আসছে ভ্যাকসিন, কাটবে কি অন্ধকার?

নাদিম মাহমুদনাদিম মাহমুদ
Published : 25 Nov 2020, 04:08 PM
Updated : 25 Nov 2020, 04:08 PM

এক বছর আগে চীনের উহান থেকে ছড়িয়ে পড়া সার্স-কভ-২ ভাইরাসের দাপট শুরু হয়েছিল। মৃত্যুর মিছিলে জনজীবন কার্যত স্থবির হয়ে গিয়েছে। মৃত্যুর এ মিছিল থামাতে আশার সংবাদ পেতে শুরু করেছে বিশ্ববাসী।

চলতি মাসের শুরুতে ভ্যাকসিন কার্যকরের সুখবর দিয়েছে জার্মানির বায়োএনটেক ও যুক্তরাষ্ট্রের ফাইজার। ত্রাতা হিসেবে আর্বিভুত হয়েছে এই ভ্যাকসিন। শতকরা ৯০ শতাংশ ভ্যাকসিনে অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে বলে তারা জানিয়ে দিয়েছে। সীমাহীন কষ্টের মধ্যে বছরের শেষে এ সংবাদটি আমাদের জন্য যথেষ্ট।

ফাইজারের ঘোষণার ২ দিন পর গত ১১ নভেম্বর রাশিয়ার ক্যামেলিয়া ন্যাশনাল রিসার্চ সেন্টারের এপিডেমিওলজি এবং মাইক্রোবায়োলজি 'স্পুটনিক' ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার খবর জানিয়েছে দেশটি। যদিও এ ভ্যাকসিনের তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল এখনো শেষ হয়নি। ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মধ্যে রাশিয়ার ১০ হাজার মানুষের মধ্যে দেওয়া ভ্যাকসিনের সফলতার খবর তারা জানাচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে সায়েন্টিফিক কমিউনিটিতে বিতর্ক কাটেনি (সূত্র-১)।

ফাইজারের ভ্যাকসিনের পর যুক্তরাষ্ট্রের আর এক ওষুধ প্রস্তুতকারক মর্ডানা তাদের উদ্ভাবিত ভ্যাকসিনের ব্যাপারে বলছে, ৯৪ দশমিক ৫ শতাংশ কার্যকর (সূত্র-২)। বলা যেতে পারে ভ্যাকসিন কার্যকারিতায় ১৬ নভেম্বর পর্যন্ত তারাই এগিয়ে। এ ভ্যাকসিনগুলোর অ্যান্টিবডি তৈরির খবর আমাদের কাছে সবচেয়ে সুখকর।

আর সবশেষ গত ২৩ নভেম্বর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও অ্যাস্ট্রাজেনেকা  ঘোষণা দেয়, তাদের টিকা গড়ে ৭০ শতাংশ ক্ষেত্রে কার্যকর প্রমাণিত হয়েছে। তবে ডোজের মাত্রা পরিবর্তন করে দিলে তা ৯০ শতাংশ পর্যন্ত কার্যকর হতে পারে।

নভেম্বরের ৪ তারিখ পর্যন্ত যুক্তরাজ্য ও ব্রাজিলে ১১ হাজার স্বেচ্ছাসেবীর উপর চালানো তৃতীয় ধাপের পরীক্ষায় ১৩১ জনের কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল বলে তারা জানাচ্ছে।

কোম্পানিটি দাবি করছে, ভ্যাকসিন গ্রহণের পরও কোভিডে আক্রান্ত হলেও তাদের মধ্যে কোভিডের জটিল কোনও লক্ষণ দেখা যায়নি, এমন কী কাউকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর প্রয়োজন পড়েনি। 

