মানুষের প্রাণ বাঁচাতে জাতীয় ঐক্যের বিকল্প নাই

অজয় দাশগুপ্তঅজয় দাশগুপ্ত
Published : 24 July 2021, 11:30 AM
Updated : 24 July 2021, 11:30 AM

আমাদের এই বসুন্ধরাকে, আমাদের এই পৃথিবীকে আমরা নিজের হাতে অনেকখানি ধ্বংস করেছি। এখন যে একটা ভাইরাসের আক্রমণে সারা পৃথিবীতে এত মানুষ মারা গেছে, এত মানুষ আক্রান্ত হয়েছে, আমরা লকডাউন পরিস্থিতিতে ঘরবন্দি হয়ে রয়েছি, এটাকে আমরা প্রকৃতির প্রতিশোধ বলতে পারি। অথবা বলতে পারি, প্রকৃতি আপাতত আমাদের উদ্দেশ্যে একটা সাবধান বাণী ছেড়েছে, এই বলে সতর্ক করে দিয়েছে যে, যদি এইভাবে চলো তাহলে ধ্বংস অনিবার্য। প্রকৃতিকে ধ্বংস করলে প্রকৃতি একদিন না একদিন তার প্রতিশোধ নেবে।

– ভয়েস অব আমেরিকা দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন পরিবেশবিদ জয়ন্ত বসু

উন্নত বা অনুন্নত কোন্ দেশ, কোন্ জাতিকে ছেড়ে কথা বলেছে করোনাভাইরাস? কাউকে ছাড় দেয়নি। আমি যখন এ লেখা লিখছি, সিডনি পার করছে এক কঠিন সময়। এমনই কঠিন যা ভাবা যায়নি। সভ্যদেশ বা সভ্যজাতি যাই বলি না কেন, বিপদে পড়লে সবার আসল চেহারা বেরিয়ে আসে।

অস্ট্রেলিয়া কেবল দেশ নয়, মহাদেশ। এদেশে ভারত, যুক্তরাষ্ট্র এবং যুক্তরাজ্যের মতো অঙ্গরাজ্য আছে কয়েকটা। ফেডারেল বা কেন্দ্রীয় সরকার এক ও অভিন্ন। এই যুক্ত কাঠামোতেও মহামারীর কারণে অনৈক্য আর বিভেদ দেখা দিয়েছে।

ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সংক্রমণ ভয়াবহ আকার ধারণ করায় সিডনির সাথে অন্যসব জায়গার যোগাযোগ এখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। শুধু বন্ধ? যাবার বা আসার বে-আইনি চেষ্টা করলে সাজা, জরিমানা- এসবও হবে। ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণে ফাঁক গলে বেরিয়ে পড়েছে যাবতীয় ভুল-ভ্রান্তি। বিশেষত একটি স্বচ্ছল ধনী দেশ হবার পরও সময়মতো টিকার ব্যবস্থা না নেওয়ায় সবকিছু এখন হুমকির মুখে। যদিও অর্থের জোগান থাকায় এবং সীমিত জনসংখ্যার কারণে এ সমস্যা থেকে দ্রুত হয়তো বেরিয়ে আসতে পারবে অস্ট্রেলিয়া।

দুনিয়ার সাথে পাল্লা দিয়ে বাংলাদেশও লড়াই করছে। কোভিড নিয়ে দেশ ও সরকারের উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। কিন্তু এই যে ইমোশন বা বিশ্বাসের সাথে আপস করে লকডাউন উঠিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তটি কি আমাদের ছেড়ে কথা বলবে? যদি তিনদিনের জন্য শিথিল হতো, বলার হয়তো কিছু থাকতো না। কিন্তু লকডাউন হঠাৎ শিথিল আর হঠাৎ কড়া করা আমাদের সমাজে কতোটা সম্ভবপর? আর কতোটা নিরাপদ? যেই আপনি বললেন শিথিল, ব্যস বাসে-ট্রেনে-ফেরিতে-নৌকায় শুরু হলো যাত্রার ঢল। আবার যেই বললেন- এবার শিথিলতা খতম। ব্যস আবার ফিরে আসার দৌড়ঝাপ শুরু। এসবই কিন্তু কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। আর মাঝখানে কী হচ্ছে- মহামারী পেয়ে যাচ্ছে মাথায় ওঠার আশকারা এবং জান দিচ্ছে আম জনতা।

প্রথমদিকে কিছু মহলের প্রচারণার কারণে আমাদের মানসিক জগতে কোভিড মহামারীর ভয়াবহতা 'হালকা'ভাবে নেওয়ার প্রবণতা তৈরি হয়েছে। সে প্রবণতা থেকে আমরা এখনও বেরিয়ে আসতে পারি নাই।

শুরুতেই চাওর হয়েছিল এ মহামারীতে নাকি সাধারণ বা আমজনতা কিংবা পরিশ্রমী জনতা নিরাপদ। এটা যে কতবড় ভুল তা বুঝেও এখনও বুঝতে চাই না আমরা। বলাবাহুল্য পরিশ্রমী মানুষের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো, বেশি পরিশ্রম তাদের ভালো রাখে। কিন্তু সেই সামর্থ্যেরও তো একটি শেষ বিন্দু রয়েছে। কোভিড যে কাউকে সামর্থ্যের শেষ বিন্দুতে পৌঁছে দিবে না, তার গ্যারান্টি কি! তাছাড়া যেকোনও মানুষ এ ভাইরাসে আক্রান্ত হলে সহজে আরও আট-দশজনকে আক্রান্ত করে। কাজেই একজন পরিশ্রমী মানুষ আক্রান্ত হয়ে নিজে বাঁচলেও আর কতজনকে মেরে গেলেন বা মারতে পারেন- সেটা ভুললে চলবে? আমরা এসব কিছুই মনে রাখছি না।

