ষাটের দশকে স্বাধীনতার সশস্ত্র প্রস্তুতি ও বঙ্গবন্ধু

মুহাম্মদ শামসুল হক
Published : 18 June 2021, 06:06 PM
Updated : 18 June 2021, 06:06 PM

ঐতিহাসিক 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা'র অভিযুক্তদের আনুষ্ঠানিক বিচারকাজ শুরুর দিনটি ছিল ১৯৬৮ সালের ১৯ জুন। এ দিনটিতে বাংলার মুক্তিসনদ ছয় দফার প্রবক্তা শেখ মুজিবুর রহমানসহ সামরিক-বেসামরিক ৩৫ বাঙালিকে অভিযুক্ত করে দণ্ডবিধি ১২১ (ক) ধারা ও দণ্ডবিধির ১৩১ ধারায় এ বিচারকাজ শুরু হয়েছিল।

অভিযোগপত্রে উল্লেখিত অভিযোগ অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করার পরিকল্পনার কথা সত্য বলে প্রমাণ করা গেলে তিনিসহ সব অভিযুক্তের ফাঁসির আদেশ হতে পারতো। বাঙালিদের সৌভাগ্য যে, প্রকৃত অর্থে অভিযোগ সত্য হলেও তা প্রমাণ করতে পারেনি পাকিস্তানি সামরিক সরকার। বলা যায় ছাত্র-জনতা প্রবল আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে মামলাটি মিথ্যা বলে স্বীকার করিয়ে নিয়ে শেখ মুজিবসহ সব অভিযুক্তকে মুক্তি দিতে বাধ্য করেছিল।

পৃথিবীর কোনও ভূখণ্ডে একটি রাষ্ট্রের ভেতর বসবাসরত জনগোষ্ঠী নানা দ্বন্দ্ব সংঘাতের এক পর্যায়ে এসে যদি দেখে যে, পরষ্পর একই রাষ্ট্রের কাঠামোর ভেতর বেশিদিন টিকে থাকা আর সম্ভব নয়, তবে সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর মধ্যে আলাপ-আলোচনা ও সমঝোতার ভিত্তিতে পৃথক স্বাধীন জাতি-রাষ্ট্র গঠনের উদাহরণ বিরল নয়। যেমন ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্তির জন্য বহু বছর ধরে নানা আন্দোলনের এক পর্যায়ে আলোচনার ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি পৃথক রাষ্ট্র জন্ম নিয়েছে ১৯৪৭ সালে। ৮০-৯০ এর দশকে পরাক্রমশালী সোভিয়েত রাশিয়া থেকে সমঝোতার ভিত্তিতে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে উজবেকিস্তান, কাজাকিস্তান, লাটভিয়াসহ সাতটি সোভিয়েত অঙ্গরাজ্য।

তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে হাজারো বৈপরীত্য সত্ত্বেও শাসকগোষ্ঠী স্বাধীনতার মন্ত্রে উদীপ্ত জনগোষ্ঠীর অধিকারকে নানা কলা কৌশলে অস্বীকার করতে চায়। অধিকার আদায়ের সংগ্রাম ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষ্যা অস্ত্রের মাধ্যমে ঠেকিয়ে রাখতে চায়। এক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত মুক্তির লক্ষ্য অর্জনের জন্য সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীকে একই মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে, একই কাতারে সামিল হয়ে, বিনা প্রশ্নে, নিঃস্বার্থভাবে জানমাল সমর্পণের প্রস্তুতি নিতে হয়। আর এরকম প্রস্তুতির জন্য জনগণকে মানসিক ও সাংগঠনিকভাবে উপযুক্ত করতে প্রয়োজন কৌশলী ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন যোগ্য নেতার। স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রক্রিয়া যেমন দীর্ঘ, যুদ্ধের ফলাফলও তেমন অনিশ্চিত। উদাহরণ আমাদের চোখের সামনে। আরব ভূখণ্ডে ফিলিস্তিনি জাতি জননন্দিত নেতা ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে প্রায় তিন যুগের বেশি সময় ধরে ইসরাইলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াই চালিয়ে যাবার পরও পূর্ণ স্বাধীনতা পায়নি। তার মৃত্যুর পর থেকে এখনো ফিলিস্তিনি জনগণ স্বাধীনতার লড়াই অব্যাহত রেখেছেন।

