফতার করা যেতে পারে, শাস্তিও দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু হত্যাকাণ্ড কেন?

দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৈষম্য ভারতের অনুকূলে। ২০২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ ভারত থেকে ৮৫৯ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। এ বছর ভারতে রফতানি করেছে ১২৮ কোটি ডলারের পণ্য। কিন্তু এ বছরেই বাংলাদেশ চীন থেকে ১২৯২ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে। আর রফতানি করেছে মাত্র ৬৮ কোটি ডলারের পণ্য। বলা যায়, ভারতের চেয়েও চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বাংলাদেশের বেশি প্রতিকূলে। কিন্তু ‘ঐতিহাসিক’ কারণেই ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি নিয়ে যতটা উদ্বেগ, চীনের প্রশ্নে ততটা নয়। ভারত ও চীন, উভয় দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি নিরসনে উদ্যোগী হতে পারে। এ জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ হচ্ছে– বাংলাদেশের বিশেষ অর্থনৈতিক এলাকায় তাদের কলকারখানা স্থাপন এবং এ সব প্রতিষ্ঠানে উৎপাদিত পণ্যের একটি অংশ ভারত ও চীনে রফতানি, বাকি অংশ বাংলাদেশের বাজারে বিক্রি।

বাংলাদেশের ৫০ বছরে মধ্যে খালেদা জিয়া ১০ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদ ক্ষমতায় ছিলেন প্রায় ১০ বছর। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্টের পর জিয়াউর রহমান ৫ বছর ক্ষতায় ছিলেন। কিন্তু এই তিন শাসকের আমলে ভারতের সঙ্গে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধানে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। খালেদা জিয়া ২০০৬ সালের মার্চ মাসে ভারতে সফর শেষে ফিরে বলেছিলেন– ‘গঙ্গার পানি বণ্টনের বিষয়টি আলোচনায় আসেনি। কারণ আমি এটা উত্থাপন করতে ভুলে গিয়েছিলাম।’ ওই সফরের সময় ড. মনমোহন সিং ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, যখন– Two Agreements were signed during the visit of the Bangladesh Prime Minister. These were: the Revised Trade Agreement and the Agreement for Mutual Cooperation for Preventing Illicit Trafficking in Narcotic Drugs and Psychotropic Substances and Related Matters.

তিস্তা কোথায়? সীমান্ত-ছিটমহল-সমুদ্র বিরোধ কোথায়? বাণিজ্য ঘাটতি কোথায়?

এইচ এম এরশাদ ১৯৮৮ সালের প্রবল বন্যার সময় ভারতের সহায়তা প্রত্যাখান করে ‘কূটনৈতিক বিপর্যয়ে’ দেশকে ঠেলে দিয়েছিলেন। শেখ হাসিনা জাতীয় স্বার্থ কখনও ভোলেননি। এ কারণেই ২০০৯ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে অন্তত ২২টি চুক্তি সম্পাদন করেছেন। নেপাল ও ভুটানের মতো সার্কভুক্ত দেশকে আঞ্চলিক সহযোগিতায় আরও বেশি সংযুক্ত করার বিষয়েও তিনি যত্নবান।

প্রতিবেশীর সঙ্গে সদ্ভাব যেমন বজায় রাখতে হবে, তেমনি দ্বিপক্ষীয় কিংবা বহুপক্ষীয় যেকোনো সমস্যার সমাধানেও সচেষ্ট হতে হবে। বিএনপি কিংবা জতীয় পার্টির সামরিক শাসনামলে আমরা দেখেছি ভিন্ন উদ্যোগ, যা ছিল সর্বনাশা। ত্রিশ লাখ শহীদের আত্মদানে অর্জিত বাংলাদেশকে বিশ্বাসীর কাছে ‘হেয়-তুচ্ছতাচ্ছিল্য’ করতেও তাদের বাধে না। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফকরুল ইসলাম বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মিয়ানমারের গোলা নিক্ষেপের প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে আমাদের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা নিয়ে নিয়ে বিদ্রুপ করেছেন। তার এ মন্তব্য শুনে মনে হয় যেন তিনি মিয়ানমারের সামরিক জান্তার এজেন্ট। এমনটি হতেই পারে– বিএনপি সামরিক শাসকদের সৃষ্ট দল। মিয়ানমারেও ক্ষমতায় রয়েছে সামরিক জান্তা, যারা ওই দেশে সমস্যা করছে, আমাদের জন্যও সমস্যা সৃষ্টি করছে।

প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে অনেক সমস্যার সমাধান হবে, অনেক সমস্যা অনিষ্পন্ন রয়ে যাবে। অনিষ্পন্ন সমস্যার সমাধানে সব পক্ষের আন্তরিক উদ্যোগ কাম্য। দিল্লি থেকে সুবাতাস আসুক, এটাই সকলের প্রত্যাশা। শেখ হাসিনা অর্থনীতির হাল ফিরিয়েছেন। জনগণের জীবনমান ধীরে ধীরে উন্নত করতে পারছেন। এ কারণে বৃহৎ কিংবা অন্য সকল প্রতিবেশীর সঙ্গেও বলিষ্ঠ অবস্থানে থেকে কথা বলতে পারছেন। নিজের প্রাপ্য বুঝে নিতে দৃঢ়তা দেখাতে পারছেন। বিএনপি এবং অন্য দলগুলো বাংলাদেশের নতুন এ অবস্থানের প্রতি সমর্থন জানাবে কি? নাকি তারা চলবে সর্বনাশা পাকিস্তানি ধারার পক্ষে?