কাজের কথায় আসি। দেশে ১০০ ভাগ লকডাউন অসম্ভব। সাধারণ মানুষ যারা দিন আনেন, দিন খান- তাদের বাঁচার রসদ জোগাড় করতে হয় রোজ। তাদের বাঁচার জন্য কাজ লাগবেই। এই যে কাজকর্ম হঠাৎ বন্ধ- হঠাৎ খোলার ভেতর যে অনিশ্চয়তা, তা সমস্যাকে আরও জটিল করছে। কোরবানি ঈদের পর সারাদেশে রমরমা চামড়া ব্যবসার কথাই ধরুন। এবার তা মার খেবে গেছে। এর সাথে জড়িত মানুষজনের কপালে হাত। গরু ব্যবসায়ীরা পার পেয়ে গেলেও এরা পার পাননি। এমন সব কারণে সরকারের কর্তাব্যক্তিদের উচিত সুদূর প্রসারী চিন্তা নেওয়া।

ডেল্টাই শেষ ভ্যারিয়েন্ট নয়। এরপর আরও ভ্যারিয়েন্ট আসবে এটাই বিশেষজ্ঞদের মত। তাহলে উপায়?

উপায় একটাই জনগণকে টিকা দেওয়ানো। টিকা দিতে দেরি হলে বা সবাইকে সে আওতায় আনতে না পারলে সমস্যা কখনো যাবে না। বাংলাদেশকে ভারতের টিকা দেওয়ার কথা থাকলেও, তারা নিজেদের সংকটের কারণেই টিকার জোগান দিতে পারেনি।

নানা জায়গা থেকে সরকার টিকা জোগাড়ের চেষ্টা করছে। ফ্রি টিকার পাশাপাশি শুনেছি টিকা কেনার চেষ্টাও অব্যাহত রয়েছে। সত্যি বলতে কি সরকারের সব মন্ত্রী টিকা নিয়ে কথা বলেন। যদিও কথা বলা উচিৎ সংশ্লিষ্ট জনের। তা না হলে একেকবার একেক ধরনের তথ্য বিভ্রান্ত করে। কখনো কখনো বলা হচ্ছে, দেশেই নাকি টিকা উৎপাদন করা হবে। অথচ এও জানলাম সে ভরসা পায়নি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। তবে সরকারের সবার কথাতেই এ আত্মবিশ্বাস পাওয়া গেছে যে, টিকা কিনতে আমাদের অর্থাভাব হবে না। এটিও একটি ইতিবাচক দিক।

কোনও টিকাই এখনো একশ ভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারেনি। এ স্বল্প সময়ে পারবেও না। ওই ৬ , ৭০ বা ৯০ শতাংশ নিরাপদ থাকার ওপর নির্ভর করেই বাঁচতে হবে সবাইকে। সেটাই এখন বাঁচার পথ। এ কারণটিকে সামনে রেখে লকডাউন করলে সমস্যার সমাধান সহজ হবে। সুবিধামতো এক সপ্তাহ লকডাউন, তারপর তুলে নেওয়া বা এমন কিছু করার ভেতর সাময়িক সান্তনা, সন্তুষ্টি ছাড়া আর কিছু নাই।

লকডাউন উঠে যাওয়ার কুফল পাওয়া যাবে আরও এক সপ্তাহ পর। আশঙ্কা জাগছে, তা কতোটা করুণ হয়! আমাদের সমাজ আর সাধারণ মানুষকে মাথায় রেখেই টিকার ব্যবস্থা জরুরী। টিকা দেওয়া হলে অবস্থা কতোটা নিরাপদ হয় ইউরো কাপ তার প্রমাণ । যে পরিমাণ দর্শক স্টেডিয়ামে এসে খেলা দেখেছেন, সে তুলনায় সংক্রমণ ছিল অতি নগণ্য।

দীর্ঘসময় আর ভবিষ্যতে ভালো থাকার জন্য কি আমরা মাস্ক পরিধান আর টিকা নেওয়ার কাজগুলো করবো না? মুক্তিযুদ্ধসহ নানা কাজে নিজেদের যোগ্যতা আর সাহসের প্রমাণ দেওয়া জাতিকে নির্দেশনা দিতে পারলেই কাজ হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পাশাপাশি অন্যেরা কি পারবেন এ কাজ করতে? এমন গুরুত্বপূর্ণ সময়ে প্রাণ বাঁচানোর ব্যাপারে কি জাতি ঐক্যবদ্ধ থাকবে না? একটা জাতীয় সংলাপ আর জাতীয় ঐক্য ও প্রচারণা কি এখন জরুরী নয়? মানুষের কান্না দেখুন। তাদের অসহায় মুখগুলো দেখুন। নিজেকে প্রশ্ন করুন, তারপর কাজ শুরু করুন প্লিজ।

সিডনি

২২/০৭/২১