বাংলাদেশের জনগণ পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ লড়াইয়ের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের সেই সুকঠিন কাজটি সম্পন্ন করেছে অসামান্য ত্যাগ তিতীক্ষা ও সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে। আর এ লড়াইয়ে সংশ্লিষ্ট সকলকে এক কাতারে সামিল করে এগিয়ে নেওয়ার দুঃসাধ্য কঠিন কাজটি সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছেন সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, 'বাংলাদেশ' নামক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে শেখ মুজিব প্রসঙ্গটি নানা কারণে অনন্য ও ব্যতিক্রম। ধর্মীয় জাতিসত্ত্বাবিশিষ্ট পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের আওতায় শাসিত হবার প্রাথমিক অবস্থা থেকে বাঙালি জাতির অনেকেই তাদের অন্ধকারময় ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আঁচ করতে পেরেছিলেন। যতই দিন যায় ততই তাঁদের উপলব্ধি তীব্র হতে থাকে। রাজনীতিক, ছাত্রসমাজ, সশস্ত্র বাহিনী ও অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি নানা শ্রেণি-পেশার লোকের মধ্যে বিক্ষিপ্তভাবে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষ্যা দানা বাঁধতে থাকে। এ আকাঙ্ক্ষ্যাকে নিজের আকাঙ্ক্ষ্যা ও চেতনার সাথে মিশিয়ে এমনভাবে স্বাধীনতার সোপান তৈরি করেন শেখ মুজিব, যা সমসাময়িক অনেক বয়োজ্যেষ্ঠ নেতার পক্ষে সম্ভব হয়ে উঠেনি। এ কারণেই বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রাম ও শেখ মুজিব প্রসঙ্গটি একসূত্রে গাঁথা হয়ে গেছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ও সশস্ত্র উভয় প্রক্রিয়ায়ই এগিয়েছে। চূড়ান্ত মুক্তি এসেছে সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে। স্বাধীনতার প্রয়োজনের কথা অনেকেই আকারে ইঙ্গিতে বিভিন্ন সময় বলেছেন। কিন্তু এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার মাধ্যমে শেখ মুজিব যেভাবে জেল জুলুম সহ্য করে এক একটি বাঁধা ধাপে ধাপে অতিক্রম করে এগিয়ে গেছেন তা আর কারও সাহসে কুলোয়নি। সে রকম দূরদর্শিতাও আর কারও মধ্যে দেখা যায়নি।

পূর্ব বাংলায় ব্রিটিশ আমলে মাস্টারদা সূর্যসেন, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুসহ অনেকেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের সূচনা করলেও অসময়োচিত, অপরিকল্পিত ও সাধারণ জনগণকে সম্পৃক্ত করতে না পারায় ওইসব সংগ্রাম চূড়ান্তভাবে সফল হয়নি।

 বাংলাদেশে ১৯৬২ সাল থেকে 'অপূর্ব সংসদ' নামে একটি সংগঠন ছাত্রদের বিভিন্ন দাবি দাওয়া নিয়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আড়ালে ছাত্র জনতাকে স্বাধীনতার জন্য উজ্জীবিত করার প্রয়াস পেয়েছিল। অপূর্ব সংসদের প্রধান সমন্বয়কারী ছিলেন আবদুল আজিজ বাগমার। তিনি ছিলেন ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে গঠিত সর্বদলীয় ছাত্র সংস্থার সাধারণ সম্পাদক। অপূর্ব সংসদের আসল ব্যাখ্যা হলো 'অ' তে অস্থায়ী, 'পূ' তে পূর্ব, 'ব' তে বঙ্গ এবং 'স' তে সরকার। অর্থাৎ অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকার। সংগঠনের প্রথম সভাপতি ছিলেন প্রয়াত অধ্যাপক অবনী বর্মণ। সংগঠনের নেতা-কর্মীরা বিভিন্ন প্রচারপত্র, ইশতেহার ইত্যাদির মাধ্যমে বাঙালির শিক্ষা, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের পাশাপাশি স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনের কথা তুলে ধরেন। আইউব খানের সামরিক শাসনের ভীতিকর পরিবেশে সংগঠনের উদ্যোক্তা ও অন্য সংগঠকরা গোপনীয় সভায় মিলিত হতেন। পর্যায়ক্রমে এ সংগঠনের কাজের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন ছাত্র ফোরাম ইডেন কলেজ শাখার তৎকালীন সাধারণ সম্পাদিকা নাজমা রহমান, ড. আহমদ শরীফ, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, বেগম সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক আবদুল হাই, শওকত ওসমান প্রমুখ। তবে সীমিত সাংগঠনিক ক্ষমতা ও রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তা ব্যাপক জনগোষ্ঠীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেনি। 

পূর্ব বাংলার মেহনতি জনগণের মজলুম জননেতা হিসেবে খ্যাত মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৫৭ সালে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক নীতির প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে 'আসসালামু আলাইকুম' বলেছিলেন। অনেকে একে স্বায়ত্বশাসনের দাবি হিসেবে দেখেন। কেউ কেউ একে পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলাকে পৃথক করার হুঁশিয়ারি হিসেবেও ভাবেন। কিন্তু সর্বস্তরের জনগণের কাছে তা বোধগম্য হয়নি। বামপন্থী সংগ্রামী সংগঠন কম্যুনিস্ট পার্টি পূর্ব বাংলার জনগণের শোষণমুক্তি ও রাজনৈতিক স্বাধীনতার লক্ষ্যে নানা কর্মসূচি হাতে নিলেও স্বাধীনতার কথাটি তখনও স্পষ্ট করেনি যেমনটি ষাটের দশকের শুরুতে কম্যুনিস্ট পার্টির সভায় করেছিলেন শেখ মুজিব।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক সংগ্রামের নানা দিক নিয়ে নানাজনে নানাভাবে গবেষণা করেছেন, নানা লেখা প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু দেশকে স্বাধীন করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের প্রয়োজন হতে পারে এবং এজন্য প্রগতিশীল ছাত্র যুব সমাজকে তৈরির পাশাপাশি স্বাধীনতাকামী বাঙালি সৈনিকদের সংগঠিত করার ব্যাপারে তার বিপ্লবী ভূমিকার বিষয়টি প্রায় উপেক্ষিত থেকে গেছে। তার সেই ভূমিকার কথা স্পষ্ট হলে বোঝা যাবে স্বাধীনতার জন্য তিনি ষাটের দশকের আগে থেকেই কতটুকু আন্তরিক ছিলেন এবং প্রয়োজনে যে কোনো ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত ছিলেন।

