মেয়াদের শেষ বছরে চাই বাড়তি সতর্কতা

সরকার পরিচালনায় শেখ হাসিনা যতটা সফল, দল গোছানোর ক্ষেত্রে ততটা এগিয়ে আছেন বলে অনেকে মনে করেন না।

মোনায়েম সরকারমোনায়েম সরকার
Published : 6 Jan 2023, 02:44 PM
Updated : 6 Jan 2023, 02:44 PM

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর। ওই নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট। আওয়ামী লীগ জোট পেয়েছিল ২৬৬ আসন; বিএনপি জোট ৭, জাতীয় পার্টি ২২ এবং অন্যরা পেয়েছিল ৪টি আসন। ২০১৯ সালের ৭ জানুয়ারি শপথ গ্রহণ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা। মহাজোট জয়লাভ করবে, এটা প্রায় নিশ্চিত থাকলেও এত বিপুলসংখ্যক আসনে তার জয়লাভ এবং বিএনপির এত কম আসন পাওয়া ছিল অভাবিত।

একাদশ সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হলেও শতভাগ সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়নি, এটা অনেকেই বলেন। বিএনপি ও তার মিত্ররা নির্বাচনের ফলাফল বর্জনপূর্বক নতুন নির্বাচন দাবি করে সে দাবি আদায় করতে অবশ্য পারেনি। সংসদ বাতিলের দাবি জানিয়ে বিজয়ীরা নানা নাটকীয়তা শেষে শপথ নিয়ে পরে সংসদে যোগও দিয়েছে। দেশের মানুষের মধ্যে নির্বাচন নিয়ে প্রবল ক্ষোভ ছিল না বলেও হয়তো ওই নির্বাচনের পর গঠিত সরকার মেয়াদকাল শেষ করতে চলেছে। চার বছর পূর্ণ হলো। শেষ বছরটিও পার না করার কোনো বাস্তব কারণ বা লক্ষণ কিছুই এখনো দেখা যাচ্ছে না।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত চতুর্থ মন্ত্রিসভায় ১৪ দলের কাউকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এটাও অনেকের কাছে প্রত্যাশিত ছিল না। বিশেষ করে ১৪ দলের শরিকরা নিশ্চয়ই হতাশ হয়েছে। তবে এ নিয়ে বড় ক্ষোভ বা অসন্তোষের কথাও শোনা যায়নি। শেখ হাসিনা যেটা ভালো মনে করেছেন, সেটাই করেছেন এবং অন্যরা তা মেনে নিয়েছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট মাত্র ৭টি আসন পাওয়ায় সংসদে বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা করে নির্বাচনে ২২ আসনে জয়লাভ করলেও সরকারে না নিয়ে জাতীয় পার্টিকে সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকা পালনের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ টানা তিন মেয়াদে দেশ শাসনের সুযোগ পায়। এটা বাংলাদেশের রাজনীতিতে অনন্য ঘটনা। এর আগে এত দীর্ঘ সময় সরকারে থাকার সুযোগ আর কেউ পাননি। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের উন্নতি আর সমৃদ্ধিও হয়েছে অভূতপূর্ব। ‘আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে দেশের মানুষ কিছু পায়’ বলে শেখ হাসিনা প্রায়ই যে কথা বলে থাকেন, সেটা কথার কথা নয়। শেখ হাসিনা প্রথম মেয়াদে ক্ষমতায় এসেছিলেন ১৯৯৬ সালে। প্রথম এবং দ্বিতীয়বার ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মানুষের মাথাপিছু আয় থেকে শুরু করে সামাজিক সূচকের প্রায় সবগুলোতেই ভালো অবস্থানে পৌঁছেছি আমরা। গড় আয় এখন ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলার। গড় আয়ু প্রায় ৭৩ বছর। শিশুমৃত্যু ও মাতৃমৃত্যুর হারও অনেক কমেছে। কৃষি উৎপাদনেও বাংলাদেশের উন্নতি চোখে পড়ার মতো। আয়তনের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বিশ্বে ৯৪তম; কিন্তু চাল উৎপাদনে অবস্থান তৃতীয়। মাছ উৎপাদনে তৃতীয়, আলু উৎপাদনে সপ্তম, ডিম ও মাংস উৎপাদনে ২৯তম, ফল উৎপাদনে ৩৭তম। সরকারের নীতি ও পরিকল্পনার কারণেই এমন সমৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে। বাংলাদেশ ঘনবসতির দেশ; আয়তনের তুলনায় মানুষ অনেক বেশি। কৃষিজমির পরিমাণ কমে আসা সত্ত্বেও উৎপাদন যে বাড়ছে, এর জন্য অবশ্যই সাধারণ মানুষের শ্রম দেওয়ার মনোভাব বড় কারণ। একই সঙ্গে বীজ, সারসহ কৃষি উপকরণে সরকারের ভর্তুকি প্রদান এবং সময়মতো সরবরাহ নিশ্চিত করার নীতিও গুরুত্বপূর্ণ। উপমহাদেশে, এমনকি ভারতের তুলনায় সামাজিক সূচকে বাংলাদেশের অগ্রগতি চোখে পড়ার মতো। জাতিসংঘ মহাসচিবও বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য বাংলাদেশকে রোল মডেল হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

