শেখ হাসিনার জাদুর পরশে অনন্য উচ্চতায় বাংলাদেশ

জুনাইদ আহমেদ পলক
Published : 26 Nov 2021, 02:23 PM
Updated : 26 Nov 2021, 02:23 PM

৫০ বছরের বাংলাদেশ। মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টা হেনরি কিসিঞ্জারের কথিত তলাবিহীন ঝুড়ির দেশ এখন বিশ্বে উন্নয়নের বিস্ময়। যে বাংলাদেশ নিয়ে প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অস্টিন রবিনসন 'ইকোনমিক প্রসপেক্টাস অব বাংলাদেশ' গ্রন্থে বাংলাদেশের টিকে থাকা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন সেই দেশ ২০১৫ সালেই মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়। শুধু দক্ষিণ এশিয়া নয় বিশ্বের ১০টি দরিদ্রতম দেশের একটি ছিল বাংলাদেশ। দারিদ্রের হার ছিল ৮৮ শতাংশ। বৈদেশিক সাহায্য নির্ভরতা ছিল ৮৮ শতাংশ। বৈদেশিক সাহায্য নির্ভর সেই বাংলাদেশ এখন বাণিজ্যনির্ভর। বিশ্বে বর্তমানে ৪১তম অর্থনীতির দেশ। ব্রিটেনের অর্থনৈতিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চ (সিইবিআর) এর মতে, বর্তমান ধারায় অর্থনৈতিক বিকাশ অব্যাহত থাকলে ২০৩৫ সাল নাগাদ বাংলাদেশ বিশ্বে ২৫তম অর্থনীতির দেশে পরিণত হবে। বিশ্বে বাংলাদেশের পরিচয় এখন উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে। স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশের এমন একটি পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার জন্য যাত্রা পথ সহজ ছিল না। স্বাধীনতাবিরোধী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সহযোগিতায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সামরিক স্বৈরশাসক ও আধা গণতন্ত্রীরা ৫০ বছরের অর্ধেকেরও বেশি সময় জুড়ে রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকায় দেশের উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রা উল্টো ধারায় প্রবাহিত হয়। কিন্তু কী এমন জাদু যার পরশে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বাংলাদেশ আজ অনন্য উচ্চতায়। বিশ্ব মর্যাদার আসনে সমাসীন। এই জাদু আসলে শেখ হাসিনার নেতৃত্বের তিনটি অসাধারণ গুণ। আর তা হচ্ছে তার সততা, সাহস এবং দূরদর্শিতা। 

শেখ হাসিনার জাদু নিয়ে আলোচনার আগে ৫০ বছরের পথ চলায় সদ্য স্বাধীন দেশের বাস্তবতায় দূরদর্শী ও প্রজ্ঞাবান নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণের উদ্যোগ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোকপাত করতে চাই।  বঙ্গবন্ধু যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুণর্গঠনের পাশাপাশি সুপরিকল্পিত অর্থনৈতিক কার্যক্রম শুরু করেছিলেন। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (১৯৭৩-১৯৭৮) ঘোষণা করেন। প্রতি বছর সাড়ে ৫ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। অবাক করার বিষয় পরিকল্পনা প্রণয়নের দ্বিতীয় বছরে (১৯৭৪-১৯৭৫) বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি সাড়ে ৯ শতাংশ অর্জিত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশে আজও পরযন্ত রেকর্ড জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের এই উন্নয়নের ধারাকে থামিয়ে দেয় দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীরা। ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশের অর্থনীতি নিমজ্জিত হয় এক গভীর অন্ধকারে। থেমে যায় সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলা বিনির্মাণ। দীর্ঘ ২১ বছর স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির সহযোগিতায় বাংলাদেশ শাসিত হয় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সামরিক শাসকদের দ্বারা। 