একথা অনস্বীকার্য যে, শেখ মুজিব ছিলেন মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মতো সংগ্রামী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মতো গণতান্ত্রিক নেতার ভাবশিষ্য। তাদের হাত ধরেই শেখ মুজিবের নেতৃত্বের বিকাশ ঘটে। কিন্তু তারুণ্য-যৌবনের জয়যাত্রায় তাঁর চিন্তা-চেতনা ছিল ওই দুই নেতার তুলনায় অগ্রসর, আধুনিক এবং স্পষ্ট। তবে নিজেকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত করার আগে তার চিন্তাগুলোর বহিঃপ্রকাশ তিনি ওই নেতাদের সামনে করতেন না। চীনের সাথে সম্পর্কের কারণে পাকিস্তানের অখণ্ডতার ব্যাপারে মাওলানা ভাসানী ছিলেন দোদুল্যমান। আর শেষ পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দী ছিলেন এক পাকিস্তানে বিশ্বাসী। বিষয়টির প্রতি খেয়াল রেখেই তিনি কৌশলে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ এবং অন্যান্য পেশাজীবীদের মধ্যে স্বাধীনতার স্বপ্ন বিকশিত করার কাজটি সুকৌশলে এগিয়ে নেন। প্রথমে তিনি উদ্যোগ নেন আওয়ামী মুসলিম লীগকে অসাম্প্রদায়িক গণপ্রতিষ্ঠানে পরিণত করার। ১৯৫৫ সালের ২১, ২২ ও ২৩ অক্টোবর দলের সাধারণ সম্পাদকের প্রতিবেদনে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে 'মুসলিম' শব্দটি তুলে দেওয়ার যৌক্তিকতা তুলে ধরে তিনি বলেন, "তখনকার বাস্তব প্রয়োজন অনুযায়ী আমাদের সংগঠনকে একটি সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে সে অবস্থা আর নেই। মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির আজ অবসান ঘটেছে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল পাকিস্তানবাসীর নিজস্ব রাজনৈতিক জোট হিসেবে গণআন্দোলনে নেতৃত্ব গ্রহণ করার দায়িত্ব আজ আওয়ামী লীগ গ্রহণ করতে পারে। আমরা দ্বিধাহীন চিত্তে ঘোষণা করতে পারি যে, দেশের সকল ধর্মের, সকল বর্ণের এবং সকল ভাষাভাষী মানুষকে একটি গণপ্রতিষ্ঠানে সমবেত করা প্রয়োজন। বস্তুত আওয়ামী লীগ দলকে সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকল মানুষের জন্য অবারিত করার মধ্য দিয়েই আমরা আমাদের প্রগতিশীল ভূমিকাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে সক্ষম হব।"

১৯৫৬ সালেই পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান করার প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন শেখ মুজিব। সে সময় গণপরিষদে দেওয়া বক্তৃতায় তিনি তার মনোভাব স্পষ্ট করে বলেন, "…মাননীয় স্পীকার, আপনি দেখতেই পাচ্ছেন যে, ওরা 'পূর্ব বাংলা' নামটা পাল্টিয়ে 'পূর্ব পাকিস্তান' করতে চাচ্ছে। অথচ আমরা বারবার এই দাবি করছি যে, এখন এর নাম শুধু 'বেঙ্গল' (বাংলা) করা হোক। 'বেঙ্গল' (বাংলা) শব্দের একটা ইতিহাস রয়েছে, এর নিজস্ব ঐতিহ্য বিদ্যমান। আপনারা নাম বদলাতে পারেন, তবে এক্ষেত্রে জনসাধারণের মতামত নিতেই হবে। যদি আপনারা এই নাম বদলাতে চান, তাহলে আমাদের বাংলায় ফিরে যেয়ে জনগণকে জিজ্ঞেস করতে হবে তারা এ ধরনের পরিবর্তন মেনে নেবে কি না।''

ওই অধিবেশনেই তিনি বাঙালিদের ওপর জুলুম-শোষণ বন্ধ না হলে  জনগণ 'অনিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি' গ্রহণ করতে বাধ্য হবে বলে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীকে হুঁশিয়ার করে দেন। তিনি বলেন, "জুলুম মাত করো ভাই (অত্যাচার করো না ভাই)। যদি এসব কিছু আপনারা আমাদের উপর চাপিয়ে দিতে চান, তাহলে আমাদের বাধ্য হয়েই সংবিধান বিরোধী পদ্ধতি গ্রহণ করতে হবে। সংবিধানের বিধি মোতাবেক আপনাদের এগুতে হবে। আপনারা যদি জনসাধারণকে শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতি গ্রহণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করেন, তাহলে তারা অনিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতি গ্রহণে বাধ্য হবে। এটাই বিশ্বের সর্বত্র ঘটে থাকে এবং তা বিশ্বের ইতিহাস থেকে অনুধাবন করা সম্ভব।"