যোগাযোগ ব্যবস্থায় বাংলাদেশের অগ্রগতিও বিস্ময়কর। গত বছর ২৫ জুন জনগণের চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে স্বপ্নের পদ্মা সেতু। পৃথিবীর নদীসমূহের মধ্যে পদ্মাই বেশি খরস্রোতা। এ নদীতে সেতু নির্মাণ সহজ ছিল না। তারপরও পদ্মায় সেতু হয়েছে এবং সেটা নিজস্ব অর্থায়নে। পদ্মা সেতু নির্মাণ যাতে না হয়, তার জন্য দেশের ভেতরে ও বাইরে কম ষড়যন্ত্র হয়নি। বিশ্বব্যাংক থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থাগুলো অর্থায়ন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু বানানোর ঘোষণা দিলে অনেকে একে অসম্ভব বলে উল্লেখ করলেও সেই ‘অসম্ভব’কে সম্ভব করে তুলেছেন শেখ হাসিনা। পদ্মা সেতু এখন বাংলাদেশের সক্ষমতা ও গৌরবের প্রতীক। এটি চালু হওয়ায় দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের জীবনে শুধু নতুন দিন আসেনি, এর ফলে দেশের অর্থনীতিতেও গতিবেগ সঞ্চার হতে শুরু করেছে। শুধু পদ্মা সেতু নয়, শেখ হাসিনার আমলে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থায় নতুন দিগন্তের উন্মোচন হয়েছে। গত নভেম্বরেই উদ্বোধন হয়েছে ছোট-বড় ১০০টি সেতু। ২৮ ডিসেম্বর উদ্বোধন হয়েছে মেট্রোরেল। এটি পুরোপুরি চালু হলে রাজধানীর যানজট নিরসনে মেট্রোরেল বড় ভূমিকা রাখবে। অল্প সময়ের মধ্যেই চালু হবে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল। এসব বড় প্রকল্পে দুর্নীতি, সময়মতো সম্পন্ন করতে না পারাসহ কিছু সমালোচনা নেই, তা নয়। এগুলো এড়াতে পারলে নিশ্চয়ই ভালো হতো। তবে ওইসব সমালোচনা সত্ত্বেও এটা বলতে হবে, এগুলো না হলে আমরা অহংকার করে নিজেদের বড় বলতে পারতাম না। শেখ হাসিনার সাহস ও দূরদর্শিতার কারণেই বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হতে পেরেছে এবং আরও কিছু বাস্তবায়নের পথে আছে। বড় কিছু করতে গেলে বড় মন থাকতে হয়, থাকতে হয় দেশপ্রেম ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা। শেখ হাসিনা এসব গুণের অধিকারী বলেই তাকে বিকল্পহীন নেতা ভাবা হচ্ছে। এটা নিয়ে ইচ্ছা করলে কেউ বিতর্ক করতে পারেন। তবে আমি মনে করি, শেখ হাসিনার সরকারের বিরুদ্ধে বিএনপির আন্দোলন সফল না হওয়ার একটি বড় কারণ তার প্রতি জনগণের আস্থা এবং একই সঙ্গে বিরোধীদের প্রতি অনাস্থা ও অবিশ্বাস।

সেজন্য শেখ হাসিনা ও তার সরকারের সামনে কোনো চ্যালেঞ্জ নেই, সেটাও মনে করি না। নতুন বছরে শেখ হাসিনা, তার সরকার ও দল হিসেবে আওয়ামী লীগের সামনে কতগুলো বড় চ্যালেঞ্জ আছে। এগুলো সফলতার সঙ্গে মোকাবিলা করতে না পারলে আগামী বছরের শুরুতে দেশে যে জাতীয় নির্বাচন হবে, তাতে বিজয় অর্জন সহজ হবে না।

