অর্থহীন পৃথিবী: বৃত্তের গোলক ধাঁধায় সার্ত্রে, কামু, ওয়ালীউল্লাহ ও বাদল সরকার

মোস্তফা সারওয়ারমোস্তফা সারওয়ার
Published : 8 Nov 2021, 02:25 PM
Updated : 8 Nov 2021, 02:25 PM

অস্তিত্ববাদ একটি দার্শনিক তত্ত্ব এবং সাহিত্যিক দৃষ্টিভঙ্গি। এর মূল প্রতিপাদ্য হল- পৃথিবী নিরর্থক। অর্থহীন বিশ্বের অন্তর্লীন অর্থ খুঁজে পাওয়ার প্রচেষ্টা মূল্যহীন। তথাপি জীবনের মূল্য রয়েছে। তাই মানুষ নিজস্ব পরিবেশ ও পরিস্থিতিতে জীবনের অর্থ ও মূল্য খুঁজে বের করার প্রচেষ্টায় রত। অস্তিত্ব রক্ষায় মানুষ তার চেতন-অবচেতনে নিজেই জীবনের অর্থ তৈরি করে নেয় এবং তার প্রয়োগ ঘটায় কাজের মাধ্যমে।

কিছুটা ভিন্নতর দর্শন হল কিমিতিবাদ অথবা অ্যাবসার্ডবাদ। এই দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী জীবনের অর্থ খোঁজার চেষ্টা না করে নিরর্থক জীবনের প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হবে। যখন কোনো ঘটনার কার্যকারণ অথবা শৃঙ্খলা খুঁজে পাওয়া যায় না, তখন তাকে অ্যাবসার্ড অথবা উদ্ভট বলা যেতে পারে। যুক্তিহীন বিশ্বে ক্রমাগত প্রচেষ্টায় জীবন যাপন করাই কিমিতিবাদ অথবা অ্যাবসার্ডবাদ-এর প্রতিপাদ্য। অ্যাবসার্ডবাদের প্রতিভূ হলেন আলবের কামু।

সাহিত্যে অস্তিত্ববাদের প্রয়োগে সবচেয়ে সার্থক জাঁ পল সার্ত্রে। তার মতে existence precedes essence- সত্তার আগে অস্তিত্ব অথবা বিরাজমানতা। আমরা জন্মেছি, অতএব আমরা বিরাজমান, আমরা আমাদের সত্তা এবং জীবনের উদ্দেশ্য ও কর্মপ্রবাহ নির্ধারণ করব জন্মের পর। জাঁ পল সার্ত্রের উপরোক্ত ধারণা আমি প্রাণী জগতে প্রয়োগ করব মানুষের আবির্ভাবের পাঁচ শত একচল্লিশ মিলিয়ন বছর আগে। তখন পৃথিবীতে প্রথম চক্ষুর আবির্ভাব ঘটে ট্রায়লোবাইট নামে এক ধরনের জলজ ঘুণপোকায়। অতএব অস্তিত্ব পেল চোখওয়ালা জলজ ঘুণপোকা, ট্রায়লোবাইট। এর পরই এলো এর নতুন সত্তা– অনেকটা যুদ্ধ বিজয়ের সত্তা। চোখওয়ালা জলজ ঘুণপোকা, ট্রায়লোবাইট, চোখহীন অন্য প্রাণীদের পরাভূত করে বিশ্ব জয় করে ছড়িয়ে পড়ল পৃথিবীর আনাচে কানাচে। তখন পৃথিবীর প্রাণীরা ছিল প্রধানতঃ জলজ। জলবায়ুর মারাত্মক পরিবর্তনে দুই শত বাহান্ন মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে আসে এক নিদারুণ ধ্বংসযজ্ঞ। ট্রায়লোবাইট সহ শতকরা নব্বই ভাগ প্রাণী নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এক কালের বিশাল বিজয়ী ট্রায়লোবাইটের জন্য শেষ পর্যন্ত পৃথিবী নিরর্থক। আজ পৃথিবীর আনাচে কানাচে শিলা-প্রস্তরে পিষ্ট হয়ে আছে অসংখ্য ট্রায়লোবাইট। তাই আমার মনে হয়েছে:

অন্যান্যদের মতো তুমি জীবাশ্ম হয়ে লেপ্টে আছো;