ষাটের দশকের শুরুতে (১৯৬১ সালে) আওয়ামী লীগ ও কম্যুনিস্ট পার্টির এক গোপন সভায় আন্দোলনের নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়। ওই সভায় শেখ মুজিব খোলাখুলিভাবে স্বাধীনতার দাবিকে আন্দোলনের কর্মসূচিতে রাখার আহ্বান জানান কমরেড মনি সিংকে। এ সম্পর্কে পার্টির তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক খোকা রায় তার 'সংগ্রামের তিন দশক' গ্রন্থে লিখেছেন, "শেখ মুজিব তুললেন এক মৌলিক প্রশ্ন। তিনি বললেন, এসব দাবি-দাওয়া কর্মসূচিতে রাখুন, কোন আপত্তি নেই। কিন্তু একটা কথা আমি খোলাখুলি বলতে চাই, আমাদের বিশ্বাস, গণতন্ত্র, স্বায়ত্বশাসন এসব কোন দাবিই পাঞ্জাবিরা মানবে না। কাজেই স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালিদের মুক্তি নেই। স্বাধীনতার দাবিটা আন্দোলনের কর্মসূচিতে রাখা দরকার।"

পাকিস্তানিদের অন্যায় শাসন-শোষণ, জুলুম কিন্তু থেমে ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানে সরকারি বেসরকারি সংস্থা ও সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ওপরও শোষণ নিপীড়ন চলতে থাকে সমানতালে। সেখানে তারা পাকিস্তানিদের হাত থেকে বাঁচার উপায় এবং এজন্য যোগ্য নেতৃত্বের সন্ধান করছিলেন। সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ তাঁদের ওপর নির্যাতনের চিত্র তুলে ধরে প্রতিকারের জন্য তৎকালীন জ্যেষ্ঠ নেতা যেমন, মাওলানা ভাসানী, ফজলুল কাদের চৌধুরী, সবুর খান, ইউসুফ আলী, ফরিদ আহমদসহ অনেকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। কিন্তু কেউ তাদের সুস্পষ্ট কোনো আশ্বাস বা দিক নির্দেশনা দিতে পারেননি। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন শেখ মুজিব।

১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ঘটনা। শেখ মুজিব ইতিমধ্যে পূর্ব পাকিস্তান মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ গ্রহণ করেছেন। ফেব্রুয়ারিতেই একদিন পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত এমপি  হোস্টেল সামাকো হাউসে বসেই তিনি কয়েকজন বাঙালি প্রতিবাদকারীকে বললেন, "এদের সঙ্গে (পাকিস্তানিদের সঙ্গে) আর থাকা চলবে না। ঢাকায় গিয়ে আলাদা হওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে নেব।" এ ঘটনার সাক্ষী তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি (পরবর্তীতে ন্যাপ ও গণফোরামের সঙ্গে যুক্ত, বর্তমানে প্রয়াত) মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী। তিনি ১৯৫৫ সালের অক্টোবরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর 'নন কমিশন অর্ডিনারি রিক্রুট' হিসেবে যোগ দেন। পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটায় একবছর প্রশিক্ষণ শেষে পাকিস্তানিদের অবিচার ও স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হয়ে প্রতিবাদ করায় সেনাবাহিনীর চাকরি করার সুযোগ হারান। পরবর্তীতে মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী বাংলাদেশকে স্বাধীন করার গোপন প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত হন এবং আগরতলা মামলার আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার হয়ে নির্যাতন ভোগ করেন।

শেখ মুজিব যে স্বাধীনতার জন্য ষাটের দশকের শুরু থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তার সত্যতা ১৯৬২ সালেই পূর্ব পাকিস্তান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তৈরি এক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, "পূর্ব পাকিস্তান লিবারেল পার্টির নামে যারা প্রচারপত্র বিলি করেন, তাদের একজনকে গ্রেপ্তার করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তিনি কলকাতায় গিয়ে সেখানে কয়েক ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেও তার কথায় প্রকাশ হয় যে, পোস্টারগুলো (প্রচারপত্র) আওয়ামী লীগের একজন প্রাক্তন মন্ত্রী, একজন অধ্যাপক ও অন্যান্য স্থানীয় লোকজনের অনুরোধে প্রস্তুত করা হয়। সে প্রচারপত্রে নিজস্ব সেনা ও নৌবাহিনী সমেত স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রস্তাব করা হয় এবং তাতে কোন্ কোন্ ব্যক্তি শীর্ষস্থানীয় পদে আসীন হবেন তার তালিকাসহ যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও সোভিয়েত ইউনিয়নের কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়। তা পেশোয়ারে নিয়োজিত একজন বিক্ষুব্ধ, অসন্তুষ্ট, পূর্ব পাকিস্তানী এয়ারম্যানের কাজ বলে প্রতীয়মান হয়।"

তৎকালীন ছাত্রনেতা আবদুর রাজ্জাক (সাবেক মন্ত্রী ও এমপি) আমাকে (লেখক) দেওয়া সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় এ রকম একটি প্রচারপত্র তিনিসহ কয়েকজন ছাত্র বিলি করেছেন।

 ভয়েস অব আমেরিকাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে (২০০৯ সালের জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে প্রচারিত) বঙ্গবন্ধুর বড় মেয়ে ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, "ষাটের দশকের শুরু থেকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার একটা প্রস্তুতি বঙ্গবন্ধু শুরু করেছিলেন। যে কোনো কারণে হোক সেটা সফল হয়নি।"