যুক্তরাষ্ট্র, কেনিয়া, ভারত ও জাপানে প্রায় ৬০ হাজার মানুষের এখনো তৃতীয়ধাপের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে। সব ডেটা না পাওয়া পর্যন্ত কিছুই বলা যাচ্ছে না অ্যাস্ট্রাজেনেকার এ ভ্যাকসিনটি কতটা সফলতার সাথে অ্যান্টিবডি তৈরি করছে।

ফাইজারের ভ্যাকসিনের কার্যকারিতায় জার্মানির বায়োএনটেক কোম্পানির প্রধান নির্বাহী উগর শাহীন পেশাজীবীদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম লিংকড ইনে এক বার্তায় লিখেন,

১০ মাস আগে শুরু করা বিএনটি১৬২বি২ ভ্যাকসিনের তৃতীয় ধাপের অভ্যন্তরীণ প্রতিবেদনে কোভিড-১৯ মোকাবেলায় ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার কথা বলা হয়েছে। আমরা যখন সবাই কোভিড-১৯ দ্বিতীয় তরঙ্গ ঠেকাতে প্রস্তুতি নিচ্ছি তখন আমাদের ভ্যাকসিনে ৯০ শতাংশই অ্যান্টিবডি মানবদেহে তৈরি করেছে (সূত্র-৩)।

পরবর্তী আর এক বিজ্ঞপ্তিতে তারা এ বছরই ৫০ মিলিয়ন ভ্যাকসিন ডোজ তৈরির কথা জানিয়েছে আর আগামী বছরের মধ্যে এক দশমিক তিন বিলিয়ন ডোজ তৈরির পরিকল্পনাও উল্লেখ করেছে।

স্বাধীন তত্ত্ববধায়ক কমিটির অধীনে চলা ত্রিশ হাজার স্বেচ্ছাসেবীর দেহে চালানো তৃতীয় ধাপের ক্লিনিক্যাল টেস্টের পর মর্ডানার ভ্যাকসিনে প্রায় ৯৫ শতাংশ অ্যান্টিবডি তৈরি করছে যা ভাইরাস নিষ্ক্রিয়করণে যথেষ্ট। কোম্পানির কর্মকর্তারা একে দাবি করছে, 'গেইম চেঞ্জার' হিসেবে। চলতি বছরে তারাও ২০ মিলিয়ন ডোজ উৎপাদন করার কথা জানিয়েছে।

ভ্যাকসিন প্রস্তুতকারক কোম্পানি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য ও ঔষধ প্রশাসন (এফডিএ) অপেক্ষা করছে।

ফাইজার ও মর্ডানার এ দুই ভ্যাকসিনই জিন প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে তৈরি করা হয়েছে। মেসেনজার রাইবোনিউক্লিক অ্যাসিড বা এমআরএনএ ভিত্তিক এ ভ্যাকসিন প্রায় একই কৌশলে ডিজাইন করা হয়েছে।

অ্যাস্ট্রাজেনিকা নিয়ে সবাই আশাবাদী হলেও তৃতীয় ধাপের ফলাফল নিয়ে বিজ্ঞানী মহলে সমালোচনাও চলছে। ভ্যাকসিনটির মাত্র একটি ডোজে যে অ্যান্টবডি তৈরি হচ্ছে  তা কোভিড-১৯ নিউট্রালাইজড করার জন্য যথেষ্ট, তবে দ্বিতীয় ডোজে কার্যকারিতা যেভাবে কমে গেছে, তা নতুন প্রশ্নের উদ্রেক করছে।

কম ডোজে কেন কার্যকর বেশি হচ্ছে, আর দ্বিতীয় ডোজে কেন কার্যকারিতা কমছে- তার ব্যাখ্যা কোম্পানির পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি। সেটি যদি সত্য হয়, তাহলে অন্যান্য ভ্যাকসিনের দুইটি ডোজ নেওয়ার জন্য মানুষ কম ডোজে বেশি আগ্রহী হতে পারে। সেটি আর্থিক বা ব্যবসায়িক দৃৃষ্টিভঙ্গি থেকে কতোটা 'সুখকর' তা নিয়ে এখনো আলোচনা চলছে (সূত্র-৪)।