কোটি কোটি বছরের বিধ্বংসী ক্ষয়িষ্ণুতা

এক মোলায়েম মার্কসীয় সমতার আভরণে

ঢেকেছে তোমাকে

অপরের সাথে তুমি এক হয়ে গেছো

তুমি সম্রাট, সন্ন্যাসী, প্রচারক অথবা সাধারণ প্রেমিক

… এর কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই

শুধু শিলা-প্রস্তরে পিষ্ট হয়ে আছো …

কোটি কোটি বছর লীন হয়ে গেছে

সময়ের এক অনিরুদ্ধ ক্যারাভ্যানে।

(কবি মোস্তফা সারওয়ার। কবিতার নাম: জীবাশ্ম। কবিতার বই: অনুলিপি অন্তরঙ্গ মুহূর্তে। পৃষ্ঠা ১৬ – ১৭)

জাঁ পল সার্ত্রে এবং আলবের কামু বিশ্বাস করতেন মানুষের সমাপ্তি মৃত্যুতে। স্পেস টাইম কন্টিনিউয়ামের অনিরুদ্ধ ক্যারাভ্যানে মানুষের পৃথিবী নিরর্থক। ট্রায়লোবাইটের নিরর্থক পৃথিবীর মতোই। উভয়েই ফরাসি লেখক। এক সময়ে নিদারুণ বন্ধু ছিলেন। পরে রাজনৈতিক মতবাদের ভিন্নতা তাদের বন্ধুত্বে বিনাশ ঘটায়। সার্ত্রে ছিলেন আট বছরের বড়। দুজনেই সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। কামু পেয়েছেন ১৯৫৭ সালে আর অগ্রজ সার্ত্রে ১৯৬৪ সালে। সার্ত্রে নোবেল পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। সাহিত্যের বাইরে দর্শন শাস্ত্রে তার বিহার ছিল তুলনাবিহীন। সত্যিকার অর্থে সব্যসাচী।

অস্তিত্ববাদ ও কিমিতিবাদ অথবা অ্যাবসার্ডবাদের মূলে রয়েছে উদ্বেগ। আর এখানেই আসছেন ডেনিশ দার্শনিক সোরেন কিয়ের্কেগার্ড। জাঁ পল সার্ত্রে এবং আলবের কামুর প্রায় একশ বছর আগে ১৮৪৪ সালে কিয়ের্কেগার্ড লিখেছেন "The Concept of Anxiety." কার্যকারণ যুক্তি-শৃঙ্খলা যেখানে নেই; মানব অস্তিত্বের অসাড়তা ও উদ্দেশ্যহীনতাই যেখানে বাস্তব; সেখানে উদ্বেগের নিদারুণ বিহার। এটাই স্বাভাবিক। উদ্বেগ, অপরাধবোধ ও মৃত্যু– মানুষের অস্তিত্বের সাথে যুক্ত। অনেকেই সোরেন কিয়ের্কেগার্ডকে অস্তিত্ববাদের জনক বলে অভিহিত করেছেন।

সাহিত্য ও দর্শন শাস্ত্রের ঐতিহাসিক পটভূমিতে অস্তিত্ববাদ একটি বৃহত্তর সাহিত্যিক ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি। যেখানে কিয়ের্কেগার্ড, নীট্‌সে, হুসার্ল, হাইদেগার, বোভেয়ার, মার্লো-পন্টি-এর অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।

জাঁ পল সার্ত্রে এবং আলবের কামু ছাড়াও সাহিত্যে অস্তিত্ববাদের প্রয়োগ করেছেন দস্তয়েভস্কি, ফ্রাঞ্জ কাফ্‌কা, সিমন দ্য বোভেয়ার, আঁদ্রে মারলো, স্যামুয়েল বেকেট, এডওয়ার্ড এলবি, হ্যারল্ড পিন্টার। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে: আঁদ্রে মারলো বৃদ্ধ বয়সেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে সৈনিক হিসেবে অংশগ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। স্প্যানিশ গৃহযুদ্ধে তিনি সম্মুখ সৈনিক হিসেবে যোগদান করেছিলেন।