১৯৯৪ সালের ১০ অগাস্ট লেখা ও সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক নিবন্ধে শেখ হাসিনা লিখেছেন, "তখন রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। আওয়ামী লীগের সব নেতা 'এবডো' ছিলেন অর্থাৎ সক্রিয় রাজনীতিতে কেউ অংশ গ্রহণ করতে পারবেন না। তাই ছাত্রদের সংগঠিত করে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন শুরু করা হয়। আব্বা অবশ্য আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবদের বাড়ি বেড়াতে যেতেন বিভিন্ন জেলায়। সেখানে দলকে সংগঠিত করার কাজ ও আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিতে থাকেন। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য প্রতি জেলা, মহকুমা, থানায় গোপন সেল গঠন করেন। দেশকে স্বাধীন করার জন্য দলকে সুসংগঠিত করার কাজ গোপনে চলতে থাকে। ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে। ১৯৬২-তে বহু ছাত্র গ্রেপ্তার হয়। ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের বহু নেতা এ বাড়িতে এসেছেন গোপনে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ নিতে ও আলোচনা করতে।"

দেশকে স্বাধীন করার গোপন প্রস্তুতিমূলক প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত সামরিক বাহিনীর সাবেক সদস্য, সরকারি আমলা ও রাজনৈতিক নেতাদের অনেকেও পৃথক সাক্ষাৎকারে সশস্ত্র প্রস্তুতির বিষয় আমার কাছে স্বীকার করেছেন। ২০০৮ সাল পর্যন্ত কথিত 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা'র জীবিত অভিযুক্তদের মধ্যে শামসুর রহমান খান সিএসপি, ব্রিগেডিয়ার (অব.) খুরশিদ উদ্দিন, কর্নেল (অব.) শওকত আলী (পরে সাংসদ ও ডেপুটি স্পিকার), কর্নেল (অব.) শামসুল আলম, কমান্ডার (অব.) আবদুর রউফ, নূর মোহাম্মদ বাবুল (ক্যাপ্টেন বাবুল), করপোরাল এবিএম সামাদ, ফ্লাইট সার্জেন্ট আবদুল জলিল, মাহফুজুল বারী, বিধান কৃষ্ণ সেন, লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের স্ত্রী কোহিনুর বেগম, রুহুল কুদ্দুসের ছেলে এহসান উল-আমিন, প্রয়াত মানিক চৌধুরীর স্ত্রী সবিতা চৌধুরী ও ছেলে দীপংকর চৌধুরী, সুবেদার আবদুর রাজ্জাকের স্ত্রী রিজিয়া বেগম ও ছেলে এসএম তরিকুল ইসলামের সাক্ষাতকার নিয়েছি। 

রাজসাক্ষী ডা. ছৈয়দুর রহমান, বৈরী সাক্ষী মো. আবুল হোসেন, ঘটনার সঙ্গে যুক্ত কিন্তু চার্জশিটভুক্ত হননি এমন ব্যক্তি সাবেক সেনা প্রধান লে. জে. মাহবুবুর রহমান, আলী রেজার ভাই আলী নওয়াজ, জয়নাল আবেদীন খান, সুলতান উদ্দিনের ভাই কামালউদ্দিন, প্রয়াত জাসদ নেতা কাজী আরেফ আহমদ, আওয়ামী লীগ নেতা আবদুর রাজ্জাক, অধ্যাপক সৈয়দ ইলিয়াছ ধামী প্রমুখের সাক্ষাৎকারও নিয়েছি। তারা প্রত্যেকেই বলেছেন, তাদের আন্দোলনের রাজনৈতিক নেতৃত্বে উদীয়মান অসম সাহসী নেতা শেখ মুজিব আছেন জেনেই তারা এমন একটা আন্দোলনে যুক্ত হতে অনুপ্রণিত হয়েছেন। তারা জানান, পশ্চিম পাকিস্তানে তৎকালীন সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন বিভাগে কর্মরত কর্মকর্তা কর্মচারীরা পাকিস্তানি কর্মকর্তাদের হাতে প্রতিনিয়ত নির্যাতিত, লাঞ্ছিত, অবহেলিত, কথায় কথায় চাকরিচ্যুতি, ছুটি-ছাটা বা পদোন্নতিতে বৈষম্য ইত্যাদির শিকার হচ্ছিলেন। তাদের মধ্যে কিছু স্বাধীনচেতা, প্রতিবাদীমনষ্ক বাঙালি পাকিস্তানিদের অন্যায় আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। তারা বিক্ষিপ্তভাবে চিন্তা করতে থাকেন কীভাবে পাকিস্তানিদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। কেউ কেউ এমনও ভাবেন যে, এই অত্যাচার ও বৈষম্যের হাত থেকে বাঁচতে হলে পূর্ব বাংলাকে পশ্চিমাদের শাসনের কবল থেকে মুক্ত অর্থাৎ স্বাধীন করতে হবে। প্রয়োজনে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন করতে হবে। কিন্তু অল্প কয়েকজন সৈনিক চাইলেই তো আর স্বাধীনতা এসে যাবে না। এজন্য প্রয়োজন সাংগঠনিক শক্তি, রাজনৈতিক শক্তির সমর্থন ও সহযোগিতা এবং আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা। এ পর্যায়ে তারা প্রাথমিকভাবে পাঁচ-সাতজন আলাপ আলোচনার মাধ্যমে তৎকালীন বাঙালিদের মধ্য থেকে এমন সাহসী ও যোগ্য নেতার খোঁজ করতে থাকেন যিনি গোপন তৎপরতায় প্রয়োজনীয় সাহায্য সহযোগিতা দিতে পারবেন এবং একই সঙ্গে এই সশস্ত্র সংগ্রামের প্রতি রাজনৈতিক সমর্থন যোগাতে পারবেন। নানা সূত্রের মাধ্যমে তারা বেশ কজন জ্যেষ্ঠ নেতার সমর্থন চেয়ে ব্যর্থ হন। এক পর্যায়ে নিশ্চিত হন যে, শেখ মুজিবই হতে পারেন তাদের কাঙ্ক্ষিত সাহসী, প্রতিবাদী, উপযুক্ত সংগ্রামী নেতা।