আরএনএ মূলত তাপমাত্রা সংবেদনশীল। নিদিষ্ট তাপমাত্রা সমন্বয় করতে না পারলে ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করা কিছুটা দুরূহ বটে। ফাইজারের ভ্যাকসিন মাইনাস ২০ থেকে ৭০ ডিগ্রির মধ্যে আর মর্ডানার ও অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন ২ থেকে ৮ ডিগ্রি অর্থাৎ সাধারণ রেফ্রিজারেটরে সংরক্ষণ করা যায়। 

অ্যাস্ট্রাজেনেকার কর্মকর্তারা বলছেন, তাদের ভ্যাকসিনের মূল্য প্রতিটি ডোজে ৩ থেকে ৪ ডলারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। মর্ডানা বলছে তাদের ভ্যাকসিনের প্রতিটি ডোজে মিলবে ২৫ ডলারে।

ফাইজারের মূল্য সংক্রান্ত এখনো কোনও তথ্য জানানো হয়নি। তবে অনেকেই ধারণা করছেন এই ভ্যাকসিনের বাজারমূল্য কিছুটা চড়া থাকবে।

তবে চমক দিতে পারে অ্যাস্ট্রাজেনেকা। প্রাথমিক তথ্য অনুযায়ী একটি ডোজে অ্যান্টিবডি উৎপাদনে যে সফলতা (৯০%) কথা বলা হচ্ছে, সেটি হলে বাজারে কমমূল্যের কার্যকর ভ্যাকসিন হিসেবে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এ ভ্যাকসিনটি সবার আগে থাকবে। এরই মধ্যে তারা আগামী মাসের মধ্যে ২০০ মিলিয়ন ডোজ বিশ্বব্যাপী দিতে পারবে বলেও সংবাদমাধ্যমগুলোকে জানাচ্ছে। 

বিশ্বের ইতিহাসে কোভিডের ভ্যাকসিনগুলোই প্রথম, যেগুলো গবেষকরা এতো দ্রুততর সময়ে ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে সফলতার কথা জানাচ্ছেন। বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় মানবজাতির ইতিহাসে অন্যতম এই বিপর্যয় রুখবার সাহসী শক্তি শেষ পর্যন্ত মানুষের হাতে এলো। বছর জুড়ে অন্ধকারে থাকা, অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল করতে ভ্যাকসিনের সফলতার বিকল্প আর কিছু ভাবনায় নেই। 

ভ্যাকসিন কার্যকারিতার খবর আমরা বিশ্বাস করলেও অ্যান্টিবডি কতদিন পর্যন্ত শরীরে থাকবে, তা নির্ণয় করা  এই স্বল্প সময়ে সম্ভব নয়। তাই মনের ভেতর শঙ্কা থাকবে, অ্যান্টিবডির স্থিতিকাল নিয়ে। বিজ্ঞানের এই অংশটি সত্যতা যাচাই করতে হলে আমাদের মাস-বছর অপেক্ষা করতে হবে।

সেই অপেক্ষার জন্য আমাদের হারাতে হবে অনেক প্রিয়জনকে। তবে বিশ্বনেতারা সেই দিকে না গিয়ে, যত দ্রুত সম্ভব ভ্যাকসিন সরবরাহে অনুমোদন দেবে বলে বিশ্বাস করি। জরুরি ভিত্তিতে সম্ভাব্য অনুমোদন পেতে যাওয়া এসব ভ্যাকসিন মানুষের প্রাণ সংহার কমিয়ে আনার লক্ষ্য থাকবে রাষ্ট্র প্রধানদের।