ভারতীয় সাহিত্যে অস্তিত্ববাদের উল্লেখযোগ্য পরীক্ষা, নিরীক্ষা ও প্রয়োগ হয়েছিল বিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে। উল্লেখ করা যায়: পশ্চিম বাংলার বাদল সরকারের নাটক 'এবং ইন্দ্রজিত'; মারাঠি নাট্যকার মহেশ এলো কুঞ্জওয়ারের 'প্রতিবিম্ব' এবং চিন্তামানী খান্‌লকারের 'এক শূন্য বাজিরাও'; উড়িষ্যার মনোরঞ্জন দাশের নাটক 'অরণ্য ফসল'। বাংলা সাহিত্যে বিক্ষিপ্তভাবে দেখতে পাই পাশ্চাত্যের দার্শনিক প্রজ্ঞার বিহার ও প্রয়োগ। সফল উপন্যাসের জনরায় পশ্চিম বাংলা থেকে উল্লেখ করা যেতে পারে সমরেশ বসুর 'বিবর', জগদীশ গুপ্তের 'নিদ্রিত কুম্ভকর্ণ' ও 'অসাধু সিদ্ধার্থ', মানিক বন্ধোপাধ্যায়ের 'দিবারাত্রির কাব্য', বিমল করের 'নির্বাসন', বুদ্ধদেব বসুর 'শেষ পান্ডুলিপি'; কবিতায় সুধীন্দ্রনাথ দত্তের 'দশমী' এবং নাটকে বাদল সরকারের 'এবং ইন্দ্রজিত' এবং 'বাকি ইতিহাস'। বাংলাদেশে পুরোধা হলেন নাটকে সেলিম আলদীন ও আলী জাকের, উপন্যাসে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, ছোট উপন্যাসে জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, কবিতা ও উপন্যাসে সৈয়দ শামসুল হক।

যদিও বাংলার চিরন্তন আধ্যাত্মিক সংস্কৃতিতে অস্তিত্ববাদের বিপ্রতীপ অনুষঙ্গই বিদ্যমান। তথাপি জীবনানন্দ দাশের অনেক কবিতায় ইঙ্গিত রয়েছে অস্তিত্ববাদের অপার তরঙ্গ। জীবনানন্দ দাশের কবিতায় মৃত্যু এসে হানা দেয় অদ্ভুত নৃত্যে। তার কবিতায় বার বার মৃত্যু আমাদের জানিয়ে দিচ্ছে নিরর্থক পৃথিবীতে আমাদের অস্তিত্বের অর্থহী্নতা। চরম নিঃসঙ্গতায় আমার নিজেরই মনে হয় আমি সাজিয়ে দেই তারই চিত্রকল্পে আমার পূজার অঞ্জলি-

জীবনের দুর্বহ ভারে ক্লান্ত পথিক পরিত্রাণ খোঁজে

ট্রামের চাকার নিচে হিম অন্ধকারে,

যেখানে শ্রাবস্তীর মতো মরেছিল নীল জোছনারা।

ধানসিঁড়ি নদীটির পাশে এই নিদারুণ অন্ধকারে

চিরদিন চেয়েছিলে ঘুমোতে এরূপ?

লক্ষ্মীপেঁচা, গাঙচিল আর গঙ্গাফড়িঙ যেন চেয়ে দেখে

চন্দনকাঠের চিতা,

হলদে লালের অপরূপ করুণ আলোক।

(কবি মোস্তফা সারওয়ার। কবিতার নাম: শবযাত্রা, অবিরাম ঘুমে – জীবনানন্দ দাশের উদ্দেশ্যে। কবিতার বই: অনুলিপি অন্তরঙ্গ মুহূর্তে। পৃষ্ঠা ৫৩)

অস্তিত্বের অর্থহীনতায় মৃত্যুর পরম্পরায় জীবনানন্দ দাশের অবগাহন থেকে ভিন্নতর অনুষঙ্গ বেঁচে থাকার জন্য (অথবা অস্তিত্বের তাগিদে) মূল্যবোধের অবক্ষয়ের অনবদ্য চিত্র এঁকেছেন বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ। তার প্রকাশিত মৌলিক গ্রন্থ হলো তিনটি উপন্যাস, তিনটি নাটক ও দুটো গল্পগ্রন্থ। ঊনপঞ্চাশ বছর জীবনের অন্যতম সৃজনশীল সময়ে ছিলেন প্রবাসী– তার সমাধি প্যারিসে। তৎকালীন পূর্ব বাংলার কথা-সাহিত্যে তিনি আধুনিক ধারার অগ্রপথিক। 'লালসালু', ইংরেজি অনুবাদ 'Tree Without Roots'– এক অনবদ্য সৃষ্টি। শক্ত হাতে উত্থাপন করেছেন ধর্মের নামে অন্ধ বিশ্বাস ও কুসংস্কার। নিদারুণ প্রতিকূল পরিবেশে নিজের অস্তিত্বের জন্যে এক সিদ্ধহস্ত ভণ্ড 'মজিদ' হলো উপন্যাসের মূল চরিত্র।