শেখ মুজিব ইতিমধ্যে অর্থাৎ ১৯৬১ সালেই 'পূর্ব বাংলা মুক্তিফ্রন্ট' নামে একটি গোপন সংগঠনের জন্ম দেন। পাশাপাশি চলে ছাত্রদের মধ্যে সশস্ত্র ক্যাডার সৃষ্টির প্রক্রিয়া। এর অংশ হিসেবেই বঙ্গবন্ধুর তত্ত্বাবধানে ছাত্রলীগের স্বাধীনতাপন্থি প্রগতিশীল বিশ্বস্ত বাছাই করা কর্মীদের নিয়ে ১৯৬২ সালে গঠন করা হয় 'স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ।' ১৯৬৪ সালে গঠন করা হয় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদের 'কেন্দ্রীয় নিউক্লিয়াস'। শুরুতে এসব সংগঠনের নেতৃত্বে যুক্ত ছিলেন সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক ও কাজী আরেফ আহমদ। (এ সম্পর্কে প্রয়াত জাসদ নেতা বিধান কৃষ্ণ সেন, কাজী আরেফ আহমদ ও আবদুর রাজ্জাকের পৃথক সাক্ষাৎকার রয়েছে আমার স্বাধীনতার সশস্ত্র প্রস্তুতি ও বঙ্গবন্ধু-আগরতলা মামলার অপ্রকাশিত জবাববন্দি বইয়ে)।

ষাটের দশকের গোড়ার দিকে পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থানরত নৌবাহিনীর বিক্ষুব্ধ লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেমের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর পরোক্ষ যোগাযোগ শুরু হয়। বঙ্গবন্ধু  তার নিজস্ব সূত্রের মাধ্যমে সৈনিকদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নেন। ১৯৬২ সালের শেষের দিকে করাচিতে নৌবাহিনীর কামাল উদ্দিনের টিচার্স হাউজিং সোসাইটির বাসায় এক গোপন বৈঠকে নৌবাহিনীর সদস্যেরা তাদের মনোভাবের কথা শেখ মুজিবকে খুলে বলেন এবং তার নেতৃত্ব ও পরামর্শসহ সার্বিক সাহায্য সহযোগিতা চান। ওই বৈঠকে বিক্ষুব্ধ সৈনিকদের পক্ষে তাদের গ্রুপ নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন, মোজাম্মেল হোসেন, সুলতান উদ্দিন, স্টুয়ার্ড মুজিব, নূর মোহাম্মদ বাবুল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। শেখ মুজিব তাদের মনোভাব জেনে নিজেরও একই মনোভাব ও পরিকল্পনার কথা জানান। তিনি বলেন, "স্বাধীনতার জন্য আমি আমার শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত দিতে রাজি আছি। আপনাদের যখন যে রকম সাহায্য সহযোগিতা প্রয়োজন তা আমি দেব।" 

এছাড়া স্বাধীনতার আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে জনপ্রিয় করার ব্যাপারে ছাত্রদের দায়িত্ব দেওয়া হবে বলে তিনি তাদের আশ্বস্ত করেন। একই সঙ্গে তিনি দেশপ্রেমিক সৈনিকদের সুসংগঠিত হওয়ার পরামর্শ দেন। তার আগে অর্থাৎ কমান্ডার মোয়াজ্জেমের প্রস্তাব পাওয়ার পর বঙ্গবন্ধু রুহুল কুদ্দুসসহ কয়েকজন অতি বিশ্বস্ত লোক নিয়ে বিষয়টি পর্যালোচনা করেন। সমস্ত বিষয়ে সর্বোচ্চ গোপনীয়তা বজায় রাখার সিদ্ধান্ত হয়। এরপর থেকে নৌ, বিমান ও সেনা সদস্যেরা তাদের বিশ্বস্ত লোকজন নিয়ে ধীরে ধীরে পৃথক পৃথক গ্রুপ সৃষ্টির মাধ্যমে সংগঠিত হতে থাকেন। ১৯৬৬ সালের মধ্যে বিভিন্ন গ্রুপের নেতা ও সদস্যদের সঙ্গে সোহরাওয়ার্দীর বাসভবন, করাাচিতে লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেমের করাচির বাসা, কামাল উদ্দিনের বাসা, ঢাকায় তাজউদ্দিন আহমদের বাসা, চট্টগ্রামে ভূপতিভূতিভূষণ চৌধুরী (মানিক চৌধুরী), ডা. ছৈয়দুর রহমান ও বিধান সেনের বাসা, হোটেল মিসকা, হোটেল শাহজাহানসহ বিভিন্ন স্থানে একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। নিরাপত্তা, গোপনীয়তা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করে বঙ্গবন্ধু কেবল নির্দিষ্ট কয়েকজন ছাড়া অন্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎ দিতেন না। এমনকি আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগের তৎকালীন নেতৃত্বকে পর্যন্ত এ গোপন প্রক্রিয়ার আসল রহস্য জানানো বারণ ছিল। কারণ কোনো কারণে ঘটনা ফাঁস হলে সবাইকে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে এবং বাঙালিদের মুক্তি তথা স্বাধীনতার আন্দোলন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। 