এরই মধ্যে বিশ্বের ধনী রাষ্ট্রগুলো ফাইজার. অ্যাস্ট্রাজেনেকা ও মর্ডানার ভ্যাকসিন কিনেছে/চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। কোনও কোনও রাষ্ট্র একাধিক কোম্পানির সাথে ‍চুক্তিবদ্ধ হয়েছে। মর্ডানার প্রধান নির্বাহী স্টেফার বানচিল ইঙ্গিত দিয়েছেন, তাদের ভ্যাকসিনের মূল্য চড়া হতে পারে। তবে তারা বিশ্বের ভ্যাকসিন সরবরাহে অলাভজনক সংস্থা 'কোভিড-১৯ ভ্যাকসিনস গ্লোবাল অ্যাকসেস' কোভ্যাক্স এর সাথে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করবেন। 

বিষয়টি এমনও হতে পারে, তিন থেকে চারটি ভ্যাকসিন কার্যকর হওয়ার পর ভ্যাকসিনের কার্যকারিতার উপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রগুলো ভ্যাকসিন নির্বাচন করবে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন ধরনের ভ্যাকসিন প্রয়োগ হতে পারে। গরীব রাষ্ট্রগুলোর ভ্যাকসিনের গুণগত মান ধনী রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে পার্থক্য থাকতে পারে। 

সবাই যদি একই ভ্যাকসিনের পেছনে ছোটে তাহলে ভ্যাকসিন উৎপাদন করতে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর হিমশিম খেতে হতে পারে। যদিও এটি কেবলই সম্ভবনার কথা। ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে রাষ্ট্রগুলো কতটা সহনশীলতার পরিচয় দেবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভূমিকা কেমন থাকবে তা বলা কঠিন, তবে ভ্যাকসিন সুষম বণ্টন নিয়ে ঝুঁকি থাকার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না।

এরই মধ্যে রাশিয়ার ভ্যাকসিন নিয়ে অবৈজ্ঞানিক আচরণ, বিশ্ব রাজনীতির মোড় ঘোরানোর ভূমিকায় থাকতে পারে। চীনের ভ্যাকসিন ক্যান্ডিটেডগুলো যেতে পারে গরীব দেশগুলোতে। তবে চীনের ভ্যাকসিন ও গবেষণার তথ্যে বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে পীড়াপীড়ি হওয়ার আশঙ্কা রয়েই যায়। 

বাংলাদেশ ইতিমধ্যে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের সাথে কয়েকশ কোটি টাকার ভ্যাকসিন কেনার চুক্তি করেছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে। অ্যাস্ট্রাজেনেকার ভ্যাকসিন উৎপাদনে দায়িত্ব থাকা সেরাম ইনস্টিটিউটের ভ্যাকসিনের মূল্য ধরা হয়েছে ৫ ডলার।  এখন পর্যন্ত যেসব দেশ ভ্যাকসিন কিনেছে তারা সরাসরি মাদার কোম্পানির সাথে চুক্তি করেছে। কত টাকায় ভ্যাকসিন বিক্রি হবে সেটি সংশ্লিষ্ট কেউ না জানালেও বাংলাদেশ টাকার অংকে এগিয়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যে ঋণ নেওয়ার আগ্রহ জানিয়েছে সরকার।

আমরা জানি না, ঠিক কোন কৌশলে সরকার এগিয়ে যাচ্ছে, তবে ভ্যাকসিনের মত ‍গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকারকে আরো বেশি দায়িত্বশীল ভূমিকায় আসা উচিত। 

তবে দিন শেষে এটিই আশার কথা যে, মৃত্যুহার কমানোর হাতিয়ার আপাতত মানুষের হাতে চলে এসেছে। অ্যান্টিবডি কতদিন স্থায়ী হবে সেই প্রশ্ন গৌণ রেখে ভ্যাকসিন হয়ে উঠবে জীবনের আলো। ভ্যাকসিনের আলোয় কেটে যাক সব স্তরের অন্ধকার। আগামী বছর ফিরে আসুক আমাদের স্বাভাবিক প্রাণ চাঞ্চল্য!