মজিদের পৃথিবীর মূল্যহীনতা দিয়েই শুরু করেছেন ওয়ালিউল্লাহ, "শস্যহীন, জনবহুল এ অঞ্চলের বাসিন্দাদের বেরিয়ে পড়বার ব্যাকুলতা ধোঁয়াটে আকাশকে পর্যন্ত যেন সদাসন্ত্রস্ত করে। ঘরে কিছু নেই। ভাগাভাগি, লুটালুটি আর স্থান বিশেষে খুনাখুনি করে সর্বপ্রচেষ্টার শেষ।"

শস্য নেই, ক্ষুধা, সংঘাত, "উদাসীন দুনিয়া"– ভীষণ বৈরী। মজিদের এই মূল্যহীন পৃথিবী যেন সার্ত্রের 'নসিয়া' উপন্যাসের 'আঁতোয়ান রোঁকোতঁ' অথবা কামুর 'সিসিফাস'-এর অর্থহীন পৃথিবীর ঝাপসা প্রতিবিম্ব। শূন্যতা ও জীবনের অর্থহীনতার ভারে আক্রান্ত মজিদ। লালসালু-ঢাকা মাজারের ছদ্ম বিশ্বাসকে পুঁজি করে জীবনকে অর্থযুক্ত করার প্রচেষ্টায় মজিদ রত। সে বিরাজমান এক মানুষ– অর্থহীন পৃথিবীতে। সেখানে তার নিজস্ব স্বাধীন পছন্দকে, সেটা যতই কলুষিত হোক না কেন, বেছে নিয়ে তার সত্ত্বার বহিঃপ্রকাশ।

নিজের অন্নহীন, গৃহহীন, সংঘাতপূর্ণ, আশাহীন গ্রাম ছেড়ে প্রথম গারো পাহাড়ের প্রায় নির্জন অরণ্যে সে আস্তানা গাড়ল। সেখানে ভাগ্যক্রমে হঠাৎ দেখা হলো শিকাররত এক সরকারি কর্মচারীর সাথে। পরিচয়ে জানতে পারল কর্মকর্তার পরিবারের আদি নিবাস ছিল মহব্বতপুর নামক এক গ্রামে। অন্যান্য শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারের মতো ঐ সরকারি কর্মচারীর পরিবার মহব্বতপুর গ্রাম ছেড়ে দিয়ে তখন শহরে প্রতিষ্ঠিত। ধূর্ত মজিদের মনে দোলা দিল এক দুষ্ট বুদ্ধি। মজিদের আগমন ঘটল সেই মহব্বতপুরে; সেখানে ওই সরকারি কর্মচারীর পরিবার দ্বারা পরিত্যক্ত ছাড়া বাড়ির কবরকে সে বানিয়ে ফেলল মাজার। গ্রামবাসীদের অশিক্ষা ও অন্ধ কুসংস্কারকে পুঁজি করে মিথ্যা ও ঠকবাজির বেসাতিতে শুরু করল তার নবজীবনের যাত্রা। তার অস্তিত্বের জন্য এটা তার নিজস্ব স্বাধীন সিদ্ধান্ত– যেটা অস্তিত্ববাদী সাহিত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। ধান্ধাবাজ মজিদ মাজারের নামে গ্রামবাসীদের ঠকিয়ে হয়ে উঠল বিত্তশালী সংসারী। সংসারে যোগ হলো দুজন স্ত্রী রহিমা ও জামিলা। উপন্যাসের শেষ প্রান্তে এক নিদারুণ ঝড়, বন্যা ও শিলাবৃষ্টিতে পুরো গ্রাম বিধ্বস্ত হয়ে যায়।

মজিদ তার অস্তিত্বের জন্য ব্যবহার করল গ্রামের মোড়ল খালেককে। এই উপন্যাসে অস্তিত্ববাদী উপকরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কিন্তু সার্ত্রের 'নসিয়া', কামুর 'ক্যালিগুলা' অথবা স্যামুয়েল বেকেটের 'ওয়েটিং ফর গডো'-এর মতো অস্তিত্ববাদী দার্শনিক আলোচনার অভিসার নেই। 'লালসালু' এক অপূর্ব উপন্যাস। কিন্তু ইউরোপীয় অস্তিত্ববাদের প্রয়োগ দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করলে অস্তিত্ববাদী উপন্যাস হিসেবে উত্তরণ কিছুটা প্রশ্নবিদ্ধ। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে তানভীর মোকাম্মেলের পরিচালনা-প্রযোজনা-চিত্রনাট্যে 'লালসালু'র চলচ্চিত্রায়ন অর্জন করেছে শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