১৯৮১ সালে জাতির পিতা রক্তের সুযোগ্য উত্তরসূরী বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্নের লালনকারী জননেত্রী শেখ হাসিনা ছয় বছরের নির্বাসিত জীবন শেষে দেশে ফেরেন। শুরু করেন স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন। দেশের জনগণ তার ওপর  আস্থা রাখে। তার নেতৃত্বে ২১ বছরের স্বৈরশাসনবিরোধী গণতান্ত্রিক সংগ্রামে জনগণ শামিল হয় এবং ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে তাকে ক্ষমতাসীন করে। শুরু হয় বাংলাদেশের অর্থনীতির নবযাত্রা। ১৯৯৬-২০০১ সময়ে গড় জিডিপি ছিল সাড়ে ৫ শতাংশ। মূল্য স্ফীতি ছিল ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াতের শাসনসহ ৮ বছরে অর্থনৈতিক ক্রমবিকাশের ধারায় ছেদ পড়ে। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা আবারও ক্ষমতাসীন হন। তাঁর টানা তিন মেয়াদের শাসনের এক যুগ পার হয়েছে। বিগত বার বছরে গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (জিডিপি) ছিল ৬ দশমিক ৬ শতাংশ। ২০১৬-১৭ অর্থবছর থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ শতাংশের উপরে এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ শতাংশ অতিক্রম করে। ২০০৫-২০০৬ সালে মাথাপিছু আয় ছিল ৫৪৩ ডলার বর্তমানে তা ২৫৫৪ ডলার। ওই সময়ে দারিদ্রের হার ছিল ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ, করোনাভাইরাস অতিমারীর আগে তা কমে দাঁড়ায় ২০ দশমিক ৫ শতাংশে। জিডিপির আকার ছিল ৪ লাখ ৮২ হাজার ৩শ'৩৭ কোটি। বর্তমানে তা ২৮ লাখ কোটি টাকা। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল শূন্য দশমিক ৭৪৪ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ ১ বিলিয়ন ডলারের কম, বর্তমানে তা ৪৫ বিলিয়ন ডলার। ২০০৫-২০০৬ অর্থবছরে বাজেটের আকার ছিল ৬১ হাজার কোটি টাকা, যা বর্তমানে ১০গুণ বেশি। ওই সময়ে গড় আয়ু ছিল৫৯ বছর বর্তমানে ৭২ দশমিক ৬ বছর। শিশু মৃত্যুর হার ৮৪ থেকে কমে হয়েছে ২৮ এবং মাতৃমৃত্যুর হার ৩শ'৭০ থেকে কমে ১৬৫ হয়েছে। ২০০৫-২০০৬ সালে খাদ্য উৎপাদন ছিল ১ কোটি ৮০ লাখ মেট্রিক টন। আর বর্তমানে তা ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৪ হাজার মেট্রিক টন। ওই সময় বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯শ' মেগাওয়াট আর বর্তমানে তা ২৫ হাজার ২শ'২৭ মেগাওয়াট।

আমি আগেই উল্লেখ করেছি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার  সততা, সাহসিকতা ও দূরদর্শিতার কথা। আসলে এই তিন গুণের জাদুর পরশেই দেশ আজ অনন্য উচ্চতায়। এ নিয়ে আমি সংক্ষেপে প্রথমেই তুলে ধরছি তার সততার কথা। আমরা জানি যে, বিশ্বে সৎ রাষ্ট্রনায়কদের একজন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার সততার অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। কিন্তু যে ঘটনাটি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে তার স্বচ্ছ ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করেছে তা হচ্ছে পদ্মা সেতু নির্মাণে বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতির অভিযোগের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেওয়া। বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতু প্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ এনে ঋণ বাতিল করে। প্রধানমন্ত্রী সেদিন বলেছিলেন এক টাকাও দুর্নীতি হয়নি। জাতীয় সংসদে তিনি আরও ঘোষণা দেন যে, "আমরা নিজেদের অর্থে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন করবো।" শেষ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথাই সত্য প্রমাণিত হয়। এমনকি কানাডার আদালতও রায় দিয়ে বলেছে যে, পদ্মা সেতুতে কোন দুর্নীতি হয়নি। আর বর্তমানের বাস্তবতা হচ্ছে, বাংলাদেশ তাঁর নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ করেছে। কিন্তু এই সেতুকে নিছক একটি সেতু হিসেবে দেখলে হবে না এটিকে দেখতে হবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সততার মূর্ত প্রতীক হিসেবে। 