শেখ হাসিনার সামনের চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে আমি এখানে সামান্য আলোকপাত করতে চাই। পরবর্তী নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ বিজয়ী হোক এবং দেশের সমৃদ্ধি যাত্রা অব্যাহত থাকুক- এটা দেশের সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা। এটাও মনে রাখতে হবে, নানা কারণে আগামী নির্বাচন হবে কঠিন। আগের দুটি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যেহেতু সমালোচনা ও বিতর্ক আছে, সেহেতু আগামী নির্বাচনে বিদেশিদের যেমন নজর থাকবে, তেমনি নজর থাকবে দেশের মানুষের। বিএনপির পছন্দমতো সরকারের অধীনে নির্বাচন যদি নাও হয়, তবু পরেরটা আগের মতো সহজ জয়ের নির্বাচন হবে না।

শেখ হাসিনার প্রতি যেমন মানুষের আস্থা আছে, তেমনি নানা কারণে আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের কিছু আস্থাহীনতাও তৈরি হয়েছে। শেখ হাসিনা ম্যাজিকে সব বিপদ থেকে রেহাই পাওয়ার যে মানসিকতা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে গড়ে উঠেছে, তা ক্ষতিকর- এটাও বলতে হয়। আগামী নির্বাচন যে সহজ হবে না, তার একটি ছোট উদাহরণ রংপুর সিটি নির্বাচনে দেখা গেল। রংপুর সিটিতে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী চতুর্থ স্থানে আছেন। আওয়ামী লীগের একজন বিদ্রোহী প্রার্থীও নৌকা মার্কার চেয়ে বেশি ভোট পেয়েছেন। এমন পরাজয় প্রত্যাশিত ছিল না। এর কারণ অনুসন্ধানে অবশ্যই মনোযোগী হতে হবে।

সরকার পরিচালনায় শেখ হাসিনা যতটা সফল, দল গোছানোর ক্ষেত্রে ততটা এগিয়ে আছেন বলে অনেকে মনে করেন না। আওয়ামী লীগ দলগতভাবে কিছুটা এলোমেলো অবস্থায় আছে বলেও অনেকে মনে করেন। জাতীয় সম্মেলনে যে নতুন কমিটি হয়েছে, সেখানে কোনো উল্লেখ করার মতো পরিবর্তন নেই। বলা হচ্ছে, পুরোনোদের ওপরই শেখ হাসিনা আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য আস্থা রেখেছেন। এখন এই পুরোনো টিম তার আস্থার কী প্রতিদান দেবে, তা দেখার বিষয়। তবে আগামী নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়নের সময় খুব সতর্ক থাকতে হবে। একাধিকবার নির্বাচিত বা প্রথমবার নির্বাচিত হওয়ার পরও যাদের জনগণের সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা তৈরি হয়েছে কিংবা যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অনিয়মের ব্যাপক অভিযোগ আছে, তাদের বাদ দিয়ে ক্লিন ইমেজের প্রার্থী বেছে নিতে হবে। আর বর্তমান মন্ত্রিসভার মেয়াদের শেষ বছর উন্নয়নের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার পাশাপাশি দলের মধ্যে শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে হবে।

আগামী নির্বাচনের আগে দেশের মানুষের মনে অসন্তোষ তৈরি হয়, এমন কিছু করা থেকে সরকারকে বিরত থাকতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যদি ক্রমাগত বাড়তে থাকে, মানুষ যদি সারাক্ষণ অসহায় বোধ করতে থাকে, তাহলে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ বাড়বে। তাদের কর্মসংস্থান ও আয় বাড়ানোর উদ্যোগও নিতে হবে। আর বিরোধী দল যেন সরকারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের সুযোগ না পায়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ সংকুচিত হয়েছে বলে বিএনপির প্রচারণার যুৎসই জবাব সরকার পক্ষ থেকে দিতে হবে। বিএনপি নিজেই যে একটি গণতান্ত্রিক দল নয়, তা তাদের শাসনামলের বিভিন্ন ঘটনা থেকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা মোটেও কঠিন নয়। ২০০১ ও ২০১৪ সালে বিএনপি-জামায়াত যে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি তৈরি করেছিল, তা কি ভুলে যাওয়ার মতো?

বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন জমাতে চাইছে। মিত্র বাড়াতে সচেষ্ট আছে তারা। কিছু প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশের কূটনীতিক তাদের ছাতা দিচ্ছেন। এসব বিষয় ছোট বৈকি, তবে ছোট বিষয়গুলো যেন বড় হয়ে দেখা না দেয়। সরকারের মেয়াদ পূর্ণ করা কোনো অসম্ভব কাজ নয়। তবে আরেক দফা ক্ষমতায় ফিরে আসাটা চ্যালেঞ্জিং বলেই মনে হচ্ছে।