বিপ্লবী সংগঠনের সূচনাকালীন ও গোপন বিপ্লবী কাউন্সিলের একমাত্র জীবিত সদস্য নূর মোহাম্মদ বাবুল জানিয়েছেন, ১৯৬৬ সালে ছয় দফা ঘোষণার পর করাচিতে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বাসভবনের সামনে ট্যাক্সি দুর্ঘটনার মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু তা সফল হয়নি। বঙ্গবন্ধু তার পক্ষে সৈনিকদের সঙ্গে পরোক্ষভাবে যোগাযোগের জন্য চট্টগ্রামের মানিক চৌধুরীকে মনোনীত করেন। পরে ডা. ছৈয়দুর রহমান ও বিধান কৃষ্ণ সেনকেও নির্বাচিত করা হয়। বঙ্গবন্ধু তার বিশ্বস্ত বেশ কয়েক জন সিএসপি কর্মকর্তা যেমন রুহুল কুদ্দুস, আহমদ ফজলুর রহমান, খান শামসুর রহমান প্রমুখের সঙ্গেও স্বাধীনতা অর্জনের প্রয়োজন এবং সৈনিকদের সহযোগিতার ব্যাপারে আলোচনা করতেন। মানিক চৌধুরী শেখ মুজিবের পক্ষে অনেক সময় খবরাখবর জানাতেন বেগম মুজিবকে।

বঙ্গবন্ধুর পরামর্শ অনুযায়ী কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের নেতৃত্বাধীন সৈনিক গ্রুপের সঙ্গে সিএসপি কর্মকর্তাদেরও একাধিক বৈঠক হয় করাচি, ঢাকা ও চট্টগ্রামে। সিএসপি কর্মকর্তাসহ আগরতলা মামলার সব আসামি স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা জানলেও এর বাস্তবায়নের প্রকৃত কৌশল সম্পর্কে সবাই পুরোপুরি জানতেন না। সংশ্লিষ্ট বেশিরভাগই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথাবার্তা ও তার কার্যক্রমে বুঝতে পেরেছিলেন যে, তার মূল (বঙ্গবন্ধুর) লক্ষ্য ছিল, সকল প্রগতিশীল স্বাধীনচেতা শক্তির সম্মিলন ঘটিয়ে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতার পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি করা। তবে এ পর্যায়ে সরকারের দিক থেকে সশস্ত্রভাবে বাধাবিঘ্ন এলে সশস্ত্র উপায়েই তা মোকাবেলার মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করার প্রস্তুতি নিতে হবে। আর এজন্য প্রয়োজন হলে ভারতের সহযোগিতা নেওয়া এবং এ ব্যাপারে উপায় বের করার জন্য ভারতীয় রাষ্ট্রদূতসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলোচনার প্রক্রিয়াও চলে। এমনকি বঙ্গবন্ধু এ ব্যাপারে আলোচনার জন্য ১৯৬৩-৬৪ সালে বিলোনিয়া সীমান্ত দিয়ে গোপনে ভারতে গিয়েছেন তাও নিশ্চিত করেছেন তার সফরসঙ্গী বৈরী সাক্ষী আবুল হোসেন।

কিন্তু চারদিকে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শেষ হওয়ার আগেই নানা কারণে পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থার কাছে বিষয়টি ফাঁস হয়ে যায়। মামলা চূড়ান্ত করার আগেই শেখ মুজিবকে জেলে আটক রাখা হয়। পরে একে একে গোপন প্রক্রিয়ায় প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হিসেবে চিহ্নিত ৩৫ জনকে চার্জশিটভুক্ত আসামি এবং ১১ জনকে রাজসাক্ষী করে 'রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য' শিরোনামে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করা হয় যা 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' নামে পরিচিতি পায়। মামলায় মোট ২০০ সামরিক বেসামরিক ব্যক্তিকে সাক্ষী হিসেবে দেখানো হয়। চার জন সাক্ষী মামলার জেরাকালে অভিযোগ অস্বীকার করলে বৈরী ঘোষণা করা হয় তাদের। মামলার প্রধান অর্থাৎ এক নম্বর আসামি ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান এবং দুই নম্বর আসামি ছিলেন লে. ক. মোয়াজ্জেম হোসেন।