দ্বিতীয়ত, সাহসিকতা। বাঙালির ইতিহাসের দুটি কলঙ্কময় ঘটনা ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধ ও ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা। মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি দীর্ঘ সময় জুড়ে ক্ষমতায় থাকায় বাঙালির জাতির এই কলঙ্ক মোচনের কোন উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তারা বিচারতো করেইনি বরং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও পঁচাত্তরের হত্যাকারীদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন ও ক্ষমতার অংশীদার করে। জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ এবং খালেদা জিয়া দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চালু করেন। জিয়া ইডেমনিটি অধ্যাদেশের বৈধতা দিয়ে বঙ্গবন্ধু ও জেল খানায় জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচারের পথ রুদ্ধ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধী এবং পঁচাত্তরের ঘাতকদের বিচারের উদ্যোগ নিয়ে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দেন। দেশি-বিদেশি প্রবল চাপ থাকা সত্বেও সাহসের সাথে যুদ্ধাপরাধী ও পঁচাত্তরের খুনিদের বিচার করে জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করেন। বিচারহীনতার সংস্কৃতির চির বিলোপ করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।

তৃতীয়ত, দূরদর্শিতা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী চিন্তা ও স্বপ্নের ফসল ডিজিটাল বাংলাদেশ। ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর দেশের প্রাচীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার দিন বদলের সনদ রূপকল্প ২০২১ এর মূল উপজীব্য হিসেবে এর আবির্ভাব। আর এই দিনবদলের সনদে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণকে অন্তর্ভুক্ত করায় যিনি মূখ্য ভূমিকা পালন করেন তিনি খ্যাতিমান তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ জনাব সজীব ওয়াজেদ জয়। তিনি ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের আর্কিটেক্ট। বিগত প্রায় তের বছর ধরে তিনি সামনে থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়ন ও অঙ্গীকার পূরণ করেছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণা যে কতোটা দূরদর্শী ছিল তা আজ এর সফল বাস্তবায়নে প্রমাণিত। কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ এমন কোন খাত নেই যেখানে প্রযুক্তিনির্ভর সমাধান হচ্ছে না। দেশে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের ডিজিটাল অর্থনীতি গড়ে উঠেছে। মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছে সরকারি-সেরকারি নানা সেবা। প্রযুক্তি ব্যবহারে মানুষের অভিযোজন ও সক্ষমতায় গ্রাম ও শহরের বৈষম্য দূর হচ্ছে। সামাজিক সাম্য প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি। আর তাই বলা হচ্ছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার আধুনিক রূপ ডিজিটাল বাংলাদেশ। 

ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দূরদর্শিতার দিক থেকে বিশ্বের অনেক দেশ ও রাষ্ট্রনেতাদের চেয়ে যে এগিয়ে তারও প্রমাণ আমাদের সামনে রয়েছে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে ডিজিটাল ইন্ডিয়া প্লান ঘোষণা করেন। এর আগে ব্রিটেন পরিকল্পিতভাবে ডিজিটালাইজেনের কার্যক্রম শুরু করে। আর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশের বাস্তবায়ন তাদের অনেক আগে ২০০৯ সালে। শুধু ডিজিটাল বাংলাদেশ নয়, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে ভিশন ২০৪১ ও ভিশন ২০৩০ এর বাস্তবায়ন করছেন। ডেল্টা এলাকার উন্নয়নে বাস্তবায়ন করছেন ডেল্টা প্লান ২১০০।

২০২১ সালে মহাকালের দুই মহান ধারা একই মোহনায় এসে উপনীত। আমরা উদযাপন করছি স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী। এই সময়ে বাঙালি জাতির জীবনের অর্জনের তালিকা অনেক সমৃদ্ধ। আমরা মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে উত্তরণে জাতিসংঘের সুপারিশ পেয়েছি। ন্যায্য, সত্য ও মানুষের কল্যানের পক্ষে সোচ্চার দূরদর্শী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামীতে আবারও ক্ষমতাসীন হলে ২০২৬ সালেই আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি হবে উন্নয়নশীল দেশ। আর ২০৪১ এর আগেই হবে উন্নত দেশ।