এবার আসা যাক নাটকে। বাংলা নাটকে অ্যাবসার্ড নাট্য আঙ্গিকের সূচনা ঘটেছিল বাদল সরকারের রচনায়। তার রচিত "এবং ইন্দ্রজিৎ" বাংলা নাটকের আধুনিক যুগে পদার্পণের জন্মলগ্ন। নাটকের পাত্র-পাত্রী অমল-কমল-নির্মল /তথা ইন্দ্রজিৎ, মাসিমা এবং মানসী। এর সাথে লেখকও রয়েছেন। তার ১৯৮২ সালের ইংরেজি প্রবন্ধ "The changing language of theatre" এ লিখেছেন "…Indrajit is a prototype, not a character"।

এই নাটকে ব্যক্তি খণ্ডিত– স্পেস-টাইম কন্টিনিউয়ামে মিশে আছে অমল-কমল-বিমল এবং ইন্দ্রজিৎ। রূপান্তরিত জীবনের অন্তর্লীন অসঙ্গতি ও অর্থহীনতায় বিধ্বস্ত। অমল-কমল-বিমল এবং ইন্দ্রজিৎ ঘর থেকে স্কুল, কলেজ, তারপর চাকরি। আবর্তিত ছিল জীবিকার যন্ত্রে; বৃত্তাকারে ঘুরে। নিয়মের শৃঙ্খলে সমাজ, সংসার হয়ে ওঠে বাঁধার দেয়াল।

ইন্দ্রজিৎ চিরাচরিত প্রথা নিয়ম ভাঙ্গতে চেয়েছিল; অন্য এক জীবনের স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু পারেনি। নৈরাশ্য ও ব্যর্থতার কাছে মাথা নত করে সেও গড্ডালিকা প্রবাহে গতানুগতিক জীবন যাত্রায় সামিল হতে বাধ্য হয়েছিল।

ইন্দ্রজিতের প্রতি নাটকের চরিত্র লেখকের উক্তি, "আমরাও অভিশপ্ত সিসিফাসের প্রেতাত্মা। আমরাও জানি ও পাথর পড়ে যাবে। যখন ঠেলে ঠেলে তুলছি তখনই জানি এ ঠেলার কোনো মানে নেই। পাহাড়ের ঐ চূড়োর কোনো মানে নেই।"

নাটকটির শেষ পর্যায় আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় আলবের কামুর 'দ্য মীথ অব সিসিফাস'। "এবং ইন্দ্রজিৎ" নাটকে অস্তিত্ববাদী ও অ্যাবসার্ডবাদী উভয়ের প্রয়োগ বৈশিষ্ট্য নিবিড় আলিঙ্গনে লীন হয়ে আছে। তাই আমি শ্রদ্ধাভরে অতীতের সাহিত্য সমালোচকদের সাথে দ্বিমত প্রকাশ করছি। "এবং ইন্দ্রজিৎ" এক নতুন ধরনের নাটক– নিদারুণ মৌলিক, এর উত্তরণ ঘটেছে হাইব্রিড অস্তিত্ববাদ ও কিমিতিবাদ অথবা অ্যাবসার্ডবাদের এক নতুন ধারায়।

১৯৪০ এর দশকে জাঁ পল সার্ত্রে অস্তিত্ববাদ ও আলবের কামু অ্যাবসার্ডবাদের সাহিত্য প্রয়োগ নিয়ে যখন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছেন, সেই সময়ে ১৯৪৪ সালে প্রকাশিত রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের "আট বছর আগের একদিন"-এর কয়েক পঙক্তি মালায় লিখেছিলেন-

"তবু রোজ রাতে আমি চেয়ে দেখি, আহা

থুরথুরে অন্ধ পেঁচা অশ্বত্থের ডালে বসে এসে,

চোখ পাল্টায়ে কয়: বুড়ি চাঁদ গেছে বুঝি জলে ভেসে?

চমৎকার

ধরা যাক দু একটা ইঁদুর এবার।"

প্যাঁচার মতন নিরর্থক পৃথিবীর এক ঘেয়েমি নিয়ে বেঁচে আছে ইন্দ্রজিৎ, সিসিফাস, মজিদ এবং রোঁকোতঁ।