আগরতলা মামলায় মাত্র ৩৫ জনকে আসামি করা হলেও এতে বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে সরাসরি যুক্ত, তাদের নানাভাবে সহযোগী হিসেবে জড়িত সদস্য সংখ্যা অন্তত পাঁচ হাজারের ওপরে হবে বলে সংশ্লিষ্টরা দাবি করেছেন। মূল আসামি ছাড়াও মামলা শুরুর দিক থেকে পরবর্তীতে তিন হাজারের বেশি লোককে, কারো কারো মতে আরো বেশি সংখ্যক লোককে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়। তাদের অনেকে বিনা বিচারে এক থেকে দেড় বছর জেল খেটেছেন, নির্যাতন ভোগ করেছেন। কিন্তু মামলায় অভিযুক্ত করার মতো পর্যাপ্ত সাক্ষী প্রমাণের অভাবে তাদের আসামি হিসেবে দেখানো হয়নি এবং অভিযোগপত্রও সেভাবে দেওয়া হয়নি। শেষ পর্যন্ত মামলা প্রত্যাহার করা হলে সংশ্লিষ্ট সবাই জেল থেকে মুক্তি পান। আসামির তালিকাভুক্ত না হওয়ায় ওইসব দেশপ্রেমিকদের তখন যেমন, পরবর্তীতেও তেমন কোনো রকম খোঁজ খবর নেওয়া হয়নি বা লেখালেখি হয়নি।

আসামি বিধান কৃষ্ণ সেন, নূর মোহাম্মদ বাবুল, কমান্ডার আবদুর রউফসহ অন্য অনেকের কাছে জানা গেছে, প্রথম দিকে চার পাঁচজন করে এক একটা গ্রুপ বিপ্লবী প্রক্রিয়ায় যাত্রা শুরু করলেও ঘটনা ফাঁস হওয়ার আগে পর্যন্ত বিভিন্ন গ্রুপের সংস্পর্শে এসে পাঁচ হাজারের বেশি সামরিক ও বেসামরিক ব্যক্তি অলিখিতভাবে তাদের সদস্য হয়েছিলেন। এর প্রমাণ হিসেবে প্রাক্তন সেনাপ্রধান লে জে মাহবুবুর রহমান, আসামি আলী রেজার ভাই আলী নওয়াজ এবং আসামির তালিকাভুক্ত না হয়েও ১৪ মাস জেল খাটা জয়নাল আবেদীন খানের কথা উল্লেখ করা যায়। (তাদের পৃথক সাক্ষাৎকার আমার 'আগরতলা মামলার অপ্রকাশিত গ্রন্থে দেওয়া হয়েছে।) এছাড়া অভিযোগপত্র পর্যালোচনায়ও দেখা যায়, অভিযুক্তদের সঙ্গে বিভিন্ন বৈঠকে এমন অনেকেই উপস্থিত ছিলেন যাদের নাম পরিচয় তদন্তকারীরা উদ্ধার করতে পারেনি।

বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ভারতের সহযোগিতায় সংশ্লিষ্টরা বাংলাদেশকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন তথা স্বাধীন করতে চায় এমন স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তারা আসামিদের ওপর সীমাহীন নির্যাতন চালায়। ভারতের সহায়তায় পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্রের কথা শুনে পূর্ব বাংলার মানুষ শেখ মুজিবসহ স্বাধীনতাকামীদের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠবে এবং এতে শেখ মুজিবকে ফাঁসিতে ঝোলানোর মাধ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলন চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়া যাবে এই ধারণা থেকে সরকার মামলাটিকে 'আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা' হিসেবে প্রচার করে। কিন্তু বাঙালিরা সরকারের ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে শেখ মুজিবসহ আসামিদের নিঃশর্ত মুক্তির দাবিতে ব্যাপক গণআন্দোলনের মাধ্যমে। অবশেষে গণবিস্ফোরণের মুখে উপায়ান্তর না দেখে সরকার মামলা প্রত্যাহারে বাধ্য হয় এবং বঙ্গবন্ধুসহ সব বন্দি জেল থেকে মুক্তি পান। মামলা থেকে মুক্তির পর ১৯৬৯ এর ২৩ ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক পল্টন ময়দানে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ আহূত সমাবেশেই শেখ মুজিব 'বঙ্গবন্ধু' উপাধিতে ভূষিত হন।

স্বাধীনতা সংগ্রামীদের কার্যক্রমের জন্য যে টাকা-পয়সার দরকার তা নানা উৎস থেকে পাওয়া যেত। এসব উৎস মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আগ্রহেই সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম উৎস ছিলেন চট্টগ্রামের মানিক চৌধুরী। আসামি সুলতান উদ্দিন ১৯৯২ সালে তা জানিয়েছিলেন তার ভাই কামাল উদ্দিনকে।

বিধানকৃষ্ণ সেনও বলেছেন, "বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সূত্র থেকে টাকা সংগ্রহ করে আন্দোলনের কাজে খরচ করতেন। তিনি চাইলেই টাকা পেতেন। বেগম মুজিবের মাধ্যমেও টাকা পয়সা কিছু পাওয়া গেছে। চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে বঙ্গবন্ধু, এমএ আজিজের মালিকানাধীন নিউ এজেন্সি নামে একটি কাস্টমস ক্লিয়ারিং, ফরওয়ার্ডিং অ্যান্ড ইন্ডেন্টিং ফার্ম ছিল। সেটির আয়ের বড় একটা অংশ গোপন আন্দোলনের পেছনে খরচ করা হতো।" এছাড়া, রুহুল কুদ্দুসের মতো প্রভাবশালী পদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তা ও সমমনা শুভাকাঙ্ক্ষীদের মাধ্যমেও কিছু অর্থের সংস্থান হতো বলে সংশ্লিষ্টরা ধারণা দিয